যেভাবে চলছে মিল্টনের সাভারের আশ্রম
- আমান উল্লাহ পাটওয়ারী সাভার (ঢাকা)
- ১১ মে ২০২৪, ০২:১৫
সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের কমলাপুর এলাকার বাহেরটেক গ্রাম। মূল সড়ক থেকে লাল মাটি আর কিছু স্থানে ইট বসানো আঁকাবাঁকা সংযোগ সড়ক পার হলে নির্জন আর নিরিবিলি। প্রায় জনমানবহীন স্থানে ৬৫ শতাংশ জমির কিছু অংশে সাড়ে ছয়তলা একটি নতুন ভবনে মিল্টন সমাদ্দারের সাভার শাখার চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের কার্যক্রম চলছে। যা চলতি বছরের পহেলা মার্চ শুরু হয়।
ভবনে প্রবেশের ডান পাশে টিনশেড গ্যারেজ এবং ক্যান্টিন। বাম পাশে নামাজের স্থান এবং স্টাফদের থাকার ব্যবস্থা। আর ভবনের পশ্চিম পাশে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার অজ্ঞাত বৃদ্ধদের কবরস্থান প্রকল্প সাইন বোর্ডে লেখা রয়েছে। ভবনে ঢুকতে দেখা হয় সিকিউরিটি গার্ড মো: রিপন খান, মো: আমিনুল ইসলাম এবং চাইল অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের আশ্রিতদের দেখাশুনা ও হিসাব রাখার দায়িত্বে থাকা যুথিকা হাওলাদার নামে এক নারী কর্মকর্তার সাথে।
মিল্টন সমাদ্দারের গ্রেফতার ও তার বিরুদ্ধে ওঠা বিভিন্ন অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা বলেন, আমার দাদার (মিল্টন সমাদ্দার) বিরুদ্ধে যে ধরনের কার্যক্রমের অভিযোগ শুনতেছি, এর আগে আমরা এ ধরনের কাজ দেখিওনি এবং শুনিওনি।
এ সময় স্টাফরা অভিযোগ করেন চাইল অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের পিছনে শামছুদ্দিন চৌধুরী নামে ঢাকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তির জায়গা রয়েছে। ওই জায়গায় যাওয়ার জন্য রাস্তা সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে আমাদের দাদার (মিল্টন সমাদ্দার) আজকের এ পরিণতি। তারা বলেন, শামছুদ্দিন চৌধুরীর সাথে কিছু দিন আগে মারামারি পরবর্তীতে মামলা হয়। এ ঘটনায় আমাদের দাদাকে (মিল্টন সমাদ্দার) গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে মিল্টন সমাদ্দার গ্রেফতারের পর গত ৫ এপ্রিল সোমবার দুপুরের পর থেকে আলহাজ শামসুল হক ফাউন্ডেশন চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের সাভার শাখার আশ্রিতদের খাবার, চিকিৎসাসহ সম্পূর্ণ কার্যক্রম সাময়িকভাবে দায়িত্ব নিয়েছেন বলে নয়াদিগন্তকে জানান, ফাউন্ডেশনের এমপ্লয়ার মো: লোকমান হাবিব।
সরেজমিনে গিয়ে চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের স্টাফ, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে বিভিন্ন তথ্য জানা যায়। সাভারের চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে গিয়ে সতর্ক অবস্থানে প্রতিষ্ঠানে কর্তব্যরত স্টাফদের দেখা গেছে। এ সময় গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিলে অনেকে সরে যেতে আবার যারা কাছে আসছেন তাদের অনেকে কথা বলতে অপরাগতা প্রকাশ করেন। স্টাফরা ভবনের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।
ভেতরে সেবা গ্রহীতাদের সাথে কথা বলার অনুমতি চাইলে তারা জানায়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিতে নিষেধ করা হয়েছে।
পরে ভবনের বাইরে সিঁড়িতে বসে যতটা সম্ভব জানার চেষ্টা করা হয়। স্টাফরা অভিযোগ করেন আমাদের দাদার (মিল্টন সমাদ্দার) সাথে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একাধিক বাড়ির মালিক শামছুদ্দিন চৌধুরী নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির ৬ ফিটের রাস্তা ১২ ফিট করার বিরোধকে কেন্দ্র করে কথা কাটাকাটি পরবর্তীতে হাতাহাতি হলে আমরা স্টাফ হিসেবে বসে থাকতে পারি না। এ ঘটনায় আমরাও ওই মারামারিতে যাই। মারামারির ঘটনার পর মামলা হয়, পরবর্তীতে একটি পত্রিকায় নিউজ হয় এবং পরে আরো বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে দাদাকে গ্রেফতার করা হয়।
স্টাফদের দেয়া তথ্যানুসারে মিল্টন সমাদ্দারের জায়গার পেছনে বিভিন্ন গাছের বাগানসহ একটি জায়গা রয়েছে যেটা শামছুদ্দিন চৌধুরীর। ওই জায়গায় তিনি মাঝে মধ্যে আসেন। সে জায়গায় যেতে হলে মিল্টন সমাদ্দারের ভবন এবং স্টাফদের আবাসিক কোয়ার্টারের মাঝখান দিয়ে যেতে হয়। ঈদুল ফিতরের আগে শামছুদ্দিন চৌধুরী তার মেয়ের জামাই এবং মেয়েসহ রাস্তাসংক্রান্ত ব্যাপারে মিল্টন সমাদ্দারের কাছে গেলে তাদের মারধর করে। মিল্টনসহ তার স্টাফ এবং লোকজনের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ ওঠে। এ সময় তারা শামছুদ্দিন চৌধুরীসহ তাদের একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। এমনকি তাদের মোবাইল ফোনগুলো ছিনিয়ে নেয়া হয় বলে অভিযোগ ওঠে। পরবর্তীতে স্থানীয় ইউপি সদস্য বিল্লাল হোসেন শামছুদ্দিন চৌধুরীসহ তাদের উদ্ধার করেন।
এ ব্যাপারে ইউপি সদস্য বিল্লাল হোসেন নয়াদিগন্তকে জানান, ঈদুল ফিতরের ১/২দিন আগে শামছুদ্দিন চৌধুরী, মেয়ের জামাই ফয়েজ ও মেয়েসহ তার জায়গায় এবং এক আত্মীয়ের বাসায় যান। এরপর শামছুদ্দিন চৌধুরী, মেয়ে এবং জামাইসহ মিল্টন সমাদ্দারের কাছে রাস্তাসংক্রান্ত ব্যাপারে যান। এ সময় মিল্টনসহ তার স্টাফ ও লোকজন শামছুদ্দিন চৌধুরী, মেয়ে ও জামাইকে মারধর করে এবং চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের একটি কক্ষে আটকে রাখে। আমি এ সংবাদ পেয়ে আমার লোকজন পাঠাই এবং সেখানে গিয়ে তাদের উদ্ধার করি। এ ঘটনায় শামছুদ্দিন চৌধুরী থানায় মামলা করেন।
তিনি আরো জানান, মিল্টন সমাদ্দার আমার এলাকায় এমন একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান করেছে। ইতোমধ্যে তার কার্যক্রমও শুরু হয়েছে। অথচ এ ব্যাপারে আমি আমার চেয়ারম্যানসহ কেউই কিছুই জানি না। এসব ঘটনার পর আমি ব্যাপারগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।
আশ্রিতদের দেখাশুনা এবং হিসাব রাখা কর্মকর্তা যুথিকা হাওলাদার বলেন, সাভার শাখায় আশ্রিতদের মধ্যে নারী-৫৪, পুরুষ-৫৩, শিশু/বাচ্চা ২৮ ও স্টাফ-৪১ জন সহ মোট-১৭৬ জন রয়েছে। সেখানকার সিকিউরিটি গার্ড আমিনুল জানান, সাড়ে ছয়তলা ভবনের নিচতলা স্টাফদের অফিস, ওপরে থাকেন আশ্রিতরা। তিনি জানান, এখানে যারা আশ্রিত তারা সবাই বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ তাদের কোনো ঠিকানা নেই। পথে-ঘাটেসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ যারা বিভিন্ন স্থানে পড়েছিল আমরা তাদের নিয়ে এসে সেবা দিচ্ছি। আমাদের এখানে আসার পর কারো ঠিকানা পেলে আমরা স্বজনদের কাছে তাদের বুঝিয়ে দেই। আশ্রিতদের খাওয়াসহ চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রে কোনো মেডিক্যাল টিম আছে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, আমাদের কোনো মেডিক্যাল টিম/এমবিবিএস ডাক্তার নেই। আমরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স দিয়ে চিকিৎসা সেবা দেই। আর মানুষের দানের টাকা তাদের পিছনে ব্যয় করা হয়। আশ্রিতরা মারা গেলে যার যার ধর্মানুসারে দাফনের ব্যবস্থা করা হয়।
আরেক সিকিউরিটি গার্ড মো: রিপন খান জানান, দুই মাস হয় তার চাকরি হয়েছে। তার বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। মিল্টন সমাদ্দারের বাড়িও বরিশালের উজিরপুর।
প্রতিবেশী নন্দন নামের এক ব্যক্তি জানান, পয়লা মার্চ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অথচ আমরা এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের সামনের বাড়ির বাসিন্দা রিগ্যাল জানান, মিল্টন সমাদ্দারের রাগ অনেক বেশি। আমরা তার কার্যক্রম ভালোই দেখছি। তবে ঢাকার শাখায় মিল্টন সমাদ্দার তার আশ্রমে যারা মারা যেতেন তাদের মৃত্যুসনদ ডাক্তারের স্বাক্ষর জাল করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আমরা শুনেছি। তবে গণমাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে আমরা যা শুনেছি, সাভার শাখায় এ ধরনের কোনো ঘটনা আমরা দেখিনি বা শুনিওনি।
বিরুলিয়া ইউনিয়নের কমলাপুরের পাশর্^বর্তী রাজারবাগ গ্রামের বাসিন্দা সুজন নয়াদিগন্তকে জানান, কিছুদিন থেকে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে ওঠা এমন অভিযোগ তিনি আগে শুনেননি। হঠাৎ ১০/১২ দিন ধরে অনেক কথা শুনতেছি। মিল্টন সমাদ্দার এখানে দুই-একদিন পরপরই আসতেন। আমরা চাই এসব বিষয় সুষ্ঠু তদন্ত হোক। যা পরবর্তীতে সঠিক ও সত্য ঘটনা বের হয়ে আসবে।
প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে গত ১ মে রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। এরপর তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
দুই দফায় রিমান্ডে নিয়ে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে মিল্টনকে। বর্তমানে মিল্টন কারাগারে আছেন। বৃহস্পতিবার চার দিনের রিমান্ড শেষে মিল্টন সমাদ্দারকে আদালতে হাজির করে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর জোনাল টিমের এসআই মোহাম্মদ কামাল হোসেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিলা সুমু চৌধুরীর আদালত জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
গত ২ মে মিল্টনের প্রতারণা মামলায় তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন ঢাকার সিএমএম আদালত। তিন দিনের রিমান্ড শেষে গত ৫ মে মানবপাচারের মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। এই মামলায় তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে ডিবি পুলিশ। ওই দিন শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বেগম শান্তা আক্তারের আদালত আসামির ফের চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা