১৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পানির হিস্যা না পেলে ভারতকে দেয়া সুবিধা পুনর্বিবেচনা করুন

ওয়েবিনারে বিশেষজ্ঞদের আহ্বান
-

‘বাংলাদেশ-ভারত পানি বণ্টন : অভিজ্ঞতা, শঙ্কা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এক ওয়েবিনারে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ যদি তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পায় তাহলে ভারতকে ট্রানজিটসহ যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে, সেগুলো পুনর্বিবেচনা করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। পানিকে বাংলাদেশের কূটনীতির কেন্দ্রে নিয়ে আসারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এই ওয়েবিনারে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, বাংলাদেশের জন্য পানির বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার উপায় নেই। এটা আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। পানি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার সাথে জড়িত।
পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত এতে বলেন, ভারতের ওপর নির্ভরশীলতা যত বাড়বে, রাজনৈতিক দরকষাকষিতে বাংলাদেশের অবস্থান ততো দুর্বল হবে।
এতে পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অনীহার কারণেই তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না বলে মন্তব্য করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রফেসর ড. আসিফ নজরুল।
গতকাল রোববার ‘বাংলাদেশ-ভারত পানি বণ্টন অভিজ্ঞতা, আশঙ্কা ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক এই ওয়েবিনারের আয়োজন করা হয়। এতে বক্তব্য রাখেন, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত, কমনওয়েলথ ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের ভূতত্ত্ব ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. মো: খালেকুজ্জামান, ওয়াটার্সকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর আলী রিয়াজ এতে সমাপনী বক্তব্য রাখেন। সাংবাদিক মনির হায়দার অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, তিস্তার বাংলাদেশ অংশের পানি সংরক্ষণের জন্য ভারতের প্রস্তাবের বিষয়ে আমি লজ্জিত । ভারতের টেকনিক্যাল কমিটি বাংলাদেশে এসে এ বিষয়ে কথাবার্তা বলবে মর্মে বলা হচ্ছে। কিন্তু, বাংলাদেশে এ ধরনের পানি সংরক্ষণের সুযোগ নেই, এর ফলে বরং পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা আরো বিপর্যয়কর হবে।
ড. আইনুন নিশাত বলেন, পানির ন্যায্য বণ্টনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির বিষয়ে শুধু কারিগরি বা কূটনৈতিক আলোচনা করে সুফল মিলবে না। এ জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি। কূটনীতিক দিকও গুরুত্বপূর্ণ। তারা দুই দেশের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। বিভিন্ন তথ্যের আদান-প্রদান করে। তাদের তথ্য তৈরি করার ক্ষমতা নেই। তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় কথা এ সিদ্ধান্ত হতে হবে রাজনৈতিকভাবে। ১৯৭৪, ১৯৭৭, ১৯৯৬ সালের যে চুক্তিগুলো হয়েছে সবগুলোই রাজনৈতিকভাবে করা হয়েছে। এখন আমাদের পলিটিক্যাল এপ্রোচের ক্ষেত্র তৈরি করে দেবেন কারিগরি বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে তারা তো খোলাখুলি কথা বলতে পারেন না।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে সবচেয়ে দুর্বল ডিপার্টমেন্ট হচ্ছে পানি মন্ত্রণালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড। তাদের কোনো কথাবার্তা শুনিই না। তারা সবসময় ঝুঁকিতে থাকেন এ বুঝি কোনো একটা ভুল হয়ে গেলো। তাদেরকে বকাবকি করা হবে।
ড. আইনুন নিশাত বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে ১৯৭৭ সালে। ওই চুক্তিটায় আমরা আমাদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। তার আগে ১৯৭৪ সালের ১৮ এপ্রিল নিজেরা নিজেদের পায়ে কুড়াল মেরেছি। আবার ১৯৯৬ সালের গঙ্গা চুক্তিটাও আমরা ৩০ বছরের জন্য করেছি। যদিও সেটিতে আমি নিজেও যুক্ত ছিলাম। তাই নতুন করে গঙ্গা চুক্তিতে যেন সেই সময়ের বাধা না থাকে। যৌথ নদী কমিশনকে প্রায় মৃত একটি কর্তৃপক্ষ হিসেবে আখ্যায়িত করেন পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত।
অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, জনগণের ম্যান্ডেট না থাকায় পানির ন্যায্যতা নিয়ে সোচ্চার নয় সরকার। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য চীন, ভুটান ও নেপালের মতো তৃতীয় পক্ষকে অন্তর্ভুক্তি থাকতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ভারত সরকারের কারণেই তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। যদিও বলা হয় যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অনিচ্ছার কারণে এই চুক্তি আটকে আছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ভারতে স্টেট লেভেলের এ ধরনের চুক্তিগুলো কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ভারতের সংবিধান দেখলে দেখতে পাবেন যে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পূর্ণভাবে ফেডারেল সরকারের আওতাভুক্ত। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির আপত্তি থাকলে ভারত সরকার চুক্তি করতে পারবে না এটা যদি কেউ মনে করি তাহলে আমি বলবো আমাদের ফেডারেল গভর্নমেন্ট সম্পর্কে ধারণার অভাব আছে। মূলত চুক্তিটা হচ্ছে না ভারত সরকারের কারণে, কোনো রাজ্যের সরকারের জন্য না।
আসিফ নজরুল বলেন, দুই দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও তিস্তা চুক্তির মতো ইস্যুকে মূল এজেন্ডায় রাখা হয় না। গঙ্গা নদী থেকেও বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাশিত পানি পায়নি। এ প্রসঙ্গে যৌথ নদী কমিশনের সাম্প্রতিক ডেটাবেজগুলোকে ‘অবিশ্বাস্য ও প্রশ্নবিদ্ধ’ বলে আখ্যায়িত করেন তিনি। ভারতের নদী-সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বেগ প্রকাশের আহ্বান জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই শিক্ষক।
পানি-বিশেষজ্ঞ ডক্টর মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান বলেন, পানিকে আমাদের ডিপ্লোম্যাসির কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে। আমরা যদি নায্য পানি না পাই, তাহলে ট্রানজিটসহ ভারতকে যেসব সুবিধা দেয়া হচ্ছে সেগুলো বন্ধ রাখতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement