০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১, ২৪ জিলহজ ১৪৪৫
`

বাংলাদেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন

ইমাম নিয়োগ ও অপসারণে সরকারের প্রভাব, ডিএসএ আইনের অপব্যবহার
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুতে জান্তা বাহিনীর বিমান হামলার দৃশ্য : নয়া দিগন্ত -


বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম রেখে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে সমর্থন ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নিপীড়ন অব্যাহত রয়েছে। সরকার মসজিদে ইমাম নিয়োগ ও অপসারণে প্রভাব খাটানোর পাশাপাশি ইমামরা তাদের খুতবায় কোন বিষয়বস্তু তুলে ধরবেন, এ বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছে। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (ডিএসএ) মতো আইন ব্যবহার করে মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যদের, বিশেষ করে হিন্দুদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম-২০২৩’ বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বিষয়ে এমনটি বলা হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ‘অফিস অব ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০২৩ সালের এই প্রতিবেদনে ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে নানা প্রতিবন্ধকতা ও বৈষম্যের দিক তুলে ধরা হয়েছে। এদেশে বিভিন্ন ধর্মের জন্য রয়েছে আলাদা পারিবারিক আইন।
আহমদিয়া সম্প্রদায়ের নেতারা বলেছেন, আহমেদনগরে গত বছরের (২০২৩) মার্চে তাঁদের বার্ষিক সম্মেলনে শত শত লোক হামলা চালায়। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সহিংসতায় দুজনের মৃত্যু হয়, আহত হন অনেকে। ওই ঘটনার পর পুলিশ কয়েক হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে। গ্রেফতার করা হয় সহিংসতার কথিত উসকানিদাতারাসহ দুই শতাধিক ব্যক্তিকে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা অব্যাহতভাবে বলেছেন, মুসলিম জনগোষ্ঠীর ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার কারণে’ ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী, বিশেষ করে হিন্দুধর্মের লোকজনকে নিশানা করে সরকার প্রায়ই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আইনের প্রয়োগ করেছে। যদিও প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তেমনটা নেয়া হয়নি।
এদিকে মুসলিম ধর্মীয় নেতারা বলেছেন, সরকার মসজিদে ইমাম নিয়োগ ও অপসারণে প্রভাব খাটিয়ে গেছে। দেশজুড়ে ইমামেরা তাদের খুতবায় কোন বিষয়বস্তু তুলে ধরবেন, এ বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।

গত সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থরক্ষায় সরকারের দেয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বিশেষ আইন কার্যকর করা, সরকারি চাকরিতে তাদের জন্য কোটা সংরক্ষণের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনাসহ বিভিন্ন দাবিতে অনশন কর্মসূচি ঘোষণা করে। এ কর্মসূচির প্রতিক্রিয়ায় সরকার অক্টোবরের মধ্যে একটি জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন ও ২০১৮ সালের নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ করার ঘোষণা দেয়; কিন্তু বছর শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এসব বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।
দেশে সহিংসতার ঘটনার ওপর নজরদারি করা সংগঠনগুলোর একটির হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ২২টি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় একজন নিহত ও ৮১ জন আহত হয়েছেন।
এ ছাড়া মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) ও কয়েকজন ধর্মীয় নেতা ইসলাম ও হিন্দুধর্ম থেকে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়া ব্যক্তিদের হয়রানি, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও শারীরিক নির্যাতন করার অভিযোগ করেছেন।

ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি সরকারের শ্রদ্ধাবোধের মাত্রা : বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় ধর্মের স্বীকৃতি দেয়া হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মের মানুষের জন্য সমমর্যাদা ও সমানাধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, এমন ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ক্ষতিকর’ বক্তব্য এবং কর্মকাণ্ডের জন্য জরিমানা বা দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সাজা রাখা হয়েছে দণ্ডবিধিতে। তবে এই নিষিদ্ধ বিষয়বস্তুর ব্যাখ্যা দণ্ডবিধিতে নেই। সরকারকে ‘নাগরিকদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বা ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্য অবমাননাকর’ ভাষা ব্যবহার করা সংবাদপত্র, সাময়িকী বা অন্য প্রকাশনার সব কপি জব্দ করার অনুমতি দিয়েছে ফৌজদারি আইন। অনলাইন প্রকাশনার ক্ষেত্রেও একই বিধি-নিষেধ এ আইনে আরোপ করা হয়েছে।
সহিংসতায় দায়ী ব্যক্তিদের সাজা দিতে ব্যর্থতা : ২০২১ সালে দুর্গাপূজা চলাকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের যথাযথ সাজা দিতে ব্যর্থতার অভিযোগে সরকারের সমালোচনা করে আসছেন হিন্দু নেতারা। তবে তারা উল্লেখ করেন, ২০২৩ সালের দুর্গাপূজা সামনে রেখে সরকার অতিরিক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন, ধর্মীয় সম্প্রীতি উৎসাহিত করতে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ আয়োজনের মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। সেবারের উৎসবে কোনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।

সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটক : গত বছরের ২৭ মার্চ রাজধানীর গুলশানে পবিত্র কুরআন শিক্ষার একটি কেন্দ্র থেকে পুলিশ ১৭ জনকে আটক করে। তারা পবিত্র রমজান মাসে নিয়মিত রাত্রিকালীন প্রার্থনায় অংশ নিয়েছিলেন। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, পরে আরো চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের মধ্যে পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন; যারা বন্দী স্বজনদের জন্য খাবার নিয়ে গিয়েছিলেন। নারী-শিশুসহ আটক এসব ব্যক্তির বিষয়ে পুলিশ বলেছে, তারা জামায়াতে ইসলামীর সাথে সংশ্লিষ্ট ও সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনা করছিলেন। এ ঘটনায় দলটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, পুলিশ আটক ব্যক্তিদের কারো কারো বাসা থেকে বিস্ফোরকসামগ্রী উদ্ধারের দাবিও করেছে যা হাস্যকর।
ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে নিয়ন্ত্রণ, সংখ্যালঘুদের প্রতি ‘বৈষম্য’ : জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ হাজার হাজার মসজিদ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আওতায় পরিচালিত হয়। এই ফাউন্ডেশন ধর্মমন্ত্রণালয়ের অধীন। এসব মসজিদের ইমাম ও কর্মীর বেতন হয় সরকারি অর্থায়নে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন এসব মসজিদের দেখভাল করে না; তা করে পরিচালনা কমিটিগুলো। এসব কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকেন ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও প্রশাসকরা। মসজিদের ইমামদের নিয়োগ ও অপসারণ থাকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ। দেশজুড়ে ইমামদের খুতবা প্রদানের বিষয়েও নির্দেশনা দিয়ে থাকে সরকার। ধর্মীয় নেতারা বলেছেন, সব মসজিদের ইমামই সাধারণত সরকারি নীতির সাথে সাংঘর্ষিক খুতবা এড়িয়ে চলেন।

গত অক্টোবরে দুই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয় এবং ঐক্য পরিষদ তাদের সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনায় ৫০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে। এ সদস্যরা কুমিল্লায় একটি বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছিলেন। পরিষদ বলেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের আক্রমণাত্মক মন্তব্য, কুড়িগ্রামে একজন হিন্দু কবির ওপর হামলা ও ২০২১ সালে দুর্গাপূজায় কুমিল্লায় মন্দির ভাঙচুরের ঘটনার প্রতিবাদে তারা ওই বিক্ষোভ আয়োজন করেছিল। গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গ্রেফতার দুজন ও যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুবসংগঠনের সদস্য।
হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যরা তাদের সম্পত্তি ও ভূমির মালিকানা নিয়ে বিবাদ, জোরপূর্বক উচ্ছেদের মামলাগুলো বছর শেষেও অনিষ্পন্ন থাকার কথা বলেছেন। এসব মামলার কোনো কোনোটিতে সরকার সংশ্লিষ্ট রয়েছে। কিছু মানবাধিকারকর্মী বলেছেন, এসব বিবাদ ও জোরপূর্বক উচ্ছেদের ঘটনা ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সরকারের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বৈষম্য, নাকি সরকারের অদক্ষতার ফল, তা নির্ণয় করা প্রায়ই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

 


আরো সংবাদ



premium cement