২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১, ১৯ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

গাজায় যুদ্ধবিরতি আদেশ জারি করতে পারে আইসিজে

-

- রাফাসহ গাজার বিভিন্ন অংশে হামলা
- ইসরাইলে সরকার পতনের ডাক
- অবিলম্বে গাজা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের

ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি আদেশ জারি করতে পারে আন্তর্জাতিক আদালত (আইসিজে)। ইসরাইলি গণমাধ্যমের খবরে এমনটি দাবি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইরানি সংবাদ সংস্থা ইরনা। বৈরুতভিত্তিক আল-মায়াদিন নিউজ নেটওয়ার্ক জানিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকার অনুরোধে আইসিজে ওই নির্দেশ জারি করতে যাচ্ছে বলে ইসরাইলি গণমাধ্যমগুলো ধারণা করছে।
ইসরাইলি বাহিনী যখন গাজা উপত্যকার সর্বদক্ষিণের শহর রাফায় আগ্রাসন জোরদার করেছে তখন দক্ষিণ আফ্রিকা ইসরাইলের বিরুদ্ধে আরো কঠোর নির্দেশ জারির অনুরোধ জানিয়েছে। আইসিজেকে দক্ষিণ আফ্রিকা বলেছে, রাফা শহরে প্রায় ১৫ লাখ ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছে। সেই সাথে ওই শহর দিয়ে মিসর হয়ে গাজা উপত্যকার জন্য ত্রাণের সবচেয়ে বড় চালান প্রবেশ করে। এ অবস্থায় রাফায় ইসরাইলি আগ্রাসন গাজাবাসীর জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে।
ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালাচ্ছে বলে গত ৮ জানুয়ারি আইসিজেতে অভিযোগ জানায় দক্ষিণ আফ্রিকা। ওই অভিযোগের শুনানি শেষে আন্তর্জাতিক আদালত ইসরাইলকে গাজায় গণহত্যার মতো অপরাধ বন্ধ করতে এবং মানবিক ত্রাণের চালান অবাধে প্রবেশ করতে দেয়ার নির্দেশ জারি করে। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়েছে, তেল আবিব আইসিজের জারি করা নির্দেশ পালন করছে না। এ দিকে ইসরাইল ও হামাস কয়েক দফা আলোচনায় বসার পরও এখনো যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে পৌঁছাতে পারেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, হামাস যদি নিজেদের কব্জায় থাকা বন্দীদের সবাইকে আজ মুক্তি দেয়, তা হলে আগামীকাল থেকেই যুদ্ধবিরতি সম্ভব গাজায়। শুক্রবার রাজধানী ওয়াশিংটনের সিয়াটলে এক জনসভায় এ কথা বলেছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক প্রচেষ্টায় গত ২৫ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর গাজায় অস্থায়ী বিরতি ঘোষণা করেছিল হামাস এবং ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ)। সে সময় ইসরাইলের বিভিন্ন কারাগারে বন্দী দেড় শ’ ফিলিস্তিনির বিপরীতে বন্দীদের মধ্যে থেকে ১০৮ জনকে মুক্তি দিয়েছিল হামাস। বিরতির পর ফের পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হয় হামাস ও আইডিএফের মধ্যে। এই যুদ্ধের তিন মধ্যস্থতাকারী দেশ কাতার, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র কয়েক মাস ধরে বেশ কয়েক বার চেষ্টার পরও এখন পর্যন্ত গাজায় দ্বিতীয় দফা যুদ্ধবিরতি আনতে সফল হতে পারেনি। তাই বাকি ১৩২ জন বন্দীর ভাগ্যে কী ঘটছে বা তাদের মধ্যে কয়জন এখন পর্যন্ত বেঁচে আছেন- তা এখনো অজানা। বন্দীদের ফিরিয়ে আনতে কয়েক দিন ধরে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়েছে ইসরাইলে। গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফায় ইসরাইলি বাহিনীর অভিযান নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন বাইডেন। কিন্তু ইসরাইলের যুদ্ধকালীন সরকার তাতে কর্ণপাত না করে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে রাফায় অভিযান শুরু করে। এই নিয়ে টানাপড়েনের জেরে সম্প্রতি ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহ পাঠানোয় স্থগিতাদেশ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

রাফাসহ গাজার বিভিন্ন অংশে হামলা : ইসরাইল শনিবার রাফাসহ গাজার বিভিন্ন অংশে হামলা চালিয়েছে। গাজায় ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ২১ জন নিহত হয়েছেন। ইতোমধ্যে রাফার আরো এলাকা থেকে বাসিন্দাদের অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরাইল। এর মধ্য দিয়ে ইসরাইল রাফায় আরো বড় ধরনের অভিযানের ইঙ্গিত দিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ সতর্ক করে বলেছে, জনাকীর্ণ রাফাহ শহরে সরাসরি হামলার ক্ষেত্রে মহাবিপর্যয়ের ঝুঁকি আছে। এএফপির সাংবাদিক, চিকিৎসক ও প্রত্যক্ষদর্শীরা উপকূলীয় অঞ্চলটি জুড়ে ইসরাইলি হামলার কথা জানিয়েছেন। জাতিসঙ্ঘ বলেছে, আন্তর্জাতিক আপত্তি উপেক্ষা করে গত সপ্তাহে ইসরাইলি সেনারা পূর্ব রাফায় প্রবেশ করেন। এ ঘটনার পর গাজায় মানবিক ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। গত মঙ্গলবার ইসরাইলি বাহিনী মিসর সীমান্তবর্তী রাফা ক্রসিংয়ের ফিলিস্তিনি অংশ নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্রসিং বন্ধ করে দেয়। আরেকটি ক্রসিং দিয়ে যান চলাচল স্থগিত করে দেয়। গাজার একটি হাসপাতালের বিবৃতিতে বলা হয়, উপত্যকার মধ্যাঞ্চলে ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ২১ জন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের লাশ গাজার দেইর আল-বালাহ শহরের আল-আকসা শহীদ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা রাফায় প্রচণ্ড বিমান হামলার কথা জানিয়েছেন। এএফপির ছবিতে শহরটির আকাশে ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। এ ছাড়া উত্তর গাজায় হামলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজায় নির্বিচারে আগ্রাসন চালাচ্ছে। এতে এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের ৭০ শতাংশই নারী ও শিশু। এ ছাড়া আরো প্রায় ৮০ হাজার ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে।

অবিলম্বে গাজা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের
আলজাজিরা জানায়, আবারো অবিলম্বে গাজা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। তিনি কুয়েতে একটি আন্তর্জাতিক দাতা সম্মেলনে ভিডিও ভাষণে এমন মন্তব্য করেন। রোববার আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, অ্যান্তোনিও গুতেরেস আবারো গাজা যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ করে বন্দীদের প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করুন। একই সাথে অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি করুন।’ তিনি আরো বলেন, যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করুন। যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে এই ধ্বংসাত্মক অবস্থা থেকে বের হওয়ার পথ পাওয়া যাবে। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

ইসরাইলে সরকার পতনের ডাক
আলজাজিরা ও এএফপি জানায়, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হাতে থাকা ইসরাইলি বন্দিদের পরিবারের সদস্যরা সরকার পতনের ডাক দিয়েছেন। শনিবার তেল আবিবে তারা একটি জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখান থেকে সব ইসরাইলিকে রাস্তায় নেমে আসার এবং নেতানিয়াহুর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার আহ্বান জানান তারা। শনিবার হামাস এক ইসরাইলি বন্দির ভিডিও প্রকাশ করেছে। তারা জানিয়েছে, ইসরাইলের বিমান হামলায় এই বন্দী নিহত হয়েছেন। তার মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশের পরই অন্যান্য বন্দীর পরিবারের সদস্যরা সংবাদ সম্মেলন করেন।

এতে তারা বলেন, ইসরাইলি সেনারা গাজার যেসব অঞ্চল দখল করেছিল সেখানে হামাস আবারো পুনর্গঠিত হচ্ছে। চলমান যুদ্ধে কোনো কৌশল নেই; ইসরাইলের উত্তরাঞ্চল এখন জ্বলছে। অন্য দিকে দক্ষিণাঞ্চল শুটিং রেঞ্জে পরিণত হয়েছে। যেসব মানুষকে সীমান্ত এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে তাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এই বিপর্যয় শুধু বেড়ে চলছে। যদি আমরা এই পথে চলতে থাকি তাহলে আমরা শুধু বন্দীদের হারাব না, পুরো ইসরাইলকে হারাব। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর তীব্র সমালোচনা করেছেন বন্দীদের পরিবারের সদস্যরা। তারা দাবি করেছেন, শুধু নেতানিয়াহুর কারণে বন্দিচুক্তি হচ্ছে না। তারা বলেছেন, নেতানিয়াহু শুধু বন্দীদের ফিরিয়ে আনতে বাধা দিচ্ছেন না। তিনি ইসরাইলকে সাফল্যও পেতে দিচ্ছেন না। হামাসের কাছ থেকে আমাদের বন্দীদের মুক্ত করতে আমাদের নেতানিয়াহুর কাছ থেকে মুক্ত হতে হবে। তারা ইসরাইলি অন্য মন্ত্রীদের উদ্দেশ করে বলেছেন, গানজ, আইসেনকোট, গ্যালান্ট ও লিকুদ পার্টির বিবেকবান যেসব নেতা আছেন, হামাসের সুড়ঙ্গে আমাদের বন্দীরা যেন না পচে, দ্রুত সময়ে বন্দিচুক্তিতে পৌঁছাতে, নাশকতা এবং বন্দীদের পরিত্যাগ করার অপরাধ থামাতে আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি এই সরকারের পতন ঘটান।
তারা আরো বলেছেন, এই সরকার বন্দীদের নিয়ে কোনো পরোয়া করে না। এটি দেশকে একটি বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, এই সরকারের সাথে সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দিন। এই যুদ্ধ থামাতে এবং বন্দীদের বাঁচাতে সবাই বাইরে বের হন।

বন্দীদের পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা এখন আন্দোলন শুরু করবেন এবং বন্দীরা যত দিন না ফিরবে তত দিন আন্দোলন চলবে। হামাসের হাতে বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি ও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ইসরাইলজুড়ে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছেন। এ সময় ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান কার্যালয়ের সামনে ও অন্যান্য কয়েকটি শহরে পুলিশের সাথে সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এএফপির খবরে বলা হয়েছে, গাজায় আটক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে শনিবার ইসরাইলের কয়েকটি শহরের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার ইসরাইলি। তারা ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর পদত্যাগ এবং আগাম নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। গাজায় বন্দীদের পরিবার তেল আবিব, সিজারিয়া, রেহোভোত ও হাইফাসহ অন্যান্য শহরে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় ইসরাইলের ‘মেমোরিয়াল ডে’ পালনের প্রস্তুতি নেয়ার সময় এই বিক্ষোভ করে তারা। এ সময় বিক্ষোভকারীদের হাতে ইসরাইলি পতাকা এবং গাজায় আটক বন্দীদের ছবিসংবলিত ব্যানার দেখা যায়। বিক্ষোভকারীরা বন্দীদের জীবিত ফেরত আনতে ইসরাইলের সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। শনিবারের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন ৭ অক্টোবর অপহরণের শিকার তামির আদরের মা ইয়েল আদর। গত জানুয়ারিতে হামাসের হাতে বন্দী থাকাবস্থায় তার ছেলে নিহত হন বলে জানিয়েছেন এই নারী। তিনি বলেন, ‘কেবল তার ছেলের লাশ ফেরত চেয়েছিলেন তিনি; যাতে তাকে যথাযথভাবে দাফন করতে পারেন।’ ইয়েলে আদর বলেন, ‘৯০ দিন ধরে আমরা তার জীবিত ফিরে আসার জন্য লড়াই করেছি। আমরা ৯০ দিন এই আশায় ছিলাম যে, তামির আমাদের কাছে, পরিবারের মাঝে ফিরে আসবে। কিন্তু সে আর বেঁচে নেই। তার জীবিত ফেরার আশা খবরের সাথে মিলিয়ে গেছে।’


আরো সংবাদ



premium cement