১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
আজ ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস

আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ পানির ন্যায্য হিস্যা

-


আজ ১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ দিবস। ৪৮ বছর আগে ১৯৭৬ সালের এই দিনে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দান থেকে মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে মারণ বাঁধ ফারাক্কা অভিমুখে লাখো জনতার লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ওইদিন বাংলার সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকন্ঠ দিল্লির মসনদ পর্যন্ত কাঁপিয়ে দেয়।
উজানে ভারত ফারাক্কা বাঁধ দেয়ায় চার যুগে পদ্মা হারিয়েছে তার স্বাভাবিক প্রবাহ। একসময়ের প্রমত্তা পদ্মা এখন যেন খালে পরিণত হয়েছে। ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা তা পায় না। তবে যা পায় তা অতি সামান্যই। পানি না পাওয়ায় এর বিরূপ প্রভাবে রাজশাহী অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশসহ জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রতিবেশী দেশ হয়েও ভারতের একতরফা ও আগ্রাসী মনোভাবের কারণে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বৃহৎ একটি অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চল ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন। দেশের বৃহত্তম নদী পদ্মা আজ পানির অভাবে শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হতে চলেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলসহ দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ৩০টি নদী আজ বিলুপ্তির পথে। অন্য দিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে এখন পানির স্তর স্থান ভেদে ১৬০ থেকে ১৮০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। আর নগরীতে অন্তত ৮০ থেকে ৯০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে। বর্তমানে রাজশাহীতে পানি সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করছে। এই অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। আর শুষ্ক মৌসুমে পানি সঙ্কট আরো তীব্র হচ্ছে। এতে এই অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহার্য পানিসহ সেচের পানি নিয়ে দুর্ভোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইতোপূর্বে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি বারবার উত্থাপন করা হলেও কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। দীর্ঘদিন ধরে শুধু আশ্বাসের বাণী শোনানো হয়। এ ব্যাপারে ভারতের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভারত চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান করছে না। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজশাহীর পদ্মা নদীর বুকে বিশাল বিশাল বালুচর পড়েছে। সেখানে গরুর গাড়ি চলছে। ফল ও ফসলের আবাদ হচ্ছে। হেঁটেই এখন নদী পার হওয়া যায়। পদ্মার মূল নদী রাজশাহী শহর থেকে অনেক দূরে (সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার) সরে গেছে।
জানা যায়, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ফারাক্কা লংমার্চের প্রস্তুতির সময় বিশ্ব নেতাদের এ সম্পর্কে অবহিত করে বার্তা পাঠান। তিনি জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব ড. কুর্ট ওয়াল্ডহেইম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড, চীনের নেতা মাও সেতুং, সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন প্রমুখের কাছে তারবার্তা পাঠিয়ে ভারতের ওপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে গঙ্গার পানি বণ্টনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা প্রাপ্তির ব্যাপারে সহযোগিতা কামনা করেন। এ ছাড়া মওলানা ভাসানী জনসভা থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ফারাক্কার ফলে বাংলাদেশে এরই মধ্যে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা সরেজমিনে দেখতে আসার আহ্বান জানান।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বৃহৎ একটি অংশ মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। আগ্রাসী ভারতের একগুঁয়েমি ও অপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের কারণে বাংলাদেশ আজ চরম ক্ষতির শিকার। ফারাক্কা বাঁধের কারণে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, বাংলাদেশ সরকারকে সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ে ভারত সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা। জানা গেছে, ফারাক্কা বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প কারখানাসহ সব কিছুতেই মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এসব ক্ষতির বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান এখনো নেই। নদী গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এর আগে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরিচালিত এক সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭৫ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত ভারত কর্তৃক গঙ্গার পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের সার্বিক ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। তখন থেকে আজ পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা করে ক্ষতি হয়ে চলেছে।

এ ব্যাপারে নদী ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাংলাদেশের সভাপতি অ্যাডভোকেট এনামুল হক নয়া দিগন্তকে বলেন, চুক্তি অনুযায়ী ভারত সরকার বাংলাদেশকে পানি দেবে বলে মনে হয় না। কারণ এত দিনেও তারা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশকে পানির প্রাপ্যতা বুঝিয়ে দেয়নি। তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘের পানিপ্রবাহ আইন ১৯৯৭-এর বিধান অনুযায়ী এবং জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমেই বিষয়টির সুরাহা করতে হবে। ফারাক্কার প্রতিক্রিয়া ও প্রভাবে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গঙ্গা-পদ্মা ছাড়াও অন্যান্য ছোট ও মাঝারি ধরনের নদ-নদীও শুকিয়ে গেছে। নদীর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা এখন অনেকটাই মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। এর ফলে এক ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয় অতি আসন্ন। ভয়াবহ এ অবস্থা থেকে উত্তোরণে সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ফারাক্কা বাঁধ হলো গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটি বাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় ফারাক্কা বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। আর তা শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে ফারাক্কা বাঁধ চালু হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে ভারতের সাথে প্রথম গঙ্গার পানি চুক্তি সই হয়। এর সাথে যুক্ত ছিল গ্যারান্টি ক্লজ। জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে এ চুক্তি দু’বার নবায়ন হয়। ১৯৮২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে একই বছর সমঝোতা স্মারক সই হয়। কিন্তু বাদ দেয়া হয় গ্যারান্টি ক্লজ।

যেখানে ছিল বাংলাদেশের হিস্যার ৮০ শতাংশ পানি পাওয়ার নিশ্চয়তা। সবশেষ ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি যে গঙ্গা চুক্তি করা হয় তাতেও রাখা হয়নি গ্যারান্টি ক্লজ। চুক্তি অনুযায়ী- জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১০ দিন পরপর ৩৫ হাজার কিউসেক পানি উভয় দেশ পাবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে একসময়ের উত্তাল পদ্মা এখন প্রায় পানিশূন্য। এরসাথে সংযুক্ত ২৭টি শাখা নদীও অস্তিত্ব সঙ্কটে। এভাবে চলতে থাকলে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে অন্তত দুই কোটি মানুষ।
রাজশাহীতে কর্মসূচি : এ দিকে ফারাক্কা লংমার্চ দিবস উপলক্ষে রাজশাহীতে কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরীর একটি কমিউনিটি সেন্টারে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। হেরিটেজ রাজশাহী এ কর্মসূচির আয়োজন করেছে।


আরো সংবাদ



premium cement