০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ জিলহজ ১৪৪৫
`

বাংলাদেশের লাভ নিয়ে সংশয়

রেল ট্রানজিটের কোনো সমীক্ষা জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি
-

- এটা রেল করিডোর, ঢাকার স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর, বাতিল দরকার : বিডি রহমতুল্লাহ
- রেল ট্রানজিটে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই লাভবান হবে বেশি : আহসান এইচ মনসুর
- নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নের পর সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন : জাকির হোসেন খান

বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ সহজতর ও উন্নত করার জন্য বাংলাদেশ ও ভারত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করেছেন।
গত ২২ জুন নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউজে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর এই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এই সমঝোতা স্মারকের মধ্যে রয়েছে, রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে একটি নতুন আন্তঃদেশীয় ট্রেন পরিষেবা চালু করা এবং বাংলাদেশে ভারতের রেল-ট্রানজিট।

সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের পর এক সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেন, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে রেল যোগাযোগ চালু করতে দুই নেতার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ রেলপথ ব্যবহার করে গেদে-দর্শনা থেকে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি ক্রস-বর্ডার ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত একটি পণ্য ট্রেন ট্রায়াল চালানো হবে। এটা আগামী জুলাইয়ের কোনো এক সময় ঘটতে পারে। এটি ভুটানের সাথে উপআঞ্চলিক সংযোগে সহায়তা করবে।
তবে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে ভারত বেশি লাভবান হবে। অন্য দিকে বাংলাদেশের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তারা। তারা বলছেন, এর আগে নৌ করিডোর নিয়ে চুক্তি হলেও বাংলাদেশ খুব একটা লাভবান হতে পারেনি। আবার ট্রেনে যাত্রী পরিবহনে বাংলাদেশ লাভ করলেও পণ্য পরিবহনে খুব বেশি লাভ করতে পারবে না।

পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক বিডি রহমত উল্লাহ রেল ট্রানজিটের বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেছেন, রেল ট্রানজিট নয়, এটা রেল করিডোর। কারণ ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে করে রেলের মাধ্যমে তাদের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে মালামাল ও যাত্রী বহন করবে। এ ট্রেন বাংলাদেশের কোনো মানুষ ব্যবহার করতে পারবে না। এখানে বাংলাদেশের কারো কোনো প্রবেশাধিকার থাকবে না। সুতরাং ভারত বাংলাদেশকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করবে। তিনি মনে করেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূমি, রেললাইন সংস্কার, রেলের সিগনাল ব্যবহারের মূল্যও আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী তারা পরিশোধ করবে না। তিনি গণমাধ্যমের প্রকাশিত এক খবরের উল্লেখ করে বলেন, আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী কোনো দেশের ভূমি ব্যবহার করে কোনো ট্রানজিট নিলে যে পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করতে হয়, ভারত পরিশোধ করবে তার এক তৃতীয়াংশ অর্থ।

বিডি রহমতুল্লাহ বলেন, ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ই স্বাধীন দু’টি দেশ। যেকোনো দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ক্ষেত্রে উভয় দেশেরই স্বাধীন মতামত প্রতিফলিত হওয়া উচিত। তিনি মনে করেন, এখানে একতরফা ভারতের সুবিধা দেয়ার জন্য চুক্তি করা হয়েছে। সুতরাং এ চুক্তি বাতিল করতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর ভারতকে দেয়া রেল-ট্রানজিটের বিষয়ে নয়া দিগন্তকে বলেছেন, রেল ট্রানজিটে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই লাভবান হবে বেশি। ভারত বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সহজেই ও কম খরচে এক অঙ্গরাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে পণ্য ও সেবা পরিবহন করতে পারবে।

তিনি বলেন, উভয় দেশের সমান বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সুবিধা ছাড়া চুক্তি হয় না। এ রেল ট্রানজিটের মাধ্যমে আমরা কি কি পণ্য ভারত থেকে আনতে পারব ও কোন কোন পণ্য পাঠাতে পারব তা আগে পরিষ্কার করতে হবে। আমাদের ব্যবসায়ীরা ও জনগণ কতটুকু লাভবান হবে সেটা আগে দেখতে হবে। যেমন-ভারত থেকে আমরা পাথর, বালু ও কাঠ আমদানি করি। এতে আমাদের পরিবহনে অনেক ব্যয় হয়। আমরা যদি রেলের মাধ্যমে ভারত থেকে এসব পণ্য আমদানি করতে পারি তাহলে আমাদের পরিবহন ব্যয় কম পড়বে। আবার আমাদের জনগণ ভারতে যেতে রেল সুবিধা পেলে পরিবহন খরচ অনেক কম হবে। এ বিষয়গুলো চুক্তিতে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ট্রানজিট ফি মুখ্য বিষয় নয়, উভয় দেশ সমান সমান লাভবান হবে কি না সেটা আগে দেখতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মো: জাকির হোসেন খান বলেছেন, ভারতের সাথে রেল ট্রানজিট বাস্তবায়নের আগে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্বার্থের বিষয়ে দ্বন্দ্ব নেই এমন অর্থনীতিবিদ, পরিবেশবিদ, জনস্বাস্থ্যসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের দিয়ে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। সাধারণ আর্থিক লাভ-লোকসানের চেয়ে সামগ্রিক অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানকে প্রাধান্য দেয়া উচিত।

তিনি উল্লেখ করেন, যেভাবে বাংলাদেশের কার্বন নিঃসরণ বাড়ছে তাতে দ্রুতই বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ বর্তমান ০.৫% এর কাছাকাছি থেকে বেড়ে প্রায় ১% এ দাঁড়াবে। ইউনিসেফের হিসাবে ইতোমধ্যে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার বাংলাদেশে ২০২১ সালেই বায়ু দূষণজনিত রোগে ২ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে। মাত্র ১০% বনায়নের কারণে ইতোমধ্যে ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশে অতিরিক্ত বায়ুদূষণ বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশে ব্যাপকভাবে মৃত্যুঝুঁকি বাড়াবে। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে চলাচলকারী বিদেশী যানবাহন বা শিল্পের নিঃসরিত অতিরিক্ত কার্বনের দায় সংশ্লিষ্ট দেশের বহন করার কথা, জনস্বাস্থ্যের চরম ঝুঁকি বিবেচনায় কোনো ধরনের অবহেলা করা ঠিক হবে না। প্রশ্ন হলো ভারতকে রেল ট্রানজিট দিলে আর ডিজেল চালিত ট্রেন চলাচল করলে যে কার্বন নিঃসরণ হবে তার দায়দায়িত্ব কে নেবে। এমনিতেই বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি, সেখানে ভারতের ট্রেন চলাচলে যে বাড়তি কার্বন নিঃসরণ হবে এ জন্য বাংলাদেশের যে ক্ষতি হবে কিভাবে তা পূরণ করা হবে সে বিষয়টি পরিষ্কার করা প্রয়োজন।

জাকির খান বলেন, বাংলাদেশের কৃষি জমি এমনিতেই কমে আসছে। এর ওপর ভারতের ট্রেন চলাচলের জন্য রাস্তা ও অনেক অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। এতে কৃষি জমি আরো কমে যাবে। এ ক্ষতি পূরণের বিষয়টিও চুক্তিতে পরিষ্কার করা দরকার।
সাউথ এশিয়ান জার্নাল অব সোস্যাল স্টাডিজ এবং অর্থনীতি এ ২০২৩ সালে আব্দুল খালেক এবং হারুনুর রশীদ প্রকাশিত ‘Costs and Benefits of Regional Connectivity: An Analysis from Bangladesh Perspective’ (Volume 20, Issue 3, Page 138-154, Article no.SAJSSE.106597' শীর্ষক গবেষণার ফলাফলে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় কানেকটিভিটির চেয়ে বহুপক্ষীয় কানেক্টিভিটি অধিকতর লাভজনক এবং নীতিনির্ধারকদের সেদিকে অধিকতর নজর দিতে হবে। কানেক্টিভিটি থেকে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। তবে আঞ্চলিক সংযোগ থেকে লাভ, বিশেষত, দ্বিপক্ষীয় সংযোগসংক্রান্ত নির্ধারক যেমন ট্রান্সশিপমেন্টের চার্জ, পরিমাণ এবং ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয়ের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ব্যয়, নিরাপত্তা উদ্বেগ এ ধরনের কানেক্টিভিটির সামাজিক ব্যয়ের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

এই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ভারত থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হলে তাতে বিশাল প্রকল্প ব্যয় হবে বলেও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তাই অনুল্লেখযোগ্য রাজস্বের চেয়ে অর্থনৈতিক (প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ) সব ধরনের খরচ ও সুবিধার অনুপাত পরিমাপে যেমন- জমি ব্যবহার, পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা, ফি থেকে আয়কে বিবেচনা করা উচিত। সামগ্রিক এসেসমেন্টে সামাজিক এবং নিরাপত্তার মতো বিষয়ের অর্থনৈতিক মূল্যকে বিবেচনায় নিয়ে নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত।

এ দিকে ডেইলি ইন্ডাস্ট্রি পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রেলপথ নির্মাণের পরিকল্পনা আগেই করেছিল। দেশটি ইতিমধ্যে ১৪টি রেলওয়ের জন্য চূড়ান্ত অবস্থান সমীক্ষা অনুমোদন করেছে। নতুন রেলপথে বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপালকেও সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশে ৮৬১ কিলোমিটার রেলপথ থাকবে।
দিল্লিতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে ৭৭ বছর পর রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে আন্তর্জাতিক ট্রেন চলাচল পুনরায় চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। আর এটি হবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চালানো চতুর্থ আন্তর্জাতিক ট্রেন। এ ছাড়া এই স্মারকলিপির গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে ভারতের কলকাতা থেকে সেভেন সিস্টার নামে পরিচিত সাতটি রাজ্যের ১২টি রুটের দূরত্ব ও সময় কমানোর উদ্যোগ। এর ফলে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে বড় সুবিধা পাবে দেশটি।

গুগল ম্যাপের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ‘চিকেন নেক’ করিডোর দিয়ে কলকাতা থেকে আগরতলা পর্যন্ত রেলপথের দূরত্ব প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার। এটি অতিক্রম করতে ৩১ থেকে ৩৬ ঘণ্টা সময় লাগে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে সেখানে যেতে দূরত্ব প্রায় ৫০০ থেকে ৫৫০ কিলোমিটারে নেমে আসবে। সাড়ে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগবে পার হতে।
১৪ জুন ভারতের কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ভারতের বাকি অংশের সাথে উত্তর-পূর্বের সাথে সংযোগকারী একটি মাত্র রেলপথ রয়েছে, যা শিলিগুড়ি করিডোরে পরিণত হয়েছে। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই করিডোরটি ‘চিকেন নেক’ নামে পরিচিত। এটি উপমহাদেশের সবচেয়ে সংকীর্ণ ভূমি। চিকেন নেক উত্তরে নেপাল এবং দক্ষিণে বাংলাদেশের সাথে সংযুক্ত। অন্য দিকে চীন সীমান্ত থেকে এর দূরত্ব ১৭০ কিলোমিটার।

পত্রিকাটি জানায়, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে রেলপথের একটি সেট ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সাথে রেলযোগাযোগ সহজতর ও উন্নত করবে। এতে বাংলাদেশের পাশাপাশি নেপাল যুক্ত হবে। নতুন পরিকল্পনার আওতায় মোট ১,২৭৫ কিলোমিটার রেলপথের ১৪টি বিভাগ থাকবে। এর মধ্যে ৮৬১ কিলোমিটার হবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। নেপালে ২০২ কিমি. এবং উত্তর-পূর্বে ২১২ কিমি হবে।
দ্য টেলিগ্রাফ আরো জানিয়েছে যে, ভারতকে দেশের মধ্যে রেলপথ নির্মাণের অনুমতি দেয়ার বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের ফলে নয়াদিল্লির পরিকল্পনা আরো সহজ হয়েছে। ভারতীয় রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে মোট ৮৬১ কিলোমিটার, নেপালে ২০২.৫০ কিলোমিটার এবং উত্তরবঙ্গ ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে ২১২ কিলোমিটার জরিপ করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো: হাদিউজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, কলকাতা থেকে আগরতলা পণ্য পরিবহনে তাদের দূরত্ব ও খরচ কমে যাবে। এটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। ফলে ভারত অনেক লাভবান হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, ভারতের সংযোগের প্রতিটি রুট আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা উচিত। আমাদের রেলের সেকশন এবং ক্ষমতা বিবেচনায় নেয়া উচিত। যেহেতু তারা আর্থিকভাবে অনেক লাভবান হবে এবং যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে, আমাদের সেখানে খুব ভালোভাবে আমাদের রাজস্ব সুবিধা সম্পর্কে আলোচনা করা উচিত। আমরা কিভাবে বিভাগ ও রেলওয়ের ক্ষমতার বাইরে নগদীকরণ করতে পারি তা খুব সতর্কতার সাথে দেখতে হবে। এমন হওয়া উচিত নয় যে শুধুমাত্র ভারত আমাদের মাধ্যমে যাবে এবং ভুটানের সাথে যোগাযোগ তৈরি করবে। আমাদের সেই সংযোগের সুবিধাভোগী হওয়ার জন্য, আমাদেরও সব কিছু ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে।

প্রসঙ্গত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সফরকালে দুই দেশের সহযোগিতা প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদি উল্লেখ করেন, এর আগে আখাউড়া ও আগরতলার মধ্যে ষষ্ঠ ভারত-বাংলাদেশ আন্তঃসীমান্ত রেল যোগাযোগ শুরু হয়েছে। খুলনা-মংলা বন্দর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর জন্য কার্গো সুবিধা চালু হয়েছে। মংলা বন্দর প্রথমবারের মতো রেলপথে যুক্ত হয়েছে। অন্য দিকে সমঝোতা স্মারক সম্পর্কে বিশদভাবে, বিদেশ সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেছেন যে, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ছয়টি আন্তঃসীমান্ত রেলসংযোগ ছাড়াও, নথিটিতে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বহন করে এর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে।

বিনয় কোয়াত্রা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, সংযোগ মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক অবকাঠামোর একটি বড় অংশকে শক্তিশালী করে। এটি কার্যকরভাবে একটি সংযোগ দৃষ্টান্ত যা উভয় দেশ, উভয় সমাজ, উভয় অর্থনীতির জন্য খুব ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ ভুটান এবং নেপালে যে উপআঞ্চলিক ট্রানজিট পাবে তা আরো প্রসারিত এবং শক্তিশালী করা হবে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্যে বোঝা যায়, ভারত অদূর ভবিষ্যতে একটি ট্রেন পরিষেবা চালানোর চেষ্টা করবে যা ত্রিপুরার মতো উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের সাথে সংযুক্ত করবে।

বাংলাদেশে, জল্পনা রয়েছে যে ভারত সরকার বাংলাদেশী রেললাইনের মাধ্যমে এক দেশ থেকে অন্য দেশে, বিশেষ করে দিল্লি বা কলকাতা থেকে তার সাত বোন রাজ্যে সামরিক অস্ত্র বা গোলাবারুদ বহন করতে পারে। এই চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট রেল মন্ত্রকের কর্মকর্তারা এই জল্পনাগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং বলেছেন যে, বাংলাদেশ রেলওয়ে সতর্কতার সাথে চুক্তির খসড়া তৈরি করেছে, বাংলাদেশী ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতীয় রেল ওয়াগনের অভ্যন্তরে কোনো ধ্বংসাত্মক পণ্য বা পণ্য পরিবহন নিষিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশে গুজব ছড়িয়েছে যে, রেল রুট চালু হয়ে গেলে ভারতীয় সৈন্যদের তাদের রেল ওয়াগন পাহারা দেয়ার অনুমতি দেয়া হতে পারে। তবে বাংলাদেশী রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এটি অস্বীকার করে জোর দিয়ে বলেছে যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ভারতীয় রেল ওয়াগনগুলোর নিরাপত্তা বজায় রাখবে, যেমনটি তারা বাংলাদেশী রেল ওয়াগনগুলোর জন্য করে এবং বহিরাগতদের বগিতে প্রবেশের অনুমতি দেবে না।
জানা গেছে, নতুন চুক্তি অনুযায়ী, ভারত এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের বিদ্যমান রেললাইন ব্যবহার করতে পারে এবং বাংলাদেশ নেপাল, ভুটান এবং ভারতের মতো অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোতে পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের জন্য ভারতীয় রেললাইন ব্যবহার করতে পারে।

বর্তমানে, পাঁচটি অপারেশনাল ইন্টারচেঞ্জ পয়েন্ট বাংলাদেশ রেলওয়েকে ভারতীয় রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত করে: বাংলাদেশের বেনাপোল-ভারতের পেট্রাপোল, বাংলাদেশের দর্শনা-ভারতে গেদে, বাংলাদেশের রোহানপুর-ভারতের সিংবাদ, বাংলাদেশের বিরল-ভারতে রাধিকাপুর এবং চিলাহাটি। বাংলাদেশ-ভারতের হলদিবাড়ি। উপরন্তু আখাউড়া (বাংলাদেশ) এবং আগরতলা (ভারত) এর মধ্যে ট্রায়াল রান করা হয়েছে, বাণিজ্যিক পরিষেবা শিগগিরই শুরু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বর্তমানে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আরো দুইটি রেলসংযোগ প্রকল্প জরিপ পর্যায়ে রয়েছে: বেলোনিয়া (ভারত) থেকে ফেনী (বাংলাদেশ) এবং মহিষাসন (ভারত) থেকে শাহবাজপুর (বাংলাদেশ)।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নতুন রেলসংযোগ চুক্তি অনুসারে, ভারত বাংলাদেশের রেলপথ ব্যবহার করে এই রুটে ট্রেন পরিচালনা করতে পারে এবং বাংলাদেশ ভারতীয় রেলের কাছ থেকে চার্জ নেবে। রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে, ৯৮২টি ভারতীয় ট্রেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পণ্য পরিবহন করেছিল এবং বাংলাদেশ রেলওয়ে শুধু ওয়াগন চার্জ থেকে ১১৭ কোটি টাকা আয় করেছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে আশা করছে, ভারত যখন বেশি ট্রেন পরিচালনা করবে, তখন বাংলাদেশ আরো বেশি আয় করতে পারবে। তবে এই আয়ের বিপরীতে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কেমন হবে এ বিষয়ে কোনো কিছু প্রকাশ করা হয়নি।


আরো সংবাদ



premium cement