১৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১ পৌষ ১৪৩০, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নুসেইরাত শিবিরে নিহত বেড়ে ২৭৪, বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ

গাজার আল আকসা শহীদ হাসপাতালের সামনে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহতদের জানাজায় শোকাহত ফিলিস্তিনিরা : মিডলইস্ট আই -

- ইসরাইলি হামলায় কয়েকজন বন্দীও নিহত
- গাজায় নিহতের সংখ্যা ৩৭ হাজার ছাড়াল
- নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক

গাজার মধ্যাঞ্চলে নুসেইরাত শরণার্থীশিবির থেকে চার ইসরাইলি বন্দীকে মুক্ত করার অভিযানে ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ২৭৪ জনে। ইসরাইলের এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করেছে জাতিসঙ্ঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, ওআইসি, আরব পার্লামেন্ট, তুরস্ক, ইরান, জর্দান, মিসরসহ বেশ কয়েকটি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ ইসরাইলের মিত্ররা বেসামরিক লোকজনের হতাহত হওয়ার ব্যাপারে কিছুই না বলে বন্দী উদ্ধারের জন্য ইসরাইলের পক্ষে বরাবরের মতো অবস্থান নিয়েছে। আলজাজিরার খবর থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
গাজা কর্তৃপক্ষ গতকাল রোববার জানায়, ‘একটি নজিরবিহীন নৃশংস হামলায়’ কমপক্ষে ৬৯৮ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। গাজার দেইর আল-বালাহতে অবস্থিত আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের ভেতর থেকে আলজাজিরার হিন্দ খুউদারি এ দিন জানান, সিভিল ডিফেন্স কর্মীরা এখনো নুসেইরাতে হামলার পরে ধ্বংসস্তূপের নিচে মৃত বা আহত ফিলিস্তিনিদের খুঁজে পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘বোমাবর্ষণ তীব্রভাবে অব্যাহত রয়েছে এবং জরুরি প্রতিক্রিয়াকারীদের জন্য হতাহত ফিলিস্তিনিদের কাছে পৌঁছনো খুবই কঠিন। তারা আমাদের বলছে, এখনো রাস্তায় ও ধ্বংসস্তূপের নিচে মানুষ রয়েছে, যেখানে তারা পৌঁছতে পারেননি।

অন্য দিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইলের সামরিক অভিযানে কমপক্ষে ৩৭ হাজার ৮৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৮৪ হাজার ৪৯৪ জন আহত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোস্তফা বলেছেন, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নুসেইরাত হামলার বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশন চাইছে।
হামাস বলেছে, ইসরাইলের চার বন্দীকে মুক্তি দেয়া ‘গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সেনাবাহিনীর কৌশলগত ব্যর্থতা পরিবর্তন করবে না’, বিশেষ করে এ অভিযান কার্যকর করতে আট মাস সময় নেয়ার পরে। যুক্তরাষ্ট্র এই ইসরাইলি অভিযানে সহায়তা করেছে অভিযোগ করে তারা আরো বলেছে, এটি আবারো প্রমাণ করে, ওয়াশিংটন অবরুদ্ধ উপকূলীয় ভূখণ্ডে ‘সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের মতো অবৈধ কাজের সহযোগী ও সম্পূর্ণভাবে জড়িত’।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান জোসেপ বোরেল এই অভিযানের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এক্সে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘রক্তপাত অবিলম্বে শেষ হওয়া উচিত। গাজা থেকে বেসামরিকদের আরেকটি গণহত্যার খবর ভয়ানক। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই।’ নরওয়ের ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেয়াস মটজফেল্ড ক্রাভিক এক্সে লিখেছেন, তিনি ‘গাজায় বেসামরিকদের ওপর আরেকটি গণহত্যার খবরে আতঙ্কিত’। তার দেশ বন্দীদের মুক্তি ও অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলার নিন্দা জানায় বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। ৫৭টি সদস্যরাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করা অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) ‘ইসরাইলি দখলদার সেনাবাহিনীর পরিচালিত ভয়াবহ গণহত্যার নিন্দা করেছে, যার ফলে শত শত ফিলিস্তিনি হতাহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।’ সেই সাথে তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ভূমিকার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তদন্ত, জবাবদিহি ও শাস্তির আহ্বান জানিয়েছেন। কায়রোভিত্তিক আরব পার্লামেন্ট ‘ইসরাইলি দখলদারিত্বের সংঘটিত গণহত্যার’ নিন্দা করেছে এবং ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেছে।
এক বিবৃতিতে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, দেশটি ইসরাইলি হামলার জন্য ‘দুঃখ প্রকাশ করে’। তারা এ হামলাকে ‘বর্বর’ এবং গাজায় ইসরাইলের সংঘটিত ‘অপরাধের’ দীর্ঘ তালিকার আরেকটি উদাহরণ বলে অভিহিত করেছে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দায়ী সংস্থাগুলোকে, বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ইসরাইলের এই অপরাধ বন্ধে দায়িত্ব প্রয়োগের আহ্বান জানায়।

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শত শত ফিলিস্তিনিকে সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের জন্য বিশ্ব সরকার এবং জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের ‘নিষ্ক্রিয়তার’ জন্য দায়ী করেছে। মুখপাত্র নাসের কানানি এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক অপরাধগুলো... ইহুদিবাদী শাসকের (ইসরাইল) আট মাসের যুদ্ধাপরাধ ও আইন লঙ্ঘনের মুখে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদসহ সরকার ও দায়িত্বশীল আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তার ফলাফল।’ জর্দানের পররাষ্ট্র ও প্রবাসী মন্ত্রণালয় এক্সে এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরাইলি আক্রমণ ‘একটি অভ্যাস, যা ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের পদ্ধতিগত লক্ষ্যবস্তু, আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনে ইসরাইলি অধ্যবসায় ও যুদ্ধাপরাধ চালিয়ে যাওয়াকে প্রতিফলিত করে’।
মিসরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নুসেইরাতে হামলাকে ‘আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সব বিধানের পাশাপাশি মানবতা ও মানবাধিকারের সব মূল্যবোধের স্পষ্ট লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেছে।
জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক্সে এক পোস্টে বলেছেন, তার সংস্থা এই সপ্তাহে গাজায় জাতিসঙ্ঘের ১৮৮ জন কর্মী নিহতের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ইসরাইলি হামলায় ‘অসংখ্য ফিলিস্তিনি বেসামরিক লোক’ নিহত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের ত্রাণ প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস বলেছেন, অবশিষ্ট সব জিম্মিকে মুক্তি দিতে হবে এবং যুদ্ধ শেষ করতে হবে।
অধিকৃত ফিলিস্তিনে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিসের সাবেক উপপ্রধান এবং ওসাকা জোগাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবাধিকার ও শান্তি অধ্যয়নের অধ্যাপক সৌল তাকাহাশি আলজাজিরাকে বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের হত্যার বিষয়ে পশ্চিমা প্রতিক্রিয়া ‘দ্বৈত মান’ দেখায়।
তাকাহাশি জাপানের তোয়োহাশি থেকে বলেন, ‘মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে বিশাল দ্বৈত মান রয়েছে। ইসরাইলি, ইউক্রেনীয় ও সাদা চামড়ার জীবন গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু যখন ফিলিস্তিনিদের কথা আসে, বাদামি চামড়ার মানুষ, সাধারণভাবে আরব, তারা ঠিক তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমরা সত্যিই তাদের নিয়ে চিন্তা করি না।’

ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের (এমএসএফ) দলগুলো আল-আকসা হাসপাতালে কাজ করে। সেখানে শনিবার অধিকাংশ হতাহতকে নেয়া হয়েছিল। গোষ্ঠীটি সেখানে ওষুধ, জ্বালানি ও খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার ‘দুঃস্বপ্নের’ বর্ণনা করেছে। গাজায় এমএসএফ সমন্বয়কারী স্যামুয়েল জোহান বলেন, ‘বিশ্বনেতারা এই গণহত্যা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আর কত পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করতে হবে?’
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ভিজিটিং প্রফেসর কেনেথ রথ আলজাজিরাকে বলেন, ‘একটি দিনের অভিযানের অর্থ হলো ‘কিছু বোমা স্পষ্টতই নুসেইরাতের একটি বাজারের পাশে বা ডান দিকে পড়েছিল, যা লোকে ভরা ছিল। সেই পরিস্থিতিতে অনুমান করা যায়, একটি রাতের অভিযানের চেয়ে বেশিসংখ্যক বেসামরিক হতাহতের ঘটনা ঘটবে। এটি বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি এড়ানোর জন্য সব সম্ভাব্য সতর্কতা অবলম্বন করার দায়িত্বের সাথে অসঙ্গত।’
তবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইসরাইলি সামরিক বাহিনী একটি ‘সাহসী’ অভিযানের জন্য তার কমান্ডোদের প্রশংসা করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফিলিস্তিনিদের গণহত্যার বিষয়ে মন্তব্য না করেই বন্দীদের মুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সব বন্দী ঘরে না আসা পর্যন্ত এবং যুদ্ধবিরতি না হওয়া পর্যন্ত আমরা কাজ বন্ধ করব না। এটা অপরিহার্য।’
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও ইসরাইলের উদ্ধার অভিযানের প্রশংসা করেন এবং গাজা যুদ্ধের স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান। তিনিও বিপুলসংখ্যক বেসামরিক মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেননি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, অস্বাভাবিকভাবে উচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা উপেক্ষা করে বন্দীদের মুক্তি একটি ‘বিশাল স্বস্তি’। রয়টার্স জানিয়েছে, বন্দি উদ্ধার ও ইসরাইলি বিমান হামলা একই অভিযানের অংশ ছিল কি না তাৎক্ষণিকভাবে তা পরিষ্কার হয়নি, কিন্তু উভয় ঘটনা গাজায় মধ্যাঞ্চলীয় আল-নুসেইরাত এলাকায় ঘটেছে। এলাকাটি ঘন বসতিপূর্ণ। গত আট মাসে এখানে ইসরাইলি বাহিনীর সাথে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের যোদ্ধাদের অনেকগুলো লড়াইয়ের ঘটনা ঘটেছে।

এক বিবৃতিতে ইসরাইলি পুলিশ জানিয়েছে, এই অভিযান চলাকালে ইসরাইলের স্পেশাল ফোর্সের এক কমান্ডার নিহত হন। ইসরাইল উদ্ধার পাওয়া বন্দীদের নাম প্রকাশ করেছে। তারা হলেন- নোয়া আরগামানি (২৬), আলমোগ মেইর জান (২২), আন্দ্রে কোজলোভ (২৭) ও স্লোমি জিভ (৪১)। এদের মধ্যে নোয়া আরগামানি নারী ও বাকি তিনজন পুরুষ। উদ্ধার পাওয়া বন্দীদের হেলিকপ্টারে করে গাজা থেকে ইসরাইলে ফিরিয়ে নেয়া হয়। নুসেইরাতের বাসিন্দা চিকিৎসাকর্মী জিয়াদ (৪৫) বলেন, ‘হরর সিনেমার মতো হলেও এটি বাস্তব নির্বিচার হত্যা। এই এলাকায় ইসরাইলি ড্রোন ও যুদ্ধবিমানগুলো সারা রাত লোকজনের ঘরবাড়ি ও পলায়নপর মানুষের ওপর এলোমেলোভাবে গুলিবর্ষণ করেছে।’
নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি বৈঠক : মধ্য গাজার আল-নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে ইসরাইলি হামলার ঘটনায় জরুরি বৈঠকে বসতে যাচ্ছে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ। শনিবার ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের অনুরোধে জরুরি এ বৈঠক ডাকা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে দেশটির প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোস্তফার কার্যালয়। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফা নিউজ জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস জাতিসঙ্ঘে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি অধিবেশনের ডাক দিতে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতকে নির্দেশ দিয়েছেন।
নুসেইরাতে কিছু বন্দী নিহত : আল-নুসেইরাত শরণার্থীশিবির ও নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে ইসরাইলের অভিযানে কিছু বন্দী নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসসাম ব্রিগেড। কাসসাম ব্রিগেডের মুখপাত্র আবু উবাইদা তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘ইসরাইল ভয়াবহ গণহত্যা ঘটিয়ে তাদের কিছু বন্দীকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে, তবে অভিযান চলাকালে তারা অন্য কয়েকজনকেও হত্যা করেছে।’ আবু উবাইদা বলেছেন, ‘শনিবারের অভিযান শত্রুপক্ষের বন্দীদের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে এবং তাদের অবস্থা ও জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’


আরো সংবাদ



premium cement