গুয়ানতানামোর মতো ফিলিস্তিনি বন্দী-নির্যাতন চালাচ্ছে ইসরাইল
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২৪ জুন ২০২৪, ০০:০৫
‘মর্ত্যরে নরক’ হিসেবে কুখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ানতানামো কারাগারের পৈশাচিক পদ্ধতিই কারাবন্দী ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রয়োগ করছে ইসরাইল। এ কথা জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। তাদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের শেখানো বর্বর কায়দায় বহুদিন ধরে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে ইসরাইল। তা ছাড়া গাজায় নির্বিচারে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। গাজা শহরের ইউএনআরডব্লিউএ সহায়তা কেন্দ্র লক্ষ্য করে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় অন্তত চারজন নিহত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গাজা যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট। আলজাজিরা ও রয়টার্স।
গতকাল রোববার আলজাজিরার খবরে বলা হয়, মার্কিন কারাগার গুয়ানতানামোর সাবেক ভুক্তভোগীরা যারা বন্দিদশায় দুর্ব্যবহারের শিকার হয়েছেন, তারা আলজাজিরাকে জানান, ইসরাইল ‘মার্কিন ধাঁচের’ নির্যাতন পদ্ধতি ব্যবহার করছে। ফিলিস্তিনি বন্দীদের প্রতি ইসরাইলি নির্যাতন একই নিদর্শন অনুসরণ করে এবং একই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি।
ইসরাইলি কারাগারে বন্দীদের সমর্থনে ২০২৪ সালের ৩০ মে পশ্চিম তীরের নাবলুসে একটি বিক্ষোভ হয়। সে সময় বিক্ষোভ চলাকালে ইসরাইলি বাহিনীদের আটক করা কিছু ফিলিস্তিনি বন্দীকে চিত্রিত করে একটি পোস্টার ধারণ করেন এক ফিলিস্তিনি নারী। গুয়ানতানামোর সাবকে বন্দী আসাদুল্লাহ হারুন যখন ইসরাইলি কারাগারে ফিলিস্তিনিদের বন্দী করার সে ছবি দেখেন, তখন তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারের স্মৃতিচারণ করেন। তার নিজের সাথে হওয়া দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের মিল খুঁজে পান।
তিনি বলেন, ‘এটি নিপীড়নের সবচেয়ে খারাপ রূপ। যখন আমাকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন আমি কোনোভাবেই নিজেকে রক্ষা করতে পারিনি। আমি মনে করি, আমেরিকানরা গুয়ানতানামো কারাগারে যা করেছে, ইসরাইলিরাও সে প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন করছে।’ আসাদুল্লাহ হারুন ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর কিউবার কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগারে বন্দী ছিলেন। কোনো অভিযোগ ছাড়াই তাকে বন্দী রাখা হয়েছিল।
তিনি বলেন, ‘আমাকে যখন গ্রেফতার করা হয়েছিল, তখন থেকেই আমাকে অমানসিক মারধর করা হতো। আমি বসারও সুযোগ পেতাম না। সবসময় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। অনিদ্রা আর অনিশ্চয়তার সাথে বেঁচে ছিলাম। আমাকে বেশ কয়েক দিন ধরে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। সেখানে অনেক বন্দীকে কুকুর কামড়াত। আমাদের খুব কম চিকিৎসাসেবা দেয়া হতো। কোনো নিরাপত্তা ছিল না।’
তিনি আরো বলেন, ‘শারীরিক নির্যাতন সত্যিই খারাপ ছিল কিন্তু সবচেয়ে খারাপ ছিল বিভিন্ন ধরনের মানসিক নির্যাতন। আমি বিশ্বাস করি ফিলিস্তিন, গুয়ানতানামো, বাগরাম ও আবু গারিবের বন্দীদের নির্যাতনে খুব একটা পার্থক্য নেই।’ গাজায় বন্দী ও সাবেক বন্দিবিষয়ক কমিশনের মতে, গত বছরের অক্টোবরে গাজায় ইসরাইল তার মারাত্মক যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে প্রায় ৫৪ জন ফিলিস্তিনি ইসরাইলি কারাগারে নিহত হয়েছেন।
ফিলিস্তিনে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কার্যালয় বলেছে, তারা কয়েক মাস ধরে ফিলিস্তিনিদের গণ আটক, বন্দীদের সাথে দুর্ব্যবহার এবং জোরপূর্বক গুম করার একাধিক খবর পেয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিলের শেষের দিকে, ইসরাইলি সংবাদপত্র হারেৎজ ফিলিস্তিনি বন্দীদের নির্যাতনের বিবরণ প্রকাশ করে। এক খবরে দেখা যায়, কারাগারে বন্দীদের নিয়মিত মারধর করা হতো, কুকুর দিয়ে আক্রমণ করানো হতো, ইসরাইলি পতাকাকে চুম্বন করতে বাধ্য করা হতো, মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-কে অভিশাপ দিতে বাধ্য করা হতো, পানি থেকে বঞ্চিত করা হতো। অপর্যাপ্ত খাবার ও কথায় কথায় উলঙ্গ করা ছিল নিয়মিত ঘটনা।
ইসরাইলি কারাগারে চালানো বেশির ভাগ দুর্ব্যবহার সৈন্যদের দ্বারা চিত্রিত করা হয়েছে। এটি কুখ্যাত আবু গারিব কারাগারের মতো মার্কিন কারাগারে ইরাকি ও আফগান বন্দীদের সাথে আচরণের দৃঢ় প্রতিধ্বনি রয়েছে, যেখানে মার্কিন সৈন্যরা ২০০৩ সালে অপমানজনক অবস্থানে বন্দীদের পাশাপাশি নিজেদের ছবি তোলে।
ইসরাইলে নির্যাতনের বিরুদ্ধে পাবলিক কমিটি (পিসিএটিআই) এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো ‘ইসরাইলের কারাগারের ফিলিস্তিনি বন্দীদের প্রতি পদ্ধতিগত অপব্যবহার, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার’ বন্ধ করতে জরুরি পদক্ষেপের জন্য নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিবেদককে আহ্বান জানিয়েছে।
আদালাহ, হ্যামোকেড, ফিজিশিয়ান ফর হিউম্যান রাইটস ইসরাইল এবং পিসিএটিআইর প্রকাশিত রিপোর্টে একই চিত্র দেখা যায়। ইসরাইলের সাতটি ভিন্ন কারাগার এবং সেসব কারাগারে আটক ফিলিস্তিনিদের ওপর পদ্ধতিগত সহিংসতা, নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার পরিচালনার বর্ণনা উঠে আসে এসব রিপোর্টে। আইনজীবীরা বলছেন, ফিলিস্তিনি বন্দীদের প্রতি ইসরাইলি আচরণ ‘মার্কিন-স্টাইলের’ অপব্যবহার ও নির্যাতনের সব বৈশিষ্ট্য বহন করে।
মানবাধিকার আইনজীবী ক্লাইভ স্ট্যাফোর্ড স্মিথ বলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত বিগত ২০ বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে একটি খুব খারাপ উদাহরণ দিয়েছে যে কিভাবে বন্দীদের সাথে আচরণ করা উচিত। ক্লাইভ স্ট্যাফোর্ড স্মিথ গুয়ানতানামো বে কারাগারে বন্দীদের প্রবেশাধিকার দেয়া প্রথম আইনজীবীদের একজন ছিলেন। হারুনসহ অনেক ক্লায়েন্টদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।
উল্লেখ্য, গুয়ানতানামো কারাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি কারাগার, যা বন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত। এই কারাগারে বন্দীদের বিনা বিচারে আটক রাখা হয় এবং তথ্য আদায়ের লক্ষ্য নিয়ে বন্দীদের ওপর যৌন অত্যাচার, ‘ওয়াটার বোর্ডিং’সহ বিবিধ আইনবহির্ভূত উপায়ে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের প্রকার ও মাত্রা এতই বেশি যে এই কারাগারকে ‘মর্ত্যরে নরক’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই কারাগারটিকে অব্যাহতভাবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতে থাকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে একে মার্কিনিদের ‘লজ্জা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই কারাগারটি ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের বাইরে কিউবার দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ক্যারিবীয় সাগরে এর অবস্থান।
ইউএনআরডব্লিউএতে হামলা : এ দিকে ইসরাইলি বাহিনী গাজা শহরের ইউএনআরডব্লিউএ সহায়তা কেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত চারজন নিহত হয়। বিধ্বস্ত ছিটমহলজুড়ে ইসরাইলি হামলায় শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার এক দিন পর অবিরাম হামলা অব্যাহত রয়েছে। অন্য দিকে মধ্য গাজার বুরেজ ক্যাম্পে একটি বাড়ি লক্ষ্য করে ইসরাইলি হামলায় একজন ফিলিস্তিনি মহিলা নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে ইসরাইলি বাহিনী ৩৭ হাজার ৫৯৮ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। বিধ্বংসী সামরিক অভিযানের আট মাসেরও বেশি সময়ে আরো ৮৬ হাজার ৩২ জন আহত হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় যোগ করেছে। অন্য দিকে লেবাননের হিজবুল্লাহ গ্রুপ উত্তর ইসরাইলের আয়েলেট হাশহারে সেনাবাহিনীর ৯১তম ডিভিশনের সদর দফতরে ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে। এতে বলা হয়, হামলায় তারা মৃত ও আহত হয়েছে।
৬৯ শতাংশ স্কুল আশ্রয়স্থল ধ্বংস : ইসরাইলি হামলায় গাজায় যেসব স্কুল আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে তার প্রায় ৬৯ ভাগ ধ্বংস করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা জাতিসঙ্ঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ। সংস্থাটি জানিয়েছে, বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা এসব স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু সেগুলোকে সরাসরি আক্রমণ করে অথবা অন্যভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। গাজায় বাস্তুচ্যুতদের সহায়তাকারী প্রধান এ সংস্থাটি জানিয়েছে, এসব স্কুলে বারবার হামলা চালানো হয়েছে। এতে নিহত হয়েছে সেগুলোতে আশ্রয় নেয়া অন্তত ৫০০ মানুষ। এক এক্স পোস্টে সংস্থাটি বলেছে, মানবিক আইনের এই নির্লজ্জ অবহেলা বন্ধ করতে হবে। এখন যুদ্ধবিরতি জরুরি।’
ইসরাইলের যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত : ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট জোর দিয়ে বলেছেন, ইসরাইলের অবশ্যই গাজা যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত। তিনি তার দেশের সরকারের যুদ্ধ কৌশলের সমালোচনা করে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। ইসরাইলের সংবাদপত্র হাইওমকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ওলমার্ট বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইসরাইলকে গাজা যুদ্ধের মাধ্যমে পুরো বিশ্বের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এ সরকার বিগত মাসগুলোতে বিশ্বের সমর্থন হারিয়েছে। আগে সবাই আমাদের সমর্থন করত, কিন্তু গাজায় ধ্বংসকাণ্ড চালানোর পর সবাই আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।’ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইসরাইলি জনগণেরও আস্থা হারিয়েছেন বলেও মন্তব্য করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ওলমার্ট। তিনি বলেন, নেতানিয়াহু দেশের উত্তরাংশকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছেন এবং যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। ওলমার্ট বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই একটি চুক্তিতে পৌঁছা উচিত, যাতে আমাদের যুদ্ধবন্দীদের ফিরিয়ে আনা যায় এবং আন্তর্জাতিক বাহিনী গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করবে এবং হামাসের ক্ষমতায় ফেরা প্রতিহত করবে।’
আরেক ইসরাইলি সেনা নিহত : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় হামাসের সাথে লড়াইয়ে শনিবার আরো একজন ইসরাইলি সেনা নিহত হয়েছেন। ইসরাইলের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে। মালকিয়া গ্রোস নামে ২৫ বছর বয়সী ওই সেনা ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ৯২১২ ব্যাটালিয়নের আয়রন ফিস্ট নামে ২০৫ নম্বর ব্রিগেডে কর্মরত ছিলেন। তাকে গাজার রাফায় নিযুক্ত করা হয়। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে স্থল অভিযানের অংশ নিতে ইসরাইলি বাহিনীর সাথে শনিবার মালকিয়া গ্রোস গাজার দক্ষিণাঞ্চলে গিয়ে প্রাণ হারান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা