০৫ জুলাই ২০২৪, ২১ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জিলহজ ১৪৪৫
`
জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে সিপিডি

২০২৫ সালে পিডিবির লোকসান হবে ১৮ হাজার কোটি টাকা

বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে রাজধানীর ব্র্যাক মিলনায়তনে সিপিডির আলোচনা সভা : নয়া দিগন্ত -

- বাজেটে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাত নিয়ে সরকারের দ্বিমুখী নীতি : সিপিডি
- বিদ্যুৎ খাতের বিশেষ আইনের বিধান বাতিল করতে হবে : বিশেষজ্ঞরা
- বিনিয়োগ আসছে না নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুতের অভাবে : এ কে আজাদ

বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস বিদ্যুৎ না থাকায় দেশে বিনিয়োগ আসছে না। প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ২২ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে কমেছে সরকারের রাজস্ব আয় বলে মন্তব্য করেছেন সংসদ সদস্য ও ব্যবসায়ী নেতা এ কে আজাদ। আর সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, সরকারের ভুলনীতির কারণে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান ২০২৫ সাল নাগাদ ১৯৬ শতাংশ বেড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং সরকারের ভর্তুকি দেয়ার পরও এই লোকসান হবে। বাজেটে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাত নিয়ে সরকার দ্বিমুখীনীতি গ্রহণ করেছে। বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের বরাদ্দ কমিয়ে এবং বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সরকার আইএমএফের প্রেসক্রিপশন ফলো করছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছে সিপিডি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু জোড়াতালি দিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এজন্য একের পর এক মাস্টারপ্ল্যান ফেল করছে। বিদ্যুৎ খাতের বিশেষ আইনের বিধান বাতিল করতে হবে।
রাজধানীর মহাখালীতে ব্র্যাক ইন সেন্টারে গতকাল সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) আয়োজিত বাজেটে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে বাজেট বরাদ্দ নিয়ে এক আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। বক্তব্য রাখেন বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম তামিম, বাংলাদেশ পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের রেক্টর মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন, ভোক্তা অধিকার সংগঠনের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা, সাংবাদিক মোল্লাহ আমজাদ প্রমুখ।
এ কে আজাদ বলেন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাসের কথা বলে দাম বাড়ান হলো। কিন্তু লোডশেডিং কমেনি। দিনে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ডিজেল দিয়ে, সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস এনে কারখানা চালাতে হচ্ছে। এতে খরচ বেড়ে গেছে। অনেক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। তিনি বলেন, সামগ্রিকভাবে সরকারের রাজস্ব আয় কমেছে। গতবার এনবিআর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এবার চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সেটা পূরণ করা সম্ভব না। তিনি বলেন, এনবিআর চেয়ারম্যান নিজে এটা স্বীকার করেছেন। এভাবে চললে বিদ্যুৎ খাতে বাজেটে যে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে সেটা আদৌ সরকার দিতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আজাদ বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি তথা দেশের উন্নয়নে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। তিনি বলেন, বাজেটের অধিকাংশ ব্যয় অনুন্নয়ন খাতে। সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বিদেশ ভ্রমণের জন্য যে খরচ সেখানে তো হাত দেয়া যাবে না। ইউএনও, ডিসিদের জন্য হাজার কোটি টাকা খরচ করে দামি গাড়ি কেনা হচ্ছে। যেখানে ভারতের মন্ত্রীরা নিজেদের দেশের গাড়িতে চড়েন। তিনি বলেন, ভারতের জমি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাবসিডাইজ। পাঁচ বছরের জন্য কর্মীদের বেতন দেয় সরকার। বিনিয়োগ তো সে দেশেই হবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার মাত্র চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নিয়ে ২০০৯ সালে যাত্রা শুরু করে। এখন উৎপাদন ক্ষমতা ২৮ হাজার মেগাওয়াট পার হয়েছে। এতে জিডিপি বেড়েছে। মধ্যআয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হবে। কাজ করতে গেলে কিছু ভুলত্রুটি হবে তা সংশোধন হচ্ছে আরো হবে।
মূল প্রবন্ধ তুলে ধরে সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বরাদ্দ টেকসই জ্বালানি এবং জ্বালানি রূপান্তরের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, জ্বালানি খাতের রূপান্তর ও টেকসই জ্বালানি খাত নিশ্চিতে গ্যাস এবং বিদ্যুতের উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণে যৌক্তিক প্রাধিকার পুনর্নির্ধারণ করে বাজেটের বরাদ্দে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা উচিত। সরকার আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা নিয়েছে এটা উচ্চাভিলাসী। তিনি বলেন, দেশে এখন বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা ৩০ হাজার ৭৩৮ মেগাওয়াট। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে ১৪ হাজার মেগাওয়াট। ব্যবহার করা না গেলেও কেন উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে?
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, লোডশেডিং কমানো, বিদ্যুতের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা, এ খাতে ভর্তুকি কমানো ও জ্বালানির জন্য আমদানি নির্ভরতা কমাতে অভ্যন্তরীণ গ্যাস আহরণের বিকল্প না থাকলেও জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের উন্নয়ন ব্যয় প্রস্তাবিত বাজেটে কমানো হয়েছে। এ বরাদ্দ দিয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬ গ্যাসকূপ অনুসন্ধানের প্রতিশ্রুতি পূরণ সম্ভব না। আমরা মনে করেছিলাম সরকার জ্বালানি আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। তা নয়, ব্যয়বহুল হলেও সরকার জ্বালানি আমদানি করছে।
গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে বিদ্যুতের ভর্তুকি কমানোর উদ্যোগকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে সিপিডির এই গবেষণা পরিচালক বলেন, বিদ্যুতে ভর্তুকি কমাতে হবে। তবে দাম বাড়িয়ে নয়, বরং উৎপাদনে দক্ষতা নিশ্চিতের মাধ্যমে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে গুরুত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছে সিপিডি।
তিনি বলেন, আইএমএফের শর্ত শুনে সরকার বিদ্যুতের ভর্তুকি কমানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা এ টেকসই সমাধান হবে না এবং এ খাতের সমস্যার সমাধান হবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়ানোর জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে বাজেট কমানোর জন্য তা ফলপ্রসূ হবে না। এর ফলে সরকার বিদ্যুতের ভতর্অকি কমাতে এক দিকে দাম বাড়াবে। এতে এ খাতের সঙ্কট ও অব্যবস্থাপনা থেকেই যাবে। তিনি বিদ্যুতের জন্য সরকারের বিশেষ অ্যাক্ট বাতিল করার দাবি জানিয়ে বলেন, এই অ্যাক্টের কারণে এখনো প্রতিযোগিতামূলক উৎপাদনে আসতে পারছে না বিদ্যুতের বিভিন্ন কোম্পানি।থ
সিপিডির সুপারিশ হলো, বাজেটে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ট্যাক্স হলিডে পাঁচ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছরে উন্নীত করা, ছোট আকারের সৌরভিত্তিক প্রকল্পগুলোতে শতভাগ শুল্ক মওকুফ এবং সৌর বিদ্যুৎ সম্পর্কিত উপকরণে করের হার কমানো।
অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) পুরোপুরি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। স্বয়ংক্রিয়ভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের নামে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি সমন্বয় করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, বিদেশ ভ্রমণ, ঘুষের টাকা, কমিশন সবই জনগণের টাকা থেকে মেটানো হচ্ছে। এরপরও জনগণের কথা বলতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের কথা শোনা হচ্ছে না। ফলে এই বাজেট এলেই কী আর গেলেই কী, তাতে কারো কিছু যায়-আসে না। বরং বাজেটে যত বেশি বরাদ্দ বাড়বে, তত বেশি লুট হবে। তিনি বলেন, শতভাগ ব্যর্থতা নিয়ে সরকার কি করে ঘুমায়? দিনের পর দিন উন্নয়নের গান গায় কিভাবে? ২৯ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে, এতে কত ইউনিট বিদ্যুৎ বাড়বে? উল্টো লুণ্ঠন ব্যয় বাড়বে। তিনি বলেন, বিপিসির দুর্নীতি প্রমাণ হলেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সরকার বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে বিশেষ ক্ষমতা আইনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ কিনছে। আবার কমিশনকে পাশ কাটিয়ে গণশুনানি ছাড়াই নির্বাহী আদেশে বিদ্যুৎ জ্বালানির দাম বৃদ্ধি করছে।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমলেও দেশে সুবিধা মিলছে না কারণ ডলারের দাম বেশি। আজকে প্রাইমারি এনার্জি থাকলে বিদ্যুৎ খাতের যেসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে তা হতো না।
অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, আমাদের সমস্যা হলো আমরা অ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করছি। পুরনো ছাদ পরিবর্তন না করে শুধু ছাদের ফুটো বন্ধ করছি। এতে কাজ হবে না। তিনি বলেন, সবার আগে একটি আধুনিক জ্বালানি নীতিমালা প্রয়োজন। তা না করে শুধু জোড়াতালি দিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এজন্য একের পর এক মাস্টারপ্ল্যান ফেল করছে। বিদ্যুৎ খাতের বিশেষ আইনের বিধান বাতিল করতে হবে। টেন্ডার ছাড়া প্রকল্প নেয়ায় প্রতিযোগিতামূলক দাম পাওয়া যাচ্ছে না। এখনো ১২-১৩ টাকায় সৌর বিদ্যুতের চুক্তি হচ্ছে। যেটা ৮-৯ টাকায় করা সম্ভব দরপ্রক্রিয়ায় গেলে।
অধ্যাপিকা মোশাহিদা সুলতানা বলেন, আমরা বছরের পর বছর বিদেশী পরামর্শকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে এলএনজি আমদানি করছি। বিষয়টি এখন আমাদের ভাবতে হবে। আমাদের রাষ্ট্রের একটা আদর্শিক বড় গাইড লাইন এ ব্যাপারে থাকা দরকার।


আরো সংবাদ



premium cement