গাজাজুড়ে ইসরাইলের হামলা : নিহত ৫০
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২৫ মে ২০২৪, ০২:১১
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের বর্বর হামলায় আরো অন্তত ৫০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডজুড়ে চালানো পৃথক হামলায় তারা নিহত হন। ইসরাইলি হামলার জেরে এখন পর্যন্ত রাফা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন আট লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি। এএফপি, বিবিসি, আলজাজিরা।
ইসরাইলি বাহিনী গাজা উপত্যকাজুড়ে আকাশ ও স্থলপথে চালানো হামলায় কমপক্ষে ৫০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাতে হামাসের নেতৃত্বাধীন যোদ্ধাদের সাথে ইসরাইলি সেনাদের ব্যাপক লড়াই চলছে বলেও জানিয়েছেন স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ও হামাস। ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর ট্যাংকগুলো রাফার আরো দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছে, শহরের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা ইবনার দিকে অগ্রসর হয়েছে এবং তিনটি পূর্ব শহরতলিতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে বলে বাসিন্দারা বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘দখলদার (ইসরাইলি বাহিনী) আরো পশ্চিমে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তারা ইবনার প্রান্তে রয়েছে, যা ঘনবসতিপূর্ণ। তারা এখনো এটি আক্রমণ করেনি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, এবং আমরা দেখছি যে সেনারা আক্রমণ করেছে এবং সেখান থেকে কালো ধোঁয়া উঠছে। এটি আরেকটি খুব কঠিন রাত ছিল।’ এই মাসে গাজার উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে একযোগে ইসরাইলি হামলার ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে এবং ইসরাইলি বাহিনী সাহায্য প্রবেশের প্রধান প্রবেশ পথও বন্ধ করে দিয়েছে, যা দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিও বাড়িয়েছে।
ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা ছাড়াই রাফাতে স্থল হামলা শুরু করার বিরুদ্ধে সতর্ক করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যরা গাজার দক্ষিণের এ শহরটিতে হামলার জন্য ইসরাইলকে ব্যাপকভাবে সমালোচনাও করেছে। তবে ইসরাইল বলেছে, সেখানে হামাস যোদ্ধাদের বেশ কয়েকটি ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে তাদের অবশ্যই অগ্রসর হতে হবে।
গাজায় পরিচালিত প্রধান সাহায্য সংস্থা ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিস বলছে, চলতি মে মাসের প্রথম দিকে ইসরাইল রাফাহ শহরটিতে হামলা শুরু করার পর থেকে গত সোমবার পর্যন্ত আট লাখেরও বেশি মানুষ রাফা থেকে চলে গেছেন।
গাজায় নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের জরুরি প্রতিক্রিয়া নেতা সুজে ভ্যান মিগান বলেছেন, অনেক বেসামরিক নাগরিক এখনো সেখানে আটকে আছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘রাফাহ শহরটি এখন তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিশ্বের সমন্বয়ে গঠিত : পূর্ব দিকটি মৌলিক যুদ্ধ অঞ্চল, মাঝামাঝি অঞ্চলটি ভৌতিক শহরে পরিণত হয়েছে এবং পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থানরত জনবহুল জনগোষ্ঠী শোচনীয় পরিস্থিতিতে বসবাস করছে।’
সমান্তরালভাবে ইসরাইলি বাহিনী উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী শিবিরেও স্থল আক্রমণ বাড়িয়েছে। সেখানে তারা বেশ কয়েকটি আবাসিক এলাকাও ধ্বংস করেছে। নিকটবর্তী শহর বেইট হানুনেও হামলা করেছে ইসরাইল। ইসরাইল অবশ্য কয়েক মাস আগেও এ অঞ্চলে বড় ধরনের অভিযান চালিয়েছে। কিন্তু এখন তাদের দাবি, হামাসকে সেখানে আবার সংগঠিত হতে বাধা দিতে তাদের আবারো ফিরে আসতে হয়েছে। ফিলিস্তিনের সরকারি বার্তাসংস্থা ওয়াফা জানিয়েছে, মধ্য গাজা উপত্যকার দেইর আল-বালাহ শহরের পূর্বে অবস্থিত জনকল্যাণবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি দোকানে বিমান হামলায় অন্তত ১২ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার সিভিল ডিফেন্স এজেন্সি জানিয়েছে, ভোরের দিকে চালানো দু’টি বিমান হামলায় গাজা শহরে ১৫ শিশুসহ আরো ২৬ জন নিহত হয়েছেন।
সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেছেন, এর মধ্যে একটি হামলায় গাজার একটি পরিবারের বাড়িতে বোমা আঘাত হানে। ওই হামলায় আল-দারাজ এলাকায় ১৬ জন নিহত হয় এবং মসজিদ প্রাঙ্গণে চালানো আরেকটি হামলায় ১০ জন নিহত হয়।
মধ্য গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে একটি বাড়িতে ইসরাইলি হামলায় আরো আটজন নিহত হয়েছেন। গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা শহরের আবাসিক জেলাগুলো সফর করার সময় ইসরাইলি হামলায় দিয়া আলদিন আল-শুরাফা নামের একজন সিনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
নৃশংস হামলার পাশাপাশি ইসরাইল খাবার পানীয়, খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি সরবরাহের ওপরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে এবং গাজাজুড়ে বেশ কয়েকটি হাসপাতালও বন্ধ করতে বাধ্য করেছে তারা। বৃহস্পতিবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, দেইর আল-বালাহর আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে বিদ্যুৎ জেনারেটরে ‘কয়েক মিনিটের’ জ্বালানি অবশিষ্ট রয়েছে। জ্বালানি শেষ হলে এক হাজার ৩০০ জন রোগীর সেবাও শিগগিরই বন্ধ হয়ে যাবে।
জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গাজায় যদি বিপুল পরিমাণে ত্রাণ প্রবেশ শুরু না হয়, তা হলে হতাশা ও ক্ষুধা ছড়িয়ে পড়বে’ বলে জাতিসঙ্ঘের মানবিকবিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয় হুঁশিয়ারি দিয়েছে।
তিনি রাফাহ ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া এবং দক্ষিণ গাজার কারেম আবু সালেম (কেরেম শালোম) ক্রসিংয়ের সীমিত কার্যকারিতাকে ‘জীবন রক্ষাকারী সহায়তা সরবরাহের প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া’ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। জাতিসঙ্ঘ এর আগে বলেছিল, বিপদের কারণে তারা দক্ষিণ গাজায় আর খাদ্য বিতরণ করতে পারবে না।
ডুজারিক বলেন, রাফাহ ক্রসিং ক্রমাগতভাবে বন্ধ থাকার কারণে গাজার হাসপাতালে জ্বালানি ও ওষুধের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গত ৬ মে ইসরাইলি বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন রুটের ফিলিস্তিনি অংশ দখল করার পর থেকে এটি বন্ধ রয়েছে।
এ দিকে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলেছে, গত বুধবার যুদ্ধে তাদের আরো তিন সৈন্য নিহত হয়েছে। এতে গত ২০ অক্টোবর থেকে গাজায় স্থল অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে নিহত ইসরাইলি সেনাদের সংখ্যা বেড়ে ২৮৬ জনে পৌঁছেছে। অন্য দিকে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলের আগ্রাসনে ৩৫ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরো প্রায় ৮০ হাজার মানুষ।
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরের বিষয়ে অভিমত জানাবেন আন্তর্জাতিক বিচারালয় (আইসিজে)। যুদ্ধবিরতি কার্যকরে ইসরাইলকে নির্দেশ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকার অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিমত জানানো হবে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘের শীর্ষ আদালত।
রাফাহ শহরসহ গাজায় হামলা চালিয়েই যাচ্ছে ইসরাইল। গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের সামরিক অভিযান বন্ধের নির্দেশ দেয়ার জন্য সম্প্রতি আইসিজেতে আবেদন করে দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে রায় বাস্তবায়নের সক্ষমতা নেই এই আদালতের। এর আগে রাশিয়াকে ইউক্রেনে হামলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন আইসিজে, তবে তাতে সায় দেয়নি মস্কো। তবে আইসিজে ইসরাইলের বিরুদ্ধে রায় দিলে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক আইনি চাপ বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। গত সপ্তাহের শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকা অভিযোগ করে, রাফাতে স্থল অভিযানের মধ্য দিয়ে গাজায় চালানো ইসরাইলি গণহত্যা একটি নতুন ও ভয়ঙ্কর পর্যায়ে চলে গেছে। আদালতে শুনানিতে দক্ষিণ আফ্রিকার আইনজীবী ভন লউই বলেন, রাফাহর অভিযান গাজা ও এর ফিলিস্তিনি জনগণের ধ্বংসের শেষ পদক্ষেপ। গণহত্যা থেকে ফিলিস্তিনের জনগণের সুরক্ষা প্রয়োজন। আর এই আদালত যুদ্ধবিরতির নির্দেশ দিতে পারেন। তবে ইসরাইলের আইনজীবীরা দক্ষিণ আফ্রিকার মামলাটিকে ‘বাস্তবতাবিবর্জিত’ আখ্যা দেন এবং ১৯৪৮ সালের গণহত্যা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ নিয়ে বিদ্রুপ করেন।
ইসরাইলের শীর্ষ আইনজীবী গিলাদ নোয়াম বলেন, কোনো বিষয়কে বারবার গণহত্যা বললে তা গণহত্যা হয়ে যায় না। মিথ্যার পুনরাবৃত্তি করলে তা সত্য হয়ে যায় না। একটা মর্মান্তিক যুদ্ধ চলছে, তবে কোনো গণহত্যা হচ্ছে না। প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতা করে চলতি মাসের শুরুতে রাফাহর কিছু অংশে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরাইল। হামাসের সুড়ঙ্গ ও যোদ্ধাদের নির্মূলের অজুহাত দেখিয়ে শহরটি থেকে ব্যাপক পরিসরে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় তেল আবিব। এর পরিপ্রেক্ষিতে আট লাখের বেশি মানুষ নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয় বলে জানিয়েছে জাতিসঙ্ঘ।
গাজা থেকে আরো ৩ ইসরাইলি বন্দীর লাশ উদ্ধারের দাবি
রয়টার্স জানায়, ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা থেকে আরো তিন ইসরাইলি বন্দীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত ৭ অক্টোবর হামলার সময় তাদের হত্যার পর লাশ গাজায় নিয়ে গিয়েছিল হামাস। গতকাল শুক্রবার তাদের লাশ উদ্ধারের দাবি করেছে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলেছে, হানান ইয়াবলঙ্কা, মিশেল নিসেনবাউম ও ওরিয়ন হার্নান্দেজ রাডক্সের লাশ উত্তর গাজার জাবালিয়া থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ অভিযানে গতকাল রাতে তাদের লাশ উদ্ধার করা হয়। এই জাবালিয়ায় কয়েক দিন ধরে ইসরাইলি বাহিনী এবং হামাসের যোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে।
ইসরাইলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, গাজায় বন্দী বাকি বন্দীদের ফিরিয়ে আনতে ইসরাইল বদ্ধপরিকর। তিন বন্দীর লাশ উদ্ধারের ঘোষণা দিয়ে তিনি টেলিভিশন বিবৃতিতে বলেন, আমরা তাদের মুক্তির জন্য লড়াই বন্ধ করব না। প্রতিটি ভদ্র দেশ এই একই কাজ করবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা