কালো অর্থনীতি ১৩২ লাখ কোটি টাকার
অর্থনীতি সমিতির ১২ লাখ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব- বিশেষ সংবাদদাতা
- ০৪ জুন ২০২৪, ০০:০০
বাংলাদেশ থেকে গত ৫০ বছরে ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। আর দেশে ৫০ বছরে সৃষ্ট কালো টাকার পরিমাণ হলো এক কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আগামী বাজেটে কালো টাকা ১০ হাজার কোটি টাকা এবং পাচারকৃত অর্থ পাঁচ হাজার কোটি টাকা উদ্ধারের সুপারিশ করেছে অর্থনীতি সমিতি।
২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বিকল্প বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনকালে সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো: আইনুল ইসলাম গতকাল এ তথ্য তুলে ধরেন। রাজধানীর ইস্কাটনস্থ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির অডিটোরিয়ামে গতকাল ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২৪-২৫ : উন্নত বাংলাদেশ অভিমুখী বাজেট’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। এ সময় অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ ও সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন।
মো: আইনুল ইসলাম বলেন, গত ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে সৃষ্ট মোট পুঞ্জীভূত কালো টাকার আনুমানিক পরিমাণ হবে এক কোটি ৩২ লাখ ৫৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে আমরা পুঞ্জীভূত মোট কালো টাকার মাত্র ০.৯৮ শতাংশ উদ্ধারের সুপারিশ করছি। যেখান থেকে উদ্ধারকৃত আহরণ হবে ১০ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে মোট পুঞ্জীভূত অর্থ পাচারের আনুমানিক পরিমাণ হবে ১১ লাখ ৯২ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। আর আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে আমরা পুঞ্জীভূত মোট অর্থপাচারের ০.৪৯ শতাংশ উদ্ধারের সুপারিশ করছি। যেখান থেকে উদ্ধারকৃত আহরণ হবে ৫ হাজার কোটি টাকা।
বিকল্প বাজেট প্রস্তাব : আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকার সম্প্রসারণশীল বিকল্প বাজেট পেশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় ১.৫৭ গুণ বেশি। প্রস্তাবনায় সমিতি বলছে, এখানে উন্নয়ন বরাদ্দ চলমান সরকারি বাজেটের তুলনায় ২.১ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৩০৩ কোটি টাকায় উন্নীত হবে। আর পরিচালন বরাদ্দ (যার ৮০-৮৫ শতাংশ বেতন-ভাতা) এখনকার তুলনায় ১.২৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ১৮৩ কোটি টাকায় উন্নীত হবে। সরকারের রাজস্ব আয় থেকে আসবে ১০ লাখ ২৪ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মোট বাজেট বরাদ্দের ৯২.১৩ শতাংশের জোগান দেবে সরকারের রাজস্ব আয়। আর বাজেটের বাকি ৭.৮৭ শতাংশ অর্থাৎ এক লাখ ৭০ হাজার ৭১৯ কোটি টাকার ঘাটতি অর্থায়ন জোগান দেবে সম্মিলিতভাবে বন্ড বাজার। উল্লেখ্য, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ২০ লাখ ৯৪ হাজার ১১২ কোটি টাকার বিকল্প বাজেট প্রস্তাব দিয়েছিল সমিতি।
বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, আয় বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য, পুষ্টি বৈষম্য, স্বাস্থ্য বৈষম্য, শিক্ষা বৈষম্য, আবাসন বৈষম্যসহ বহুমাত্রিক বৈষম্য নিরসন করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি এবং প্রকৃত মজুরি-আয় বৃদ্ধি না হওয়ার কারণে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দুর্দশা বাড়ছে। এসব রোধ করতে হবে। সরকারিভাবেই শোভন মজুরির ব্যাপক কর্মসংস্থান-সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের সুপারিশ সংখ্যা ৩৬১টি। এখানে ২৪টি মূল পয়েন্ট উপস্থাপন করা হয়েছে। বিকল্প বাজেটের মূল লক্ষ্য-অভীষ্টগুলো হচ্ছে, আগামী ১০ বছরের মধ্যে (অর্থাৎ ২০৩৪ সাল নাগাদ) দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে (৭০-৮০ শতাংশ) একটি আলোকিত-শক্তিশালী-টেকসই মধ্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে রূপান্তর করা। এ ছাড়া দেশে বৈষম্য-অসমতা-বহুমুখী দারিদ্র্য সম্ভাব্য-সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা। পরজীবী-লুটেরা ধনীক শ্রেণীর সম্পদের যৌক্তিক অংশ দরিদ্র-প্রান্তিক-নি¤œবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের কাছে প্রবাহিত করা। দেশজ অর্থনীতিকে উন্নয়নকৌশলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া। দেশজ অর্থনীতির মধ্যে কৃষিকে কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া।
উপস্থাপনায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, বিকল্প বাজেট সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ (প্রস্তাবিত বাজেটে মোট বরাদ্দের ৬.৯৪ শতাংশ), শিক্ষা ও প্রযুক্তি (১২.৮৮ শতাংশ), কৃষি (৫.৮৯ শতাংশ), জনপ্রশাসন (২২.৭১ শতাংশ), স্বাস্থ্য (৫.২০ শতাংশ), পরিবহন ও যোগাযোগ (২.৪৬ শতাংশ), সুদ (২৩.৩০ শতাংশ), স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন (১.৩৯ শতাংশ), গণপরিবহন (৪.৮ শতাংশ), গৃহায়ণ (০.৩৪ শতাংশ), বিদ্যুৎ ও জ্বালানি (০.০৬ শতাংশ), গবেষণা-উদ্ভাবন-বিচ্ছুরণ ও উন্নয়ন (৩.৮ শতাংশ), শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিস (০.৯৪ শতাংশ), জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা (৫.১৪ শতাংশ), প্রতিরক্ষা (৬.১ শতাংশ), বিবিধ ব্যয় (১.৩৫ শতাংশ), বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম (০.৫৯ শতাংশ) (সংস্কৃতি ও ধর্মকে আমরা একবন্ধনী খাত থেকে দুটি ভিন্ন খাত হিসেবে প্রস্তাব করেছি)। শিক্ষা ও প্রযুক্তিখাতে চলতি অর্থবছর ২০২৩-২৪ এর বাজেটে সরকারের মোট বরাদ্দ (পরিচালন+উন্নয়ন) ছিল এক লাখ চার হাজার ১৩৭ কোটি টাকা।
বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ প্রস্তাব : স্বাস্থ্যখাতে বর্তমান (২০২৩-২৪ অর্থবছরে) সরকারি বরাদ্দ ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ ১.৯৪ গুণ বৃদ্ধি করে ৭৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছে। সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণ খাতে এখন সরকারি বরাদ্দ ৪০ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা। এই বরাদ্দ ৪.২২ গুণ বাড়িয়ে এক লাখ ৭০ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা প্রস্তাব করেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সরকারি বরাদ্দ এখন ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা। এ বরাদ্দ বৃদ্ধি করে ৪৭ হাজার ২০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব করেছে সমিতি। পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে বর্তমান সরকারি বরাদ্দ (২০২৩-২৪ অর্থবছরে) ৮৭ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা। বিকল্প বাজেটে সমিতি এ বরাদ্দ ১.২৯ গুণ বৃদ্ধি করে এক লাখ ১৩ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা প্রস্তাব করেছে।
চলতি বাজেটে বৈদেশিক ঋণের সুদ খাতে সরকারের বরাদ্দ ১২ হাজার ৩৭৬ কোটি টাকা। সমিতি প্রস্তাব করছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। তারা বলেন, আমরা বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল যত দ্রুত সম্ভব পরিশোধ করতে চাই।
বাজেটে আয় বৃদ্ধির ২৭ খাত : বাজেটে আয় বৃদ্ধির জন্য সমিতির প্রস্তাবিত ২৭টি নতুন উৎস হলো, কালো টাকা উদ্ধার থেকে প্রাপ্তি, অর্থপাচার উদ্ধার থেকে প্রাপ্তি, সম্পদ কর, অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর (অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্যসহ), বিলাসী দ্রব্য/ পণ্যের ওপর কর, সংসদ সদস্যসহ অন্যদের ওপর গাড়ির শুল্ক মওকুফ বাতিল-উদ্ভূত আহরণ, বিদেশী নাগরিকদের ওপর কর, সেবা থেকে প্রাপ্ত কর, বিমান পরিবহন ও ভ্রমণ কর, রয়্যালটি ও সম্পদ থেকে আয়, প্রতিরক্ষাবাবদ প্রাপ্তি, রেলপথ, ডাক বিভাগ, সরকারের সম্পদ বিক্রয়, সেচবাবদ প্রাপ্তি, তার ও টেলিফোন বোর্ড, টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন, ইনস্যুরেন্স রেগুলেটরি কমিশন, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিআইডাব্লিউটিএ, পৌর হোল্ডিং কর, ডিজি হেলথ : বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার অনুমতি ও নবায়ন ফি, ডিজি ড্রাগস : ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির লাইসেন্স এবং নবায়ন ফি, বিউটিপার্লার সেবালব্ধ কর, আবাসিক হোটেল/ গেস্ট হাউস ক্যাপাসিটি কর এবং বিদেশী পরামর্শ ফি।
প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটে সমিতি বলছে, সরকারের ঘাটতি অর্থায়ন জোগান দেবে সম্মিলিতভাবে বন্ড বাজার (মোট ৯৫ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ ঘাটতি অর্থায়নের ৫৬.১ শতাংশ), সঞ্চয়পত্র বিক্রয় থেকে ঋণ গ্রহণ (মোট ২৫ হাজার কোটি টাকা; ঘাটতি অর্থায়নের ১৪.৬ শতাংশ) এবং সরকারি-বেসরকারি যৌথ অংশীদারিত্ব (মোট ৫০ হাজার কোটি টাকা, যেখান থেকে আসবে ঘাটতি অর্থায়নের ২৯.৩ শতাংশ)। তবে সমিতির প্রস্তাবে ঘাটতি অর্থায়নে বৈদেশিক ঋণ নিটের কোনো ভূমিকা থাকবে না। যা চলতি অর্থবছরের সরকারি বাজেটে ঘাটতি পূরণে ৩৯.৫ শতাংশ ভূমিকা রাখতে পারে। অর্থাৎ আমাদের বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য আমরা বৈদেশিক ঋণের দ্বারস্থ হতে চাই না। আবার একই সাথে বাজেটের ঘাটতি পূরণে আমরা দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব রাখিনি। কারণ, দেশীয় ব্যাংকের ঋণ অন্য কাজে ব্যবহার করা হবে। সরকারের চলতি বাজেটে ঘাটতি পূরণে দেশীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার কথা মোট ঘাটতির ৪৪ শতাংশ। প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেট অর্থায়নে কোনো বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হবে না। সুদাসলসহ বৈদেশিক ঋণ থেকে মুক্ত হওয়ার পক্ষে আমাদের অবস্থান।
দুষ্টচক্র সব জায়গায় বিরাজ করছে : দুষ্টচক্র পেঁয়াজ, আলু ও ডলারের বাজারে যেমন আছে, তেমনি ব্যাংক খাতেও আছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি বলেন, সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় যেতে পারেননি অনেক কর্মী। সব জায়গায় বিরাজ করছে দুষ্টচক্র। যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়তে চাই, তাহলে আগে এই দুষ্টচক্রকে রোধ করতে হবে। তা না হলে তারা যেভাবে বিভিন্ন বাজার দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে, আমাদের অগ্রগতি হবে না।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, দুষ্টচক্রের কারণে সরকার যেটা চাচ্ছে, সেটাও হবে না। আমরা চাই দুষ্টচক্রকে দমন করে এগিয়ে যেতে। তিনি বলেন, ব্যাংকিংয়ে যারা ঋণ দেন, যারা ঋণ নেন তাদের মধ্যেও এ চক্র আছে। এ ছাড়াও কোনো কোনো ব্যক্তি অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছে। এদের দমন করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা পরামর্শ দেই, কিন্তু আমরা তো আর সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, বাস্তবায়ন করেন, তারা কাজটি করছেন কি না সেটা দেখতে হবে। তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থনীতি সমিতির সভাপতি বলেন, দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকারের নীতি শূন্য, কিন্তু দেশে দুর্নীতি বহুল বিস্তৃত। এ জঞ্জাল না সরাতে পারলে কাক্সিক্ষত পথে দেশ এগিয়ে চলা কঠিন হবে। সম্প্রতি দু-একজন রাঘববোয়ালের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কারণে শুরু করা পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। তিনি বলেন, আশা করি তা চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবে, অতীতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে সেরকম এবারের অভিযান যেন মাঝে থেমে না যায়। বড় বড় দুর্নীতিবাজকেও জবাবদিহির আওতায় আনা হোক।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা