১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পুঁজিবাজার ছেড়েছেন লাখের বেশি বিনিয়োগকারী

-

- বাজারমূলধন উধাও ২ লাখ ৪১ হাজার ২১৪ কোটি টাকা
- নিষ্ক্রিয় বিও হিসাব ৭৬ হাজার ৮৪৬টি
- ৯০ হাজার ৯৩৬টি বিও-তে কোনো শেয়ার নেই

চলতি বছরের শুরুতেই পুঁজিবাজারের মন্দা অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকে। মন্দার কারণে বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছাড়ছে। গত মার্চ থেকে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়। অব্যাহত দরপতনে বিনিয়োগকারীরা চরম আতঙ্কে থাকে। বিনিয়োগকৃত অর্থ ফিরে পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে একটা অস্থিরতা দেখা দেয়। প্রতি দিনই বাজারমূলধন থেকে তারল্য উধাও হয়ে যাচ্ছে। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দুই লাখ ৪১ হাজার ২১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা বাজারমূলধন বের হয়ে গেছে। ফলে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রায় ছয় মাসে ব্যালেন্স শূন্য বিও হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে এক লাখ এক হাজার ৯৯২টি। পৌনে এক লাখের বেশি বিও হিসাব আর ব্যবহৃত হচ্ছে না। শেয়ার শূন্য বিও বেড়েছে ৯০ হাজারেরও বেশি। ব্যালেন্স শূন্য বিও হিসাব এখন তিন লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৩টি বলে সেন্ট্রাল ডিপজিটরি বাংলাদেশের (সিডিবিএল) হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে। অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, তারা মুনাফা দূরের কথা বিনিয়োগ তুলে নেবার জন্য কম লাভেই শেয়ার বিক্রি করে দেয়। ধারবাহিক মন্দাবস্থা, বাজার ঠিক করতে সরকারি উদ্যোগহীনতা ও আস্থাহীনতায় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছেড়েছেন। দেশী বিনিয়োগকারী চলে গেলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাজারে আসবে না।

এ দিকে, গত ছয় মাসে বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ তিন মাসে শেয়ার বিক্রির চাপে কাহিল ছিল পুঁজিবাজার। বাজারে বিক্রেতাদের চাপ ছিল গড়ে ৬০ শতাংশের বেশি। আর গত দুই মাসে বিক্রির চাপ গড়ে ৭০ শতাংশের ওপরে ছিল। কোনো কোনো দিন শেয়ার বিক্রির পরিমাণ ঢাকা স্টকে ৩০ কোটির বেশি ছিল। এই শেয়ারগুলো বিক্রির পর অনেকেই বাজার পর্যবেক্ষণ করেছেন। কিন্তু ফিরেননি পুনরায় বাজারে। ফলে সঙ্কট দেখা দিয়েছে তারল্যের। কমেছে বেচাকেনা।

সিডিবিএলের পরিসংখ্যানের তথ্য বলছে, বর্তমানে পরিচালনযোগ্য বিও হিসাব হলো ১৭ লাখ ৮৮ হাজার ২৪৪টি। উল্লেখ্য, পুঁজিবাজারে শেয়ার বেচাকেনার জন্য যে হিসাবটি ব্যবহার করা হয় তাকে বলা হয় বেনিফিশিয়ারি ওনার হিসাব বা বিও হিসাব। গত প্রায় ছয় মাসে ব্যালেন্সহীন বিও বেড়েছে এক লাখ এক হাজার ৯৯২টি। ব্যালেন্স শূন্য বিও হিসাব প্রথম জানুয়ারিতে ছিল দুই লাখ ৯৬ হাজার ৯০১টি। বাজারের খারাপ পরিস্থিতির কারণে আতঙ্কে শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ায় এখন সেই অঙ্ক তিন লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৩টিতে পৌঁছেছে। ওই পরিমাণ বিওতে কোনো ব্যালেন্স নেই। বিনিয়োগকারী সব খালি করে অর্থ নিয়ে গেছেন।

আর প্রথম জানুয়ারিতে শেয়ার থাকা বিও হিসাবের সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ চার হাজার ২৮৯টি। ২০ জুন এই সংখ্যা কমে এখন ১৩ লাখ ১৩ হাজার ৩৫৩টিতে নেমেছে। ফলে শেয়ার শূন্য বিও বেড়েছে ৯০ হাজার ৯৩৬টি।

ডিএসই ও সিএসইর তথ্য হচ্ছে, অব্যাহত মন্দা চরমে যাবার কারণে দুই বাজার থেকেই মূলধন চলে গছে ২ লাখ ৪১ হাজার ২১৫ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম জানুয়ারিতে ঢাকা স্টকের (ডিএসইর) বাজারমূলধন ছিল সাত লাখ ৮০ হাজার ৮২৩ কোটি ৪২ লাখ টাকা। আর গত ২০ জুন এই বাজার তারল্য কমে এখন ছয় লাখ ৪৩ হাজার ৬৪৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকায় এসেছে। ফলে এখানে ডিএসইর মূলধন কমেছে এক লাখ ৩৭ হাজার ১৭৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। পাশাপাশি ডিএসইর মূল সূচকও কমেছে প্রায় এক হাজার পয়েন্ট। জানুয়ারির প্রথম দিন ডিএসইএক্স ছিল ছয় হাজার ২৪২.৮৭ পয়েন্ট। প্রতি দিন ঝরতে ঝরতে সূচকটি এখন পাঁচ হাজার ২৪৪.৭৫ পয়েন্টে নেমেছে। কমেছে ৯৯৮.৭৫ পয়েন্ট।

অন্য দিকে, চলতি বছরের প্রথম দিন সাত লাখ ৭৫ হাজার ৯৬৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ছিল সিএসইর বাজারমূলধন। জুনে এসে সেটা কমতে কমতে ছয় লাখ ৭২ হাজার ৯২৩ কোটি ৩২ লাখ টাকায় নেমেছে। ফলে সিএসই তারল্য কমেছে এক লাখ ৩ হাজার ৪১ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। আর প্রধান সূচক সিএএসপিআই ও সিএসই-৩০ দুটো সূচকই বড় আকারের পয়েন্ট হারিয়েছে। সিএএসপিআই ১৮ হাজার ৫০৫.১৪ পয়েন্ট থেকে গত প্রায় ছয় মাসে কমে এখন ১৪ হাজার ৭৮৬.৮২ পয়েন্টে এসেছে। সিএএসপিআই হারিয়েছে তিন হাজার ৭১৮.৩২ পয়েন্ট। আর সিএসই-৩০ সূচক ১৩ হাজার ২৯৬ পয়েন্ট থেকে কমে এখন ১১ হাজার ৫৬৬.২৮ পয়েন্টে নেমেছে। এটিও হারিয়েছে এক হাজার ৭২৯.৯৪ পয়েন্ট।

অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগকারীরা কেন বাজার ছাড়ছেন এটা সরকার ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারণ চিহ্নিত করতে হবে এবং সমাধানে কাজ করতে হবে। এখানে শেয়ারগুলোর পেছনে টাকার সরবরাহ কমে গেছে। সরকারের উচিত পুঁজিবাজার বিশ্লেষকদের সুপারিশগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাজেটে পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশী বিনিয়োগকারীরা না এলে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না।

বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলছেন, বেশির ভাগ উন্নত দেশে বড় অঙ্কের অর্থ পুঁজিবাজার থেকে অর্থনীতির মূল ধারায় যোগ হয়। ওই সব দেশের সরকার আপৎকালীন অর্থ শেয়ারবাজার থেকে নিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টোটা। তিনি বলেন, গত ২০১৫ সালের জুন মাসের শেষে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীর হিসাব বা বিও ছিল ৩১ লাখ ৯৫ হাজারটি। আস্থাহীনতায় কমতে কমতে বর্তমানে বিও হিসাব ১৭ লাখ ৫৬ হাজারটি। পুঁজিবাজারের এই পতন অবস্থার জন্য বিনিয়োগকারীদের ‘আস্থাহীনতা ও আতঙ্কিত’ হওয়া বড় কারণ। টানা দরপতনে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ কারণে অনেকে হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে বাজারে ছাড়ছেন। এ বাজারে গতি আনতে সরকারকে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। বাজেটের মতো বড় আয়োজনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। পুঁজিবাজারে গতি এলে সমগ্র অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে সে ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ দেখতে পাইনি।

 


আরো সংবাদ



premium cement