১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য : এফবিসিসিআই

বাজেট নিয়ে ব্যবসায়ীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া

-

বর্তমান সরকারের চতুর্থ মেয়াদে ঘোষিত প্রথম বাজেট নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)। বাজেট যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন সংগঠনটির সভাপতি মো: মাহবুবুল আলম। গতকাল রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, এবারের বাজেটে ব্যক্তি করমুক্ত আয়ের সীমা পূর্বের ন্যায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা রাখা হয়েছে। এটিকে আমরা ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করছি। আশা করি সরকার বিষয়টি বিবেচনায় নেবে। এ ছাড়া অগ্রিম আয় কর (এআইটি) এবং অগ্রিম কর (এটি) নিয়ে ব্যবসায়ীরা অনেক দিন ধরে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছেন। এবারের বাজেটেও সেটি রাখা হয়েছে। আমরা প্রস্তাব করছি এ দুটি প্রত্যাহারের বিষয় সরকার বিবেচনা করবে।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিষয়ে তিনি বলেন, এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এটি আদায় করা অনেক কঠিন হবে। যদি করতে হয় তাহলে করের আওতা বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় এটি সম্ভব হবে না বলে আমরা মনে করি। অন্যদিকে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যা বাজেট ঘাটতির প্রায় ৫৪ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৭ শতাংশ। এত বড় অঙ্কের ঋণ সরকার গ্রহণ করলে আমরা ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে অসুবিধায় পড়তে হবে। তখন ব্যবসায়ীদের মূলধন জোগান দিতে বেগ পেতে হবে। ফলে আমরা প্রস্তাব করছি অভ্যন্তরীণ নয়, বিদেশী উৎস থেকে ঋণগ্রহণ করলে সার্বিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হবে।
মাহবুবুল আলম বলেন, প্রতি বছর যখন বাজেট হয়, গত পাঁচ দফায় আমরা দেখেছি, ১০ থেকে ১২ শতাংশ বাজেট বেড়েছে। এবার চার শতাংশ প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। আমি মনে করি, এটা যৌক্তিক, বাস্তবসম্মত ও বাস্তবায়নযোগ্য। যদি আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি, আমি আশা করি, এটা বাস্তবায়নযোগ্য।
পরিস্থিতি বিবেচনায় সময়োপযোগী : ঢাকা চেম্বার
প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আহরণের উপর রাজস্ব আদায়, বাজেট ঘাটতি কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন আমদানি শুল্ক ও উৎসে কর কমিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা রয়েছে। প্রায় ৩০টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর আমদানি শুল্ক কমানো হয়েছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কাজে আসবে বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আশরাফ আহমেদ।
বাজেট পরবর্তী ডিসিসিআই আয়োজিত এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, বিগত বছরের চেয়ে ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণের হার ১১.৮২ শতাংশ কম নির্ধারণ করা হয়েছে, তারপরও এটি অনেক বেশি, যা বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। এ বছর বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ৪.৬ শতাংশ, যা বিগত বছরের চেয়ে কম, তবে প্রবৃদ্ধি অর্জনে তা বাধাগ্রস্ত হবে না। আমাদের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ১০ শতাংশের কম, এটাকে আগামী ১০ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে আমাদের আর্থিক খাতে তারল্য সঙ্কট দ্রুত নিরসন করা প্রয়োজন। যদিও বিষয়টি বিভিন্ন সামষ্টিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপট ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল।
ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, সরকার এই বাজেটে বেশ কিছু জায়গায় কর ও মূসক কমিয়েছে আবার কিছু কিছু পণ্যের উপর কর হার বেড়েছে। তবে সামগ্রিকভাবে তা ব্যবসা-বাণিজ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করবে না। বাজেটের ভালো উদ্যোগগুলোকে বাস্তবায়ন করাই এ বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর শর্তসাপেক্ষে ২.৫ শতাংশ করপোরেট কর কমানোর উদ্যোগকে তিনি স্বাগত জানান।
জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে : চট্টগ্রাম মেট্রো চেম্বার
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি খলিলুর রহমান জাতীয় সংসদে ঘোষিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) রাজস্ব আহরণের জন্য চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার যে লক্ষ্য মাত্রা দেয়া হয়েছে তার যথাযথ তদারকি এবং সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ করা না গেলে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। বিদেশী ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ বরাদ্দ কমানোর ফলে জনগণের জীবনাযাত্রার খরচ বৃদ্ধি পেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, করদাতাদের হয়রানি কমাতে আয়কর রিটার্ন অ্যাসেসমেন্টের বিধান বাতিল করায় ব্যক্তি ও কোম্পনি দুই শ্রেণীর করদাতাই কিছুটা স্বস্তি পেতে পারে। যেহেতু, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দা। তাই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি, ডলার সঙ্কট এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হেতু মূল্যস্ফীতি ১০-এর কোঠায় উঠায় এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের বৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী পোশাকশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে রফতানির বিপরীতে প্রযোজ্য উৎসে কর সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে ০ শতাংশ করার প্রস্তাব করেন।

সিএমসিসিআই সভাপতি বলেন, কাস্টম আইন ২০২৩-এ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। যার মধ্যে কাস্টম অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর ৩২ ধারায় সৎ ও ব্যবসায়ীদের রক্ষায় ভুল এবং অসত্য ঘোষণা উভয়ের মধ্যে এক হাজার টাকা শুল্ক ব্যবধানে যে মানদণ্ডটি ছিল কাস্টম আইন ২০২৩-এর ৩৩ ধারায় তা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। যার ফলে প্রতিনিয়ত বিপদে পড়বে সৎ ব্যবসায়ীবৃন্দ। কাস্টম অফিসারের করুণায় থাকতে হবে। যার ফলে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাই ওই ৩৩ ধারা বাতিল করে কাস্টম অ্যাক্ট ১৯৬৯-এর ৩২ ধারা পুনর্বহাল করার অনুরোধ করছি। এ ছাড়া কাস্টম অ্যাক্ট ২০২৩-এর ৮২ ধারায় আমদানিকারকের কোনো ভুল বা আমদানি দলিলে কোনো গরমিল থাকলে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকেও দায়ী করা হবে বলে ৮২ ধারায় এ রূপ লিখা হয়েছে। আমদানিকারকের দলিলে বা বিদেশ থেকে আমদানিকারকের কাছে প্রেরিত দলিলে কোনো গরমিল থাকলে তা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের জানার কথা নয়। তাই ধারাটি প্রত্যাহার করা উচিত। এই আইনে আরো যেসব অসঙ্গতি রয়েছে তা নিরসনে এফবিসিসিআই ও রাজস্ব বোর্ড আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ওই আইনের সংশোধনী আনা আবশ্যক।
এই বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬.৫-এ আনার যে প্রত্যাশা রাখা হয়েছে, তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষায় দেশের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে দেশীয় শিল্প উৎপাদন প্রবৃদ্ধির প্রয়াসে বিশেষ করে টেক্সটাইল সেক্টরে যথা প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান আবশ্যক। পাশাপাশি রফতানিশিল্প এবং দেশের যাবতীয় মেশিনারিজ/প্ল্যান্টস্ আমদানিতে সব প্রতিবন্ধকতার অবসান করে শুধু প্যাকিং লিস্ট মতে মেশিনারি চালান ছাড় দিয়ে তার যাবতীয় কার্যক্রম প্রতিস্থাপন ইত্যাদির তদারকি ভ্যাট বিভাগের ওপর ন্যস্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করি। যার ফলে চট্টগ্রাম কাস্টম ও ভ্যাট বিভাগের দ্বৈত আনুষ্ঠানিকতা পরিহার হবে। শুধু ভ্যাট বিভাগ শিল্পচালান মেশিনারিজ ইত্যাদি স্থাপন বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
বাজেট প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, যেহেতু কোনো মেশিনারিজ বা প্ল্যান্ট আমদানি হলে তা দেশের যেকোনো স্থানে প্রতিস্থাপন হবে এবং দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। জিডিপি বাড়বে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে। মেশিনারিজ বা শিল্পায়নে সরকার বহমুখী রাজস্ব আয়ের সুযোগ পাবে। মেশিনারি/প্ল্যান্ট এবং অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি আমদানির বহুরকম শর্ত প্রত্যাহার করে সবধরনের মেশিনারি/প্ল্যান্ট আমদানিতে বিদ্যমান হার ১ শতাংশ শুল্ক আদায়ে মেশিনারি আমদানি উন্মুক্ত করা উচিত।
বাজেটে ঘাটতি মোকাবেলায় দেশী-বিদেশী বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সচেতনতার প্রয়োজন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ ধরনের বাজেট প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বর্তমান সময়ে যথোপযুক্ত এবং সাহসী পদক্ষেপ হলেও তা বাস্তবায়নে যথাযথ তদারকি এবং নজরদারির প্রয়োজন রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।


আরো সংবাদ



premium cement