সাদা করার সুযোগ দুষ্টচক্রের লালন
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ০৮ জুন ২০২৪, ০২:৩২, আপডেট: ০৮ জুন ২০২৪, ০২:৩৩
সিপিডির বাজেট বিশ্লেষণ
- ১৫ শতাংশ করে সাদার সুযোগ আ’লীগের ইশতেহার পরিপন্থী
- নতুন অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রণয়নে মুন্সিয়ানা দেখাতে ব্যর্থ
- সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের বিভ্রান্তিমূলক হিসাব
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সেটা অস্বাভাবিক ও চ্যালেঞ্জিং সময়ে গতানুগতিক সাধারণ বাজেট। বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতাবিবর্জিত ও পূরণ হবার নয়। সরকার ১৫ শতাংশ কর প্রদানের মাধ্যমে অপ্রদর্শিত ও কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ দিয়েছে তা দুষ্টচক্রের মাথায় হাত বুলানোর মতো। এমনকি এটা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের সাথে সাংঘর্ষিক। এসব মন্তব্য উঠে এসেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) পর্যালোচনায়। সংস্থাটি বলছে, মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষ অতিষ্ঠ। কিন্তু এই চাপ কমাতে বাজেটে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেই। বরং খাদ্যবহির্ভূত খাতে কর বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেয়া হবে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দের যে তথ্য দেয়া হয়েছে তা বিভ্রান্তিমূলক হিসাব।
গতকাল আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘জাতীয় বাজেট ২০২৪-২৫ : সিপিডির পর্যালোচনা’ শিরোনামে মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সিপিডির পর্যালোচনায় এসব কথা উঠে আসে। পর্যালোচনার মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এ সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। এ ছাড়া অন্য গবেষকরাও উপস্থিত ছিলেন।
উপস্থাপনা তুলে ধরে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি, জিডিপি গ্রোথ, বিনিয়োগের যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অতি উচ্চাভিলাষী এবং বাস্তবসম্মত নয়। বাজেটে অর্থনৈতিক সূচকের অনেক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। চলমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ অনুধাবন করতে না পারায় বাজেটে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা দুর্বল ও অপর্যাপ্ত। প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন তো উচ্চাকাক্সিক্ষত। এটা কোথা থেকে আসবে? তিনি বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতির সব সূচকগুলোতে ক্ষত দেখা দিয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেই। সুতরাং এই বাজেট দিয়ে চলমান সঙ্কট মোকাবেলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে ব্যাংক ঋণের প্রতি নির্ভরতার কারণে বেসরকারি খাত প্রয়োজনীয় ঋণ পাবে কি না, তা চিন্তার বিষয়। বেসরকারি বিনিয়োগ যেখানে ২৭.৩ শতাংশ ধরা হয়েছে তা কোথা থেকে আসবে। কারণ বিনিয়োগ পরিবেশ স্থবির। ফলে এই প্রবৃদ্ধি কিভাবে হবে?
কালো টাকা সাদার সুযোগের বিষয়ে ড. ফাহমিদা বলেন, আয়করের সর্বোচ্চ হার যেখানে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হলো, সেখানে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এটা নৈতিক ও অর্থনৈতিক, কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা নিয়মিত কর দেন, এটার মাধ্যমে তাদের তিরস্কার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ সৎ করদাতাদের প্রতি চরম অন্যায়। এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, এমপিরা ফ্রি যে গাড়ি আনেন, সেটা কিছু কর দিয়ে আমদানি করলে রাজস্ব আদায় হতো। একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হতো। তবে এই জন্য তাদেরকে বর্তমান যে আইন আছে তা পরিবর্তন করতে হবে।
মূল্যস্ফীতির বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী ছয় মাসে মূল্যস্ফীতির হার কমে সাড়ে ৬ শতাংশ হবে। এটা কিভাবে সম্ভব তা বোধগম্য নয়। যেখানে এখন ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে মানুষের স্বস্তি ফিরিয়ে আনার দরকার ছিল। কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আর যেসব পণ্যে ভ্যাট তুলে নেয়া হয়েছে তার সুফল ভোক্তা কতটা পাবে সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এককভাবে এই চাপ মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। প্রয়োজন হলো বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নেয়া। শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি নিয়ে এর সমাধান হবে না। বরং রাজস্ব সহযোগী পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতির চাপ কমানো দুরূহ হবে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুচির ব্যাপারে বলেন, চলতি অর্থবছরে নতুন ৩০টি প্রকল্প যেখানে ছিল আগামী অর্থবছর নতুন প্রকল্প ৫৭টি। ৯২৪ প্রকল্পের বিপরীতে কোনো বরাদ্দ নেই। বিদেশী অর্থের আশায় ২৫৯টি প্রকল্প অননুমোদিত রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, এক হাজার ১৩৮টি প্রকল্পের গড় বয়স হলো ৫.২ বছর। এর মধ্যে ৩৫৭টি প্রকল্পের গড় বয়স ৬ থেকে ১০ বছর। আর ৩৬টি প্রকল্পের বয়স ১০ বছরের বেশি। তিনি বলেন, প্রকল্পের বাস্তবায়ন হার আগাচ্ছে না। পিছিয়েই রয়েছে।
বাজেট বরাদ্দের দিকগুলো নিয়ে তিনি বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমেছে। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক হিসাব দেয়া হয়েছে। চলতি বাজেটের তুলনায় আগামী বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ সাড়ে ১৫ শতাংশ কমেছে। অন্য দিকে, শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দ কমেছে। এমনকি ২০১৬ থেকে ২০২৩ সালে জিডিপির হিসাবে এলডিসিদের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন। যেখানে ৩৩টি এলডিসি তাদের জিডিপির ২ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয় করছে। বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। জ্বালানি খাতে ৭ শতাংশ বেড়েছে। তিনি বলেন, জেন্ডার খাতে বরাদ্দ দেয়া থাকে। ব্যয়ের তথ্যটা দেয়া হয় না। যার কারণে বাস্তবায়ন বোঝা যায় না।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ার সুযোগকে অনৈতিক উল্লেখ করে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এই সুযোগের মাধ্যমে দুষ্টচক্রের মাথায় হাত বুলানো হচ্ছে। এই সুযোগ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতির সাথে সাংঘর্ষিক। ইশতেহারের বিপরীত। তিনি বলেন, যিনি কর খেলাপি, সময় মতো কর দেননি, যিনি ঋণখেলাপি, অর্থপাচারকারী-বাংলাদেশে এমন একটি দুষ্টচক্র সৃষ্টি হয়েছে। এই দুষ্টচক্রের মাথায় হাত বুলিয়ে টাকা আনবে? তিনি বলেন, আগে যে সুযোগ দেয়া হয়েছিল তাতে অস্পষ্টতা ছিল। দুদকের ধরার সুযোগ ছিল। কিন্তু এবার সব বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন দুদক তাদের ধরতে পারবে না। এটাতে কী সঙ্কেত দেয়া হয়েছে? তিনি বলেন, বাজেটে দেখলাম ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করলে তাকে আর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না সেই লাইন যোগ করা হয়েছে, যা আগে ছিল না। এটা অগ্রহণযোগ্য এবং অর্থনৈতিকভাবেও ফলপ্রসূ না। তিনি বলেন, গত দুই বছর যে হারে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে তাতে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত বড় ধরনের চাপের মধ্যে আছে। তাদের আয় বাড়েনি। মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ নয়, গত দুই বছর ধরে এটি ২০ শতাংশ হয়েছে আমাদের হিসাবে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নতুন সরকারের নতুন অর্থমন্ত্রী ও অর্থ প্রতিমন্ত্রীর পুরনো বাজেট এটি। অর্থমন্ত্রী এই সময়ে বাজেট প্রণয়নে মুন্সিয়ানা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারের ব্যয় সঙ্কোচনের কোনো পদক্ষেপ দেখছি না। কবে হবে এই ব্যয় সঙ্কোচন? তিনি বলেন, এই বাজেটের কারণে খাদ্যবহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি বড় ধরনের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও বড় চাপের কারণ হয়ে উঠতে পারে। কারণ বাজেটে বিভিন্ন সেবার ওপর কর বসেছে যেগুলো পেতে মানুষকে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। আবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ক্ষেত্রে বছরে চারবার মূল্যবৃদ্ধি হবে এবং সে কারণে সেবার ব্যয় বাড়বে। আবার যেসব খাতে শুল্ক ছাড় দিয়েছে তার সুবিধা আমদানিকারকদের পকেটে যাবে। এগুলোর সুফল সাধারণ মানুষ পায় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজস্ব নীতি হলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীনির্ভর।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা