স্মৃতিতে তাদের কেবলই ক্যাম্প
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দৈনিক ভূমিষ্ঠ হয় ১৩০ শিশু- হুমায়ুন কবির জুশান উখিয়া (কক্সবাজার)
- ০১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০
২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিশুরা ক্যাম্পে জন্মাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতিদিন গড়ে জন্ম নিচ্ছে ১২০ থেকে ১৩০টি শিশু। এরই মধ্যে গেল কয়েক বছরে জন্ম নিয়েছে প্রায় দুই লাখ ৮০ হাজার শিশু। এ দিকে বাংলাদেশ সরকার ও জাতিসঙ্ঘের শরণার্থী সংস্থার যৌথ ফ্যাক্টশিটে জানুয়ারির হিসাব বলছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বর্তমানে মোট জনসংখ্যা ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫০ জন। এর মধ্যে ৫২ শতাংশই শিশু। সেই শিশুদের মধ্যে ৫ বছর থেকে ১১ বছরের ২১ শতাংশ, অর্থাৎ ২ লাখ ১৪ হাজার ৫৭৭ জন। সব মিলিয়ে এমনই প্রায় ৫ লক্ষাধিক শিশু ফেলে আসা দেশের বিষয়ে কিছুই মনে করতে পারে না। তারা জানে না, যে মিয়ানমার থেকে এক কাপড়ে পালাতে হলো, সেটাই কেন তাদের দেশ। তাদের স্মৃতিতে কেবলই ক্যাম্প। উখিয়ায় ১১ নম্বর ক্যাম্পের শিশুদের নিয়ে কয়েক দলে ভাগ করে নিয়ে কথা হয় ২২ জন শিশুর সাথে। এদের সবার বয়স ১০ থেকে ১৬ বছর। মিয়ানমার থেকে আসার সময় এদের বয়স ছিল ৩ থেকে ৯ বছর। ছেলেদের দুটো ও মেয়েদের দুটো দলে প্রশ্ন ছিল, কেন দেশে ফিরতে চাও, তোমাদের দেশটা কেমন। তাদের সবার উত্তরই কাছাকাছি। তারা বলছে, বাবা-মা বলেছে, আমাদের ওখানে সব আছে। ফিরে গেলে ওখানে আমাদের একঘরে থাকতে হবে না।
আমাদের দেশে ওইখানে তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি, জমি আছে, গোয়াল ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ আছে বলে তারা মা-বাবার কাছে রোজ শোনে। সেখানে একটা জায়গায় সবাইকে রাখা হয় না, এটাও শুনেছি। কিন্তু ওই জায়গাটা কেমন, তা তাদের স্মৃতিতে না থাকায়, তারা কল্পনা করতে পারে না। ক্যাম্পের এক বিদেশী ডাক্তার কেরি বলেন, রোহিঙ্গা শিশুরা তাদের নিজের দেশ তারা চেনে না, আর এ দেশটাও তাদের না। অনেকটা ছিন্নমূল হিসেবে বড় হচ্ছে। শিশুর বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে তার আত্মপরিচয় তৈরি হয়, এই শিশুদের ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। যা কি না সুষম মানসিক বিকাশের জন্য খুব জরুরি। সেটা যখন হবে না, তখন সে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং আত্মবিশ্বাস হারায়। যখন তার আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় না, তখন সেলফ রেসপেক্টের সমস্যা হয়। এই শিশুরা যখন বয়োসন্ধিকাল পার করবে, তখন সেই সমস্যাগুলো সে নিজে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে এবং পরিস্থিতির সাথে মিলাতে না পেরে হয়রানির শিকার হবে। বেড়ে ওঠার সাথে বাড়ছে হতাশা। এক রোহিঙ্গা পিতা ফয়েজুর রহমান বলেন, আমরা রোহিঙ্গারা দুনিয়ায় কোথায় কি হচ্ছে সব খোঁজ রাখি। সারাদিন ক্যাম্পে সময় কাটাতে হয়। তাই আমরা বেশি সন্তান জন্মদান করাকে সওয়াব ও ফজিলত আছে বলে মনে করি। এমন ঊর্ধ্বমুখী জন্মহার যেমন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তেমনি বড় সঙ্কটও তৈরি করছে। ক্যাম্প জীবনে বিনোদনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির এমন হার বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয় শিবিরগুলোর বেশির ভাগ উখিয়ার কুতুপালংয়ে। যেটিকে বলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয়শিবির। যেখানে ছোট একটি এলাকার মধ্যেই ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। সরেজমিন ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা নুর কবির সাত সন্তান ও স্ত্রীসহ ৯ জনের পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন ক্যাম্পের ডি-৫ ব্লকে। এর মধ্যে বড় ছেলের বয়স ১৮ আর ছোট মেয়ের বয়স তিন বছর। নুর কবির বলেন, সাত সন্তানের মধ্যে চার ছেলে ও তিন মেয়ে। এখন যদি সামনে আল্লাহ আরো দেয় তাহলে বাচ্চা আরো নেবো। শুধু নুর কবির নন, উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে বেশির ভাগের সন্তান চারজনের বেশি। এমনকি যাদের পরিবারে পাঁচ থেকে ছয়জনের বেশি সন্তান রয়েছে তারা আরো সন্তান নিতে আগ্রহী। কুতুপালংয়ের ক্যাম্প ২ ইস্টের বাসিন্দা খায়রুল আমিন বলেন, মিয়ানমারের ওপারে আমার কোনো বাচ্চা ছিল না। বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়ার পর এই ক্যাম্পেই জন্ম নিয়েছে চারটি বাচ্চা। আর বাচ্চা দেয়া না দেয়া এটা আল্লাহর ওপর। মন চাইলে নিবো, মন না চাইলে আর নিবো না। ক্যাম্পে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জানিয়েছেন, পরিবার- পরিকল্পনা সম্পর্কে অনাগ্রহ, রেশন বৃদ্ধি ও ক্যাম্প জীবনে তেমন কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকায় বেশি সন্তান জন্মদানের মূল কারণ। উখিয়া কুতুপালংয়ের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মিডওয়াইফ সুপারভাইজার আসমা আক্তার বলেন, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে কোনো আগ্রহ নেই। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে স্বামী-স্ত্রী ও শাশুড়িকে এনে কাউন্সেলিং করি। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ৩, ৫ বা ১০ বছরের পদ্ধতিগুলো একদম নিতে চায় না তারা।
ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা মনে করেন, বাচ্চা যত বেশি জন্ম নেবে মাথাপিছু রেশন তত বেশি হবে। এ জন্য রোহিঙ্গারা জন্মদানে বেশি আগ্রহী। একই ক্যাম্পের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের মেডিক্যাল অফিসার ডা: ফাতেমা আক্তার বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে বাচ্চা জন্মদানের প্রবণতা অনেক বেশি। কারণ তাদের কোনো কাজ নেই। বাচ্চা জন্ম দেয়া তাদের কাছে বিনোদনের ব্যবস্থা। রাজাপালং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের যদি কন্ট্রোল করা না যায়, তাহলে তারা বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়াবে। তাদের জন্মহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, যেভাবে রোহিঙ্গারা লাখে লাখে একসাথে এসেছিল, ঠিক এমন করেই তাদের ফেরত নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে দেখা যাবে, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রোহিঙ্গা এখান থেকে যাচ্ছে এবং তার চেয়ে বেশি রোহিঙ্গা শিশু ক্যাম্পে জন্ম নিচ্ছে। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো: মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্মহার বাংলাদেশীদের তুলনায় বেশি। ক্যাম্পে গড়ে ১২০ থেকে ১৩০ এর মতো শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এটি আমাদের জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ এখানে ঘনবসতি রয়েছে। জায়গার সঙ্কট রয়েছে। মাত্র আট হাজার একর জায়গার মধ্যে প্রায় ১০ লাখ লোক বাস করে। এখন নতুন নতুন শিশু জন্মগ্রহণ করছে। তাদের জন্য আমরা জায়গা কোথায় থেকে দেবো। এটা একটা বড় সঙ্কট। কমিশনার মো: মিজানুর রহমান আরো বলেন, পরিবার-পরিকল্পনা নিয়ে কাজ চলছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাও কাজ করছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ইমামদের সম্পৃক্ত করে সচেতনতার কাজ করে যাচ্ছি। প্রতি বছর আশ্রয়শিবিরে বাড়ছে জনসংখ্যা আর কমছে খাদ্যসহায়তা। সব মিলিয়ে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হলে নানামুখী সঙ্কট যুক্ত হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন তিনি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা