১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

চাপ বাড়ছে বিদেশী দেনা পরিশোধের

বাড়ছে ঋণের সুদ : কমছে রিজার্ভ
-


বিদেশী ঋণ পরিশোধে চাপ বাড়ছে। ডলার সঙ্কটের কারণে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কাক্সিক্ষত হারে বকেয়া পরিশোধ করা যাচ্ছে না। বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো তাদের আয় বৈদেশিক মুদ্রায় দেশে নিতে পারছে না। অনেক বিদেশী প্রতিষ্ঠান বছর শেষে মুনাফা নিতে পারছে না। অন্য দিকে বড় বড় মেগা প্রকল্পগুলোর চলমান ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। দিন দিন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। যেখানে বছর দুয়েক আগেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সেখানে এখন ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৩ বিলিয়নের কাছাকাছি। এ দিকে কাক্সিক্ষত হারে বিদেশী ঋণ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যে পরিমাণ বিদেশী ঋণ নেয়া হচ্ছে, তার বেশির ভাগ অংশই ব্যয় করা হচ্ছে ঋণ ও সুদ পরিশোধে। এমনি পরিস্থিতিতে বৈদেশিক ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানে যাচ্ছে সরকার। আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে আনা, রিজার্ভ বাড়ানোর মতো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের দুই বছরে ব্যবসায়িক মন্দার কারণে বেসরকারি পর্যায়ে নিয়মিত বিদেশী ঋণ পরিশোধে কিছুটা শিথিলতা আনা হয়। পণ্য আমদানি ব্যয় বকেয়া রাখার সুযোগ দেয়া হয়। আর এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রায় দেনার পরিমাণ বেড়ে গেছে। অন্য দিকে সরকার যে ইতোমধ্যে যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং এখনো করছে তার কিস্তিও পরিশোধ করতে হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়ায় ডলারের লেনদেন নিষেধাজ্ঞা থাকায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দায় পরিশোধ করা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে ৬০ কোটি ডলার বকেয়া রয়েছে। এ অর্থ এখনো পরিশোধ করা হয়নি। জটিলতা কাটলে এ অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক পরিসংখ্যান মতে, প্রতি বছর সরকার যে পরিমাণ বিদেশী ঋণ নিচ্ছে, তার বেশির ভাগই সুদ-আসলসহ ঋণ পরিশোধেই ব্যয় হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) সরকার ঋণ পরিশোধ করেছে ২৫৭ কোটি ডলার, যা টাকার অঙ্কে ২৮ হাজার ২৮১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। আগের বছরের একই সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ১৬ হাজার ৬৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা; অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। ঋণ শোধের পরিমাণ বৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখছে সুদ পরিশোধ। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে ঋণের বিপরীতে শুধু সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১১ হাজার ৬০১ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি। আর ডলারের হিসাবে সুদ পরিশোধ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। মূলত টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আগের বছরগুলোতে নেয়া ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে বেশি। ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকার যে ঋণ পরিশোধ করেছে তার মধ্যে আসল ঋণ ১৬ হাজার ৬৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। বাকি ১১ হাজার ৬০১ কোটি কোটি ৮৩ লাখ টাকা সুদ বাবদ দিতে হয়েছে। কিন্তু গত অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ১৬ হাজার ৯৬৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে আসল ছিল ১২ হাজার ২০২ কোটি ১৬ লাখ টাকা। আর সুদ পরিশোধ করতে হয়েছিল চার হাজার ৭৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা; অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরের যেখানে চার হাজার ৭৬৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা সুদ দিতে হয়েছিল, সেখানে চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে তার প্রায় দ্বিগুণ। এ সময়ে ডলারের হিসাবে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ২৫৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার, যা আগের বছরে ছিল ১৭৩ কোটি তিন লাখ ডলার; অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ৮৩ কোটি ডলার। এ সময় ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে ১০৫ কোটি ৪৯ লাখ ডলার। আগের বছর তা ছিল ৪৮ কোটি ৫৯ লাখ ডলার; অর্থাৎ ডলারের হিসাবে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৫৭ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে অর্থপ্রদানের জটিলতার কারণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের বিপরীতে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। এ ছাড়া এমআরটি ও মাতারবাড়িসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন পুরোদমে চলছে। এর ফলে এসব প্রকল্পে বিতরণ বাড়ছে। ফলে চলতি অর্থবছরে প্রকল্প ঋণের সুদ পরিশোধ হবে। পাশাপাশি, সুদ গত অর্থবছর প্রাপ্ত বাজেট সহায়তাও পরিশোধ করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক সুদে বা এখনকার চেয়ে বেশি সুদে বিদেশী ঋণ নিতে হবে। তাই স্নাতক হওয়ার আগেই স্বল্প সুদে বেশি ঋণ দিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গতিশীল করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণে প্রতি বছরই ফেরত যাচ্ছে বিদেশী ঋণের অর্থ। ফলে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ও বিতরণ বাড়ছে না।
এ দিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় প্রতি মাসেই কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দেশে বর্তমানে মোট রিজার্ভ প্রায় ২৩ বিলিয়ন দাবি করলেও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফের হিসাবে রিজার্ভ আছে ১৮ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন দু’টি পদ্ধতিতে রিজার্ভ হিসাব করে থাকে। আর ব্যবহারযোগ্য (নিট) রিজার্ভ কমে এক হাজার ৩০০ কোটি (১৩ বিলিয়ন) ডলারের নিচে নেমেছে। আগামী অর্থবছরে রিজার্ভকে ৩২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে অর্থ বিভাগ। এ জন্য রিজার্ভের অর্থ ব্যয়ে কঠোরতা অবলম্বন করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের হিসাবে ‘রাশিয়া থেকে গৃহীত ঋণ এবং মেগা প্রকল্পের বৃহৎ ঋণ পরিশোধের জন্য নির্ধারিত থাকায় ২০২৬-২৭ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধের অঙ্ক বৃদ্ধি পাবে। সেই বছরে ৫৩ কোটি ১০ লাখ ডলার পরিশোধ করার কথা রয়েছে। এরপর ২০২৭-২৮ অর্থবছরে ৫১ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০২৮-২৯ সালে ৫০ কোটি ৭০ লাখ ডলার শোধ করার হিসাব করা হয়েছে; যে কারণে আগামী তিন অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে সাশ্রয়ের একটি প্রধান রাস্তা হচ্ছে আমদানি ব্যয়ের প্রবৃদ্ধিকে সঙ্কুচিত করা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রার প্রবৃদ্ধি ১৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। সম্প্রতি অর্থনৈতিক কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে এ প্রবৃদ্ধি সংশোধন করে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এ খাতের ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি না বাড়িয়ে ১০ শতাংশের ঘরে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি ২০২৫-২৬ ও ২০২৬-২৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৯ শতাংশ ও ৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে; অর্থাৎ ২০২৪-২০২৭ অর্থবছরে আমদানি খাতে ব্যয়ে এক ধরনের লাগাম টেনে দেয়া হচ্ছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, আমদানি ব্যয় কমানো হলে রফতানি আয়ও কমে যাবে। কারণ পোশাক খাতে যে পরিমাণ রফতানি করা হয়, তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আবার কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়। এখন আমদানি ব্যয় কমানো হলে রফতানিও কমে যাবে। অন্য দিকে আমদানি কমানো হলে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমে যাবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানে। সব মিলেই অর্থনীতি এখন কঠিন এক সমীকরণের মধ্যে পড়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য কৌশলগত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে হবে নীতিনির্ধারকদের।


আরো সংবাদ



premium cement