১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ইসরাইলকে গোপনে অস্ত্র দিচ্ছে ভারত

-

- স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ছাড়া কোনো চুক্তি করবে না হামাস
- মার্কিন কংগ্রেসে নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণ বাতিলের আহ্বান
- নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা মহাবিপর্যয়কর : এরদোগান

ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে প্রায় ৯ মাস ধরে চলা ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় নয়াদিল্লি যদিও কূটনৈতিক সরলপথ অবলম্বনের চেষ্টা করছে বলে প্রকাশ করছে, আলজাজিরা জানায়, বিভিন্ন নথিপত্র থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে ভারত থেকে রকেট, বিস্ফোরক ও অন্যান্য অস্ত্র পাচ্ছে ইসরাইল। গাজায় অব্যাহত ইসরাইলি হামলায় শেষ ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ৬০ জন নিহত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে হামাস আবারো বলেছে, তারা স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ছাড়া কোনো চুক্তিতে রাজি নয়। আলজাজিরা ও টাইমস অব ইসরাইল।
আলজাজিরা জানায়, গত মে মাসে অস্ত্র বহনকারী একটি ইসরাইলগামী জাহাজকে নিজেদের বন্দরে নোঙর ফেলতে দেয়নি স্পেন। মারিয়ান ড্যানিকা নামের একটি জাহাজ ২১ মে দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব কার্টেজেনা বন্দরে নোঙর ফেলার অনুমতি চেয়েছিল। স্পেনের সংবাদমাধ্যম এল পাইস তখন জানিয়েছিল, অস্ত্রের চালান বহন করা জাহাজটি ডেনমার্কের পতাকাবাহী। এতে ২৭ টন বিস্ফোরক উপাদান ছিল। ভারতের চেন্নাই বন্দর থেকে জাহাজটি ইসরাইলের হাইফা বন্দরে যাচ্ছিল।
সে সময় স্পেনের কার্টেজেনা বন্দরে জড়ো হয়েছিলেন অসংখ্য বিক্ষোভকারী। ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে অবস্থান নেয়া সেসব বিক্ষোভকারী দাবি করেছিলেন, যেন জাহাজটিতে তল্লাশি চালানো হয়। কারণ তাদের আশঙ্কা জাহাজটি ইসরাইলে অস্ত্র নিয়ে যাবে। ঠিক সেই সময়ই ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ডানপন্থী সদস্যরা স্পেনের প্রেসিডেন্ট পেদ্রো সান্তেজের কাছে চিঠি পাঠান এবং অনুরোধ জানান, জাহাজটিকে যেন বন্দরে ভিড়তে না দেয়া হয়। কারণ এটি ট্রানজিটের মাধ্যমে ইসরাইলে অস্ত্র নিয়ে যাবে।

স্পেনের সরকার কোনো ব্যবস্থা নেয়ার আগেই সেই জাহাজটি সেখান থেকে সরে যায় এবং এটি সে্লাভেনিয়ার বন্দর কোপারের দিকে অগ্রসর হয়। জাহাজটি স্পেনের বন্দরে না ভেড়ার পর এক রাজনীতিবিদ জানান, তাদের ধারণাই ঠিক ছিল। ওই জাহাজটি অস্ত্র পরিগ্রণ করছিল। জানা যায়, জাহাজটি ভারত থেকে এসেছিল।
ভারত থেকে জাহাজটিতে বিস্ফোরক বোঝাই করা হয়েছিল এবং জাহাজটির ইসরাইলের আসোদ বন্দরে যাওয়ার কথা ছিল। এই বন্দরটি ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে। আলজাজিরা আরো জানিয়েছে, মেরিন ট্র্যাকিং সাইটের তথ্য অনুযায়ী তারা জানতে পেরেছে, গত ২ এপ্রিল চেন্নাইয়ে জাহাজটিতে বিস্ফোরক বোঝাই করা হয় এবং লোহিত সাগর এড়িয়ে এটি আফ্রিকা ঘুরে এরপর যাত্রা করে। কারণ লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হাউছিরা ইসরাইলগামী জাহাজে হামলা চালায়। আলজাজিরা এ সংক্রান্ত কিছু নথি পেয়েছে। সেসব নথির তথ্য অনুযায়ী জাহাজটিতে ছিল ২০ টন রকেট ইঞ্জিন, ১২ দশমিক ৫ টন বিস্ফোরকসহ রকেট, ১৫০০ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য এবং কামানের ৭৪০ কেজি চার্জস এবং প্রপেলান্টস। সমালোচনা ও হামলা থেকে বাঁচতে জাহাজের কর্মীদের বলা হয়েছিল তারা যেন কোনোভাবেই ইসরাইল এবং ইসরাইলের সবচেয়ে বড় অস্ত্র উৎপাদনকারী সংস্থা আইএমআইয়ের নামও উচ্চারণ না করেন। তবে জাহাজটি মালিক জার্মানির এমএলবির এক কর্মকর্তা জাহাজে বিস্ফোরক বোঝাইয়ের দাবি অস্বীকার করেছেন। জাহাজটি ছাড়াও ভারত থেকে আসা ‘মারিয়ানা দানিকা’ নামের আরেকটি জাহাজকে গত ২১ মে স্পেনের বন্দরে ভিড়তে দেয়া হয়নি। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম এল পাইস জানিয়েছিল এই জাহাজটি ভারতের চেন্নাই থেকে ২৭ টন বিস্ফোরক নিয়ে ইসরাইলের হাইফা বন্দরের উদ্দেশে ছেড়ে এসেছিল।

পরে স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসে ম্যানুয়েল আলবারেস একটি সংবাদ সম্মেলনে নিশ্চিত করেছিলেন, সামরিক সরঞ্জাম বহন করায় জাহাজটিকে তাদের বন্দরে ভিড়তে দেয়া হয়নি। আলজাজিরা জানিয়েছে, এসব তথ্য প্রকাশ করছে- ভারত ও ইসরাইলের মধ্যে বেশ ভালো সামরিক সম্পর্ক রয়েছে এবং গাজায় ইসরাইলি বর্বরতার মধ্যেও ইসরাইলকে চুপি চুপি মারণাস্ত্র দিচ্ছে নয়াদিল্লি। যদিও তারা সবসময় বলে থাকে, ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে বিরাজমান বিবাদ শুধু আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব। গত ৬ জুন গাজার নুসেইরাতে জাতিসঙ্ঘের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে বোমা হামলা চালায় ইসরাইল। ওই হামলার পর কুদস নিউজ নেটওয়ার্ক একটি ভিডিও প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় একটি ক্ষেপণাস্ত্রে লেখা রয়েছে এটি ‘ভারতে তৈরি হয়েছে’।
মৃতের সংখ্যা বাড়ছে : গাজায় ইসরাইলি হামলায় শেষ ২৪ ঘণ্টায় ৬০ জন নিহত এবং ১৪০ জন আহত হয়েছে, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছাতে পারছে না এমন জায়গায় আরো বেশি হতাহতরা এখনো আটকা পড়ে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় মোট মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৩৭,৭১৮ এ দাঁড়িয়েছে আর আহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬,৩৭৭ জনে।
আলজাজিরা আরবির খবর অনুসারে, ইসরাইলি আর্টিলারি স্ট্রাইক নুসিরাত শরণার্থী শিবিরের একটি আবাসিক অ্যাপার্টমেন্টে আঘাত হানায় কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছে। অপর দিকে পূর্ব খান ইউনুসের খুজাআ শহরে আরেকটি হামলায় আরো দুইজন নিহত হয়েছে। অন্য দিকে গাজার বেত লাহিয়ায় একটি আবাসিক ভবনে ইসরাইলি বিমান হামলায় অন্তত ১৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। কয়েক ডজন আহতকে চিকিৎসার জন্য গাজা শহরের আল-আহলি আরব হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। যে বাড়িটিকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল তার আশপাশে বোমা হামলায় বেসামরিক অবকাঠামো এবং বেশ কিছু বাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিভিল ডিফেন্স বলেছে, এলাকাটিতে ইসরাইলি ধ্বংসকাণ্ড কল্পনাকেও হার মানিয়েছে।

স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ছাড়া চুক্তি নয় : এ দিকে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ছাড়া হামাস কোনো চুক্তিতে যাবে না বলে আবারো জানিয়ে দিয়েছে দলটির রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসরাইল হানিয়া। মঙ্গলবার ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের এই নেতা এ কথা জানান। টাইমস অব ইসরাইলের খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইলি হামলায় হামাস প্রধানের বোন ও অন্যান্য আত্মীয় নিহত হয়। এরপর তিনি বলেন, ইসরাইল যদি মনে করে যে আমার পরিবারকে লক্ষ্যবস্তু করা হলে হয়তো হামাসের অবস্থান পরিবর্তন হতে পারে, তাহলে তারা ভ্রান্তিতে রয়েছে। কারণ, গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ছাড়া কোনো চুক্তিতেই যাবে না হামাস। সূত্রটি আরো জানিয়েছে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু রোববার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ইসরাইল স্থায়ী যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবে না। এর পরই হামাস প্রধান এ কথা বললেন। নেতানিয়াহু আরো বলেন, আমরা একটি আংশিক চুক্তির জন্য প্রস্তুত ছিলাম। যেন আমাদের কিছু বন্দীকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আমরা হামাসকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা ছাড়া যুদ্ধ বন্ধ করব না।
দুর্ভিক্ষে আরো ৪ শিশুর মৃত্যু : অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘের এক রিপোর্টে জানা গেছে, ইসরাইলের চাপিয়ে দেয়া দুর্ভিক্ষে গাজায় আরো চার শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ডব্লিউএফপির প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হুসাইন বলেন, গাজার অধিবাসীদের রক্ষায় বিশ্বকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে, যেখানে ২৩ লক্ষাধিক বাসিন্দা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। তিনি ২০১১ সালে সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের উদাহরণ টেনে বলেন, সে সময় দেশটিতে ২ লাখ ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। যার অর্ধেকই মারা যায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা দেয়ার আগেই। মঙ্গলবার হুসাইন সাংবাদিকদের বলেন, গাজায় যে শুধু খাবারের সঙ্কট, তা নয়। এখানে পরিষ্কার পানি, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, স্বাস্থ্যসেবা এবং ওষুধেরও চরম সঙ্কট রয়েছে। তবে গাজার উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ এড়ানো গেছে। সেখানে বাইরে থেকে ত্রাণ সহায়তা ঢুকতে পারছে। এ ছাড়া বাণিজ্যিক সরবরাহও প্রবেশ করতে পারছে। অপর দিকে দক্ষিণাঞ্চলে ইসরাইলি সেনাদের হামলা অব্যাহত থাকায় সেখানে কোনো প্রকার সহায়তা বা ত্রাণ ঢুকতে পারছে না। এমনকি মিসর থেকে প্রবেশের প্রধান পথ রাফাহ ক্রসিংও বন্ধ আছে।

নেতানিয়াহুকে বিরত রাখার আহ্বান : ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক, সাবেক মোসাদ প্রধান তামির পার্দো এবং আরো চারজন সিনিয়র রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নিউইয়র্ক টাইমসে একটি যৌথ চিঠি প্রকাশ করেছেন, যাতে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে আগামী ২৪ জুলাই মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য কংগ্রেসের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘কংগ্রেস একটি ভয়ানক ভুল করেছে’। তারা বলেন, ‘ওয়াশিংটনে নেতানিয়াহুর উপস্থিতি ইসরাইল রাষ্ট্র এবং তার নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করবে না’।
নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা বিপর্যয়কর : পশ্চিমা শক্তির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে লেবাননে আক্রমণ করার এবং একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের উসকানির পরিকল্পনার জন্য তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে অভিযুক্ত করেছেন। এরদোগান তার ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একেপি) আইনপ্রণেতাদের এক সভায় বলেছেন, ‘ইসরাইল এখন লেবাননের দিকে নজর দিয়েছে এবং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পর্দার আড়ালে থাকা পশ্চিমা শক্তিগুলো ইসরাইলের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে, এমনকি তাদের সমর্থন করছে।’ তিনি বলেন, এই পরিকল্পনা ‘একটি মহাবিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে’।

 


আরো সংবাদ



premium cement