২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নাফ নদীতে মিয়ানমারের যুদ্ধ জাহাজের টহল

জঙ্গি বিমান ও মর্টারশেলের শব্দে আতঙ্ক টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনে
নাফ নদীতে মিয়ানমারের যুদ্ধ জাহাজ : নয়া দিগন্ত -

নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সশস্ত্রবাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির সাথে সংঘর্ষের মধ্যে মিয়ানমারের আকাশসীমায় উড়ছে যুদ্ধবিমান আর নাফ নদীতে টহল দিচ্ছে মিয়ানমারের নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ। নাফ নদীর সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের কাছে টানা দুই দিন ধরে দেখা মিলছে বড় ধরনের একটি যুদ্ধজাহাজ। আর সেই জাহাজ ও মিয়ানমারের স্থলে ভাগের মধ্যে বুধবার দিবাগত রাত থেকে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত চলছে গোলাগুলি। এ সময় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ ভেসে আসছে টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকায়। এমন পরিস্থিতিতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড।
বুধবার সকাল থেকে থেমে থেমে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের এপার থেকে। মিয়ানমারের ভারী গোলা ও মর্টার শেলের শব্দে শাহপরীর দ্বীপ এবং সেন্টমার্টিন কেঁপে উঠেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাদের মধ্যে এ নিয়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সীমান্তের ওপারের গোলাগুলির শব্দে নির্ঘুম রাত কাটান বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী বাসিন্দারা। ইতোমধ্যে মিয়ানমারের রাখাইনে অনেক ক্যাম্প বিদ্রোহী আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
সাবারাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর হোসনাইন বলেন, সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার থেকে ফের মর্টার শেল ও গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসছে। বিস্ফোরণের শব্দে সীমান্তের এপারে টেকনাফ সাবরাং শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় কম্পন সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্তে দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমারে ফের সংঘর্ষ এপারের মানুষজনের মাঝে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। আমরা জেনেছি, ওপারে যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে, ফলে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে- তাই সীমান্তরক্ষীরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, বুধবার দুপুরে নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে মিয়ানমারের জলসীমায় সে দেশের যুদ্ধ জাহাজ এসেছে। জাহাজটি রাতেও মৌলভীপাড়ার সীমান্তের ওপারে দেখা গেছে। এরপর রাত থেকে শুরু হওয়া মর্টারশেলের বিকট গোলার শব্দ থামেনি। পুরো রাতজুড়ে শাহপরীর সীমান্ত দ্বীপটিতে গোলার শব্দ পাওয়া গেছে।
এ দিকে গুলির শব্দে কাঁপছে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনও। মিয়ানমারের আকাশসীমায় যুদ্ধবিমানের আনাগোনায় ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে আছেন দ্বীপের বাসিন্দারা। সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, সারারাত মিয়ানমার থেকে ফের মর্টার শেল ও গোলাগুলোর শব্দ ভেসে আসছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক কাটছে না। মিয়ানমার সীমান্ত থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাতায়াতকারী নৌযান লক্ষ্য গুলিবর্ষণের কারণে ১০দিন বন্ধ থাকার পর বিজিবি ও কোস্টগার্ডের নিরাপত্তায় শুরু হয়েছে ট্রলার চলাচল। তবে বৃহস্পতিবার পণ্যবাহী কোনো ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে ছাড়েনি বলে জানিয়েছেন প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা।
বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় মেরিন ড্রাইভ সড়ক সংলগ্ন টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের মুন্ডারডেইল এলাকার সাগর উপকূলের পয়েন্ট দিয়ে সেন্টমার্টিন থেকে ট্রলারযোগে এসব মানুষ ফিরেছেন বলে জানিয়েছেন, টেকনাফের ইউএনও মো: আদনান চৌধুরী। তিনি বলেন, দুপুর ১টার দিকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের জেটি ঘাট থেকে ৩টি ট্রলারযোগে বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যদের নিরাপত্তায় অন্তত তিন শতাধিক মানুষ টেকনাফের উদ্দেশে রওনা দেয়। বিকেল ৩টার দিকে ট্রলারগুলো টেকনাফের মুন্ডারডেইল সাগর উপকূলে পৌঁছে। কিন্তু সাগরের প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে এসব ট্রলার থেকে লোকজনকে সরাসরি কূলে উঠানো সম্ভব হচ্ছিল না। পরে কূল থেকে কয়েকটি ডিঙ্গি নৌকা উপকূলের কিছু দূরে সাগরে অবস্থানকারী ট্রলারগুলোর কাছে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে বড় ট্রলার থেকে এসব মানুষকে ডিঙ্গি নৌকায় তুলে কূলে নিয়ে আসা হয়েছে।
জানা গেছে, টানা ১০ দিন বন্ধ থাকার পর বুধবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এক জরুরি সভায় বৃহস্পতিবার থেকে যাত্রী আসা-যাওয়া এবং পণ্যবাহী ট্রলার চলাচল শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ইউএনও আদনান জানান, বৃহস্পতিবার টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটের সাগরের বিকল্প পথে যাত্রী পারাপার শুরু হলেও পণ্যবাহী কোনো ট্রলার সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে টেকনাফ ছাড়েনি। অন্য দিকে সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম জানিয়েছেন, গত ১০ দিন আসা-যাওয়া বন্ধ থাকায় দ্বীপের খাদ্য পণ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এখন বিকল্পভাবে ট্রলার চলাচল শুরু হওয়ায় স্বস্তি মিলছে। যে ট্রলারগুলো গেছে ওই সব ট্রলার নিয়ে টেকনাফে থাকা মানুষ ফিরে আসবে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো: ইয়ামিন হোসেন বলেন, মূলত কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া ঘাট থেকে বড় জাহাজে ব্যবসায়ীরা পণ্য নিয়ে যাবেন। এটা ব্যবসায়ী ও জাহাজ মালিকরা মিলে করবেন। প্রশাসন নিরাপত্তার বিষয়টি দেখবেন। এ ছাড়া এখন বঙ্গোপসাগর হয়ে যে ট্রলারে যাত্রী আসা-যাওয়া করছে ওখানে কিছু পণ্য নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ফলে খাদ্য সঙ্কট হবে না। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে চলাচলের বিকল্প রুট খোঁজা হচ্ছে বলেও জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সকালে খাবার ও পণ্যবাহী দু’টি জাহাজ টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাবে বলে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে।
ট্রলারে ফিরছেন দুই শতাধিক মানুষ : কয়েক দিন যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর বিকল্প পথে তিনটি ট্রলারে করে সেন্টমার্টিন থেকে টেকনাফে ফিরছে দুই শতাধিক হোটেল কর্মী, শ্রমিক ও বিভিন্ন কাজে গিয়ে আটকে পড়া দুই শতাধিক মানুষ। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১টার দিকে সেন্টমার্টিন জেটি ঘাট থেকে ট্রলার তিনটি টেকনাফের উদ্দেশে রওনা দেয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: আদনান চৌধুরী।
তিনি জানান, তিনটি ট্রলারে করে সেখানে ঈদের ছুটি বা বিভিন্ন কাজে গিয়ে আটকে পড়া দুই শতাধিক মানুষকে নিয়ে রওনা হয়েছে। ট্রলারগুলো মূলত বঙ্গোপসাগর হয়ে টেকনাফে পৌঁছাবে। তিনি আরো জানান, খাদ্যসামগ্রী নিয়ে টেকনাফ থেকে নৌযান সেন্টমার্টিন যাওয়ার কথা ছিল সেটি যেতে পারেনি। কারণ গতকাল থেকে নাফ নদের একটি এলাকায় ব্যাপক গোলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিকল্প পথে হয়তো আগামীকাল কক্সবাজার থেকে এই খাদ্যসামগ্রী পৌঁছাতে পারে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, কয়েক দিন ধরে এসব হোটেলকর্মী, কাজ করতে আসা শ্রমিক ও বিভিন্ন কাজে সেন্টমার্টিনে এসে আটকে পড়া এসব মানুষকে বিশেষ ব্যবস্থায় বিকল্প পথে ফেরানো হচ্ছে টেকনাফে। সময় যত যাচ্ছে ততই অনিশ্চয়তা বাড়ছে দ্বীপের মানুষের মধ্যে। খাদ্যসহায়তা খুবই প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ দিকে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তে গোলার বিকট শব্দের বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউপি সদস্য আবদুস সালাম বলেন, সীমান্তে রাতে খুব বেশি গুলির শব্দ শোনা গেছে। এখানে নাফ নদী থাকায় আমরা গোলার শব্দ শুনলেও ঠিক ওপারে কোন এলাকায় এ ঘটনা ঘটেছে সেটা বলা মুশকিল। সীমান্তে দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, হঠাৎ করে ফের মিয়ানমারের গোলার বিকট শব্দে এপারের মানুষজনের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ছে। আমরা জেনেছি ওপারে যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে, ফলে সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে তাই সীমান্তরক্ষীরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।
এ দিকে মিয়ানমারের মংডু, বুথেডং ও রাথেডংয়ের কয়েকটি গ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির সাথে দেশটির সেনাবাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ চলছে। টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং থেকে শাহপরীর দ্বীপ পর্যন্ত ৫৪ কিলোমিটার নাফ নদীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের সদস্যরা দিন-রাত নদী ও সীমান্ত সড়কে টহল বৃদ্ধি করেছে। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব সময় প্রস্তুত বিজিবি ও কোস্টগার্ড। এ বিষয়ে টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো: মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, সীমান্তে বিজিবির টহল জোরদারের পাশাপাশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ রোধে সতর্ক অবস্থানে রয়েছি।
কয়েক দিন ধরে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে চলাচলকারী নৌযান লক্ষ্য করে গুলি করার ঘটনায় এমনিতেই আতঙ্কে রয়েছেন স্থানীয়রা। এ পরিস্থিতির মধ্যেই বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর সীমান্তে নতুন করে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা গেল।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের আশপাশের মেগিচং, কাদিরবিল, নুরুল্লাহপাড়া, মাঙ্গালা, নলবইন্ন্যা, ফাদংচা ও হাসুরাতা এলাকা। ধারণা করা হচ্ছে, মংডু শহর ও আশাপাশের এলাকাগুলোতে দেশটির সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। এতে উভয়পক্ষ ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করায় বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যাচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement