মোদির ভারতে মুসলিম পরিচয় যেন নিজ দেশেই আগন্তুক
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৯ মে ২০২৪, ০০:০০
আপনার দেশের নেতারা আপনাকে দেখতে চান না, এই উপলব্ধি যেন এক নিঃসঙ্গ অনুভূতি। বর্তমানে অনেকাংশেই হিন্দুপ্রধান ভারতে আপনি একজন মুসলিম হলে অপমানিত হতে হবে।
সব ক্ষেত্রেই একই চিত্র। কয়েক দশক ধরে আপন, এমন বন্ধুরাও বদলে যায়। প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করা থেকে বিরত থাকে- তারা আর কোনো উৎসবে যোগ দেয় না অথবা কষ্টের সময়ে সমস্যার কথা জানতে দরজায় কড়া নাড়ে না।
‘এটা প্রাণহীন এক জীবন,’ বলছিলেন জিয়া উস সালাম নামের এক লেখক, যিনি দিল্লির উপকণ্ঠে স্ত্রী উজমা আউসফ এবং চার কন্যার সাথে বসবাস করেন।
এক সময় ভারতের অন্যতম প্রধান সংবাদপত্রের জন্য চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে কাজ করা ৫৩ বছর বয়সী সালাম তার সময় সিনেমা, শিল্প, সঙ্গীতেই কাটিয়ে দিতেন। দীর্ঘ আড্ডার জন্য একটি প্রিয় খাবারের স্টলে একজন পুরনো বন্ধুর মোটরসাইকেলের পিছনে চড়ে কাজের দিনগুলো শেষ হত তার। সালামের স্ত্রী-ও সাংবাদিক ছিলেন যিনি লাইফ, ফুড, ফ্যাশন নিয়ে লিখতেন।
এখন সালামের রুটিন কেবল অফিস এবং বাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ। গভীর উদ্বেগ তার ভাবনার জায়গাগুলো দখল করেছে। তিনি বলেন, ‘দৃশ্যমান মুসলিম’ হওয়ার কারণে ব্যাংক টেলার, পার্কিং লট অ্যাটেনডেন্ট, ট্রেনের সহযাত্রীদের দ্বারা ক্রমাগত এমন জাতিগত প্রোফাইলিং তাকে ক্লান্ত করে তুলেছে।
পারিবারিক গল্পগুলো আরো কষ্টকর, যেখানে সালাম দম্পতি এমন একটি দেশে নিজেদের কন্যাদের লালন-পালন করছেন যেখানে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রশ্ন তোলা হয় কিংবা এমনকি মুসলিমদের পরিচয়ের চিহ্নগুলোকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এসবের মধ্যে তারা কিভাবে পোশাক পরে, তারা কী খায়, এমনকি তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
তাদের মধ্যে এক কন্যাকে এসব বিষয় নিয়ে এতটাই লড়াই করতে হয়েছিল যে, তার কাউন্সেলিংয়ের প্রয়োজন হয়েছিল এবং সে কয়েক মাস স্কুলেও যেতে পারেনি। দিল্লির ঠিক বাইরে নয়ডায় মিশ্র হিন্দু-মুসলিম পাড়ায় থাকাটা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে পরিবারটিতে প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক হয়। তাদের সবচেয়ে বড় কন্যা মরিয়ম (স্নাতক শিক্ষার্থী) জীবনকে সহনীয় করে তোলার জন্য যেকোনো কিছুতে আপস করে নেয়ার চেষ্টা করে। সে তার জীবন এগিয়ে নিতে চায়।
মুসলিম এলাকা ব্যতীত অন্য যেকোনো জায়গায় বসবাস করা তাদের জন্য কঠিন হতে পারে। রিয়েল এস্টেট এজেন্টরা প্রায়ই সরাসরি জিজ্ঞাসা করে বসে যে, পরিবারগুলো মুসলিম কিনা; বাড়িওয়ালারা মুসলিম শুনলে তাদের ভাড়া দিতে নারাজ। মরিয়ম বলেন, আমি এসবে মানিয়ে নিতে শুরু করেছি।
“আমি মানছি না,” সালাম মেয়ে মরিয়মের কথার বিরোধিতা করে বলছিলেন। তিনি এটা স্মরণ করার জন্য যথেষ্ট বয়সী যে, আগে কবে বিশাল বৈচিত্র্যময় ভারতে সহাবস্থান ছিল মূল আদর্শ। তিনি দেশের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতায় যুক্ত হতে চান না। তবে তিনি বাস্তববাদীও বটে। তিনি চান মরিয়ম বিদেশে পাড়ি জমাক, অন্তত দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে। সালাম এই আশাকে আঁকড়ে ধরে আছেন যে ভারতে এটি একটি ক্ষণস্থায়ী পর্যায়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য লম্বা খেলা খেলছেন।
দ্রুত উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিতে ২০১৪ জাতীয় ক্ষমতায় তার উত্থান, দশক পুরনো হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ভারতীয় রাজনীতির প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে দৃঢ়ভাবে নিয়ে আসেন। এর পর থেকে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো এবং শক্তিশালী গণতন্ত্র থেকে সরে এসেছেন। যে ব্যবস্থা কখনো কখনো বিস্ফোরক ধর্মীয় এবং জাতিগত বিভাজন থাকা সত্ত্বেও ভারতকে দীর্ঘদিন ধরে একত্র করে রেখেছিল।
দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলো ভারতীয় সমাজকে পুনর্নির্মাণের চেষ্টায় মোদির চার পাশের বিশাল শক্তিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সরকার সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে তাদের সদস্যরা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের উসকানি দেয়। পরে তাদের মুসলমানদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিতে এবং মুসলিম পুরুষদের ধরপাকড় করতে দেখা যায়।
অতি উৎসুক কিছু গোষ্ঠী গরুর গোশত পাচারের অভিযোগে মুসলমানদের পিটিয়ে হত্যা করেছে (অনেক হিন্দুর কাছে গরু পবিত্র)। মোদির দলের শীর্ষ নেতাদের প্রকাশ্যে হিন্দুদের সাথে উদযাপন করতে দেখা গেছে যারা কিনা মুসলমানদের বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে।
সম্প্রচার গণমাধ্যমের বৃহৎ অংশে, বিশেষ করে সোস্যাল মিডিয়ায় ধর্মান্ধতা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ে। মুসলিম পুরুষরা হিন্দু নারীদের ধর্মান্তরিত করার জন্য প্রলুব্ধ করে, এমনকি রেস্তোরাঁর খাবারে মুসলমানরা থুথু ফেলে- এমন সব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়ে দেয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলো থেকে।
মোদি এবং তার দলের নেতারা ভারতীয়দের সমানভাবে গণ্য করে এমন কল্যাণমূলক কর্মসূচির দিকে ইঙ্গিত করে বৈষম্যের দাবি প্রত্যাখ্যান করলেও মোদি নিজেই এখন পরের মাসের শুরুতে শেষ হতে যাওয়া নির্বাচনে মুসলিমবিরোধী উপমার পুনরাবৃত্তি করছেন। তিনি ভারতের ২০ কোটি মুসলমানকে আগের চেয়ে আরো বেশি সরাসরিভাবে টার্গেট করেছেন, তাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেছেন এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তাদের অনেক সন্তান রয়েছে।
এই ‘ক্রিপিং ইসলামোফোবিয়া’ই এখন সালামের লেখনীর প্রধান বিষয়। সিনেমা, সঙ্গীত, জীবনের আনন্দ, এখন সবই ছোট মনে হয়। একটি বইয়ে, তিনি মুসলিম পুরুষদের হত্যার ঘটনাবলি বর্ণনা করেছেন। সাম্প্রতিক একটি ফলো-আপে, তিনি বর্ণনা করেছেন, কিভাবে ভারতের মুসলমানরা নিজেদের জন্মভূমিতে নিজেদের ‘অনাথ’ ভাবছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যদি এই ইস্যুগুলো নিয়ে না লিখি, কেবল সিনেমা ও সাহিত্যেই নিজ শক্তি সীমাবদ্ধ করি, তাহলে নিজেকে আয়নায় দেখতে পারব না। ভবিষ্যতে আমি আমার সন্তানদের কী জবাব দেবো- যখন আমার নাতি-নাতনীরা জিজ্ঞাসা করবে, অস্তিত্বের সঙ্কটের সময়ে আপনি কী করতেন?’
ছোটবেলায় সালাম দিল্লিতে হিন্দু, শিখ ও মুসলমান রয়েছেন- এমন রাস্তায় সময় কাটাতেন। বিকেলে রোদ তপ্ত হয়ে উঠলে শিশুরা হিন্দু মন্দিরের আঙিনায় গাছের ছায়ায় খেলাধুলা করত। মন্দিরের পুরোহিত সবার জন্য পানি নিয়ে আসতেন। “আমি তার কাছে অন্য শিশুদের মতোই ছিলাম,” সালাম স্মরণ করছিলেন।
সেই স্মৃতিগুলো একটি কারণ- যেসবের জন্য সালাম এই দৃঢ় আশাবাদ বজায় রেখেছেন যে ভারত তার ধর্মনিরপেক্ষতার পোশাক পুনরুদ্ধার করতে পারে। আরেকটি হলো দেশের বৃহৎ অংশে মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদ নির্বিচারে চললেও দেশটির অধিক সমৃদ্ধ দক্ষিণের বেশ কয়েকটি রাজ্য তা প্রতিরোধের মুখে পড়েছে।
সেখানে মুসলমানদের মধ্যে পারিবারিক কথোপকথনও অন্য রকম: কলেজ ডিগ্রি, চাকরির পদোন্নতি, জীবন পরিকল্পনা- স্বাভাবিক আশা-আকাক্সক্ষা নিয়ে।
তামিলনাড়ু রাজ্যে প্রায়ই ঝগড়া-বিবাদকারী রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় এবং অর্থনৈতিক মঙ্গলকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ হয়। রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন একজন ঘোষিত নাস্তিক।
রাজ্যের রাজধানী চেন্নাইতে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে বসবাস করেন জান মোহাম্মদ। তিনি বলছিলেন, ‘প্রতিবেশীরা একে-অপরের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেন। গ্রামীণ এলাকার একটি ঐতিহ্য রয়েছে। যখন কোনো সম্প্রদায় কোনো উপাসনালয় নির্মাণ শেষ করে, তখন অন্যান্য ধর্মের গ্রামবাসীরা ফল, সবজি এবং ফুল উপহার নিয়ে আসে এবং খাবারের জন্য অবস্থান করেন।’ ‘আবাসনের চেয়েও বড় কথা হলো একটা বোঝাপড়া আছে,’ মোহাম্মদ বলছিলেন।
তার পরিবার ‘ওভারএচিভার’-এ পূর্ণ তাদের শিক্ষিত রাজ্যটিতে যা কিনা আদর্শ। মোহাম্মদ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে নির্মাণ ব্যবসায় আছেন। অর্থনীতিতে ডিগ্রিধারী তার স্ত্রী রুখসানা সন্তান বড় হওয়ার পর অনলাইনে পোশাকের ব্যবসা শুরু করেন। এক মেয়ে মাইমুনা বুশরার দুটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি আছে। সে একটি স্থানীয় কলেজে পড়ায়। তার বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। সর্বকনিষ্ঠ হাফসা লুবনা বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী এবং দুই বছরের মধ্যে একটি স্থানীয় কোম্পানিতে ইন্টার্ন থেকে (২০ বছর বয়সে) ম্যানেজার হয়ে গেছে। দুই মেয়েরই পিএইচডি চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। একমাত্র উদ্বেগ ছিল, সম্ভাব্য বর তাতে আতঙ্কিত হতে পারে। ‘প্রস্তাব আসা কমে যায়,’ রুখসানা মজার ছলে বলছিলেন। এক হাজার মাইল উত্তরে দিল্লিতে সালামের পরিবার অন্য দেশ বলে মনে হয়- এমন এক জায়গায় বাস করে। এমন একটি জায়গা যেখানে কুসংস্কার এতটাই নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে যে ২৬ বছরের বন্ধুত্বও এর ফলে ভেঙে যেতে পারে।
সালাম বিশাল আকৃতির জন্য তার একজন সাবেক সম্পাদককে ‘মানব পাহাড়’ ডাকনাম দিয়েছিলেন। শীতকালে দিল্লিতে কাজ শেষে যখন তারা সম্পাদকের মোটরসাইকেলে চড়তেন, তখন তিনি সালামকে ঠাণ্ডা বাতাস থেকে রক্ষা করতেন। তারা প্রায়ই একসাথে থাকতেন; যখন তার বন্ধুটি ড্রাইভিং লাইসেন্স পায়, তখনো সালাম সাহেব তার সাথে ছিলেন। ‘আমি প্রতিদিনই মসজিদে যেতাম, আর তিনি মন্দিরে যেতেন।’ সালাম বলছিলেন, ‘আমি সেজন্য তাকে সম্মান করতাম।’ কয়েক বছর আগে, ব্যাপারগুলোর পরিবর্তন হতে শুরু করে। প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেজ এসেছিল।
সম্পাদক সালামের কাছে মুসলিমবিরোধী ভুল তথ্যের কিছু জিনিস ফরোয়ার্ড করা শুরু করেন : উদাহরণস্বরূপ, মুসলমানরা ২০ বছরের মধ্যে ভারত শাসন করবে কারণ তাদের নারীরা প্রতি বছর সন্তান জন্ম দেয় এবং তাদের পুরুষদের চার স্ত্রীর বিধান আছে।
‘প্রাথমিকভাবে, আমি বলেছিলাম, আপনি কেন এসবের মধ্যে ঢুকতে চান? আমি ভেবেছিলাম তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, তিনি এসব পাচ্ছেন এবং ফরোয়ার্ড করছেন।’ সালাম বলছিলেন, ‘আমি তাকে বেনিফিট অব ডাউট দিই।’
ব্রেকিং পয়েন্টটি এসেছিল দুই বছর আগে, যখন মোদির অনুচর যোগী আদিত্যনাথকে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পুনঃনির্বাচিত করা হয়েছিল। এটি সালামরা যেখানে বসবাস করেন অর্থাৎ দিল্লি সংলগ্ন জনবহুল আরেকটি রাজ্য। আদিত্যনাথ, মুসলমানদের বিষয়ে মোদির চেয়েও স্পষ্টতই আরো বেশি বিদ্রোহী, যিনি হিন্দু সন্ন্যাসীদের জাফরান পোশাক পরে রাজ্য শাসন করেন, ঘন ঘন হিন্দু তীর্থযাত্রীদের বিশাল জনতাকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা দেন। অন্য দিকে, মুসলিম ধর্মবিশ্বাসের প্রকাশ্য প্রদর্শনে দমন অভিযান চালান।
ভোট গণনার দিন, ওই বন্ধুটি আদিত্যনাথের এগিয়ে যাওয়ায় আনন্দিত হয়ে সালামকে ফোন করতে থাকেন। মাত্র কয়েক দিন আগেই বন্ধুটি আদিত্যনাথের প্রথম মেয়াদে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং নিজ ছেলের চাকরি খোঁজার সংগ্রামের বিষয়ে অভিযোগ করছিলেন। ‘আমি বললাম, ‘তুমি সকাল থেকেই এত খুশি, তোমার লাভটা কী?’
‘যোগী নামাজ বন্ধ করেছেন,’ শুক্রবারে মুসলিমদের জুমার নামাজের জমায়েত (যা প্রায়ই রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে) এর কথা উল্লেখ করে বন্ধুটি বলছিলেন। ‘সেই দিনই আমি (তাকে) বিদায় জানিয়েছিলাম, ‘সালাম বলছিলেন, ‘এরপর সে আর কখনো আমার জীবনে ফেরে নি।’
(যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাউথ এশিয়ার ব্যুরোপ্রধান মুজিব মাশাল এবং রিপোর্টার হরি কুমারের এই প্রতিবেদনটি ১৮ মে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা