১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা

রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত

-


বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মর্টার শেলের ব্যাপক শব্দে প্রকম্পিত হয় নিকুছড়ি, উনচিপ্রাং, মিনা বাজারসহ আশপাশের বেশ কয়েকটি গ্রাম। গত বুধবার সকাল ৯টায় নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তঘেঁষা মিয়ানমারের রাখাইনের পুরানমাইজ্জার এলাকায় গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাখাইনের বুচিডং, মংডু, নলবনিয়া এলাকায় বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সাথে দেশটির সরকারি বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলে। টেকনাফের শাহপরীরদ্বীপ, হোয়াইক্যংয়ের মিনাবাজার উনচিপ্রাং এলাকার সোজাসুজি রাখাইনে সংঘর্ষের এসব ঘটনা চলছে। মর্টার শেল ও গুলির শব্দ এপারের সীমান্তবাসী শুনতে পাচ্ছেন।
সীমান্ত এলাকার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, রাখাইনের প্রায় ৭০ শতাংশ এলাকা বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে টিকতে না পেরে অনেকে বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে ২৬১ জন নাইক্ষ্যংছড়ি বিজিবির হেফাজতে রয়েছে। তাদেরকে পাঠিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলছে। গত মঙ্গলবার রাতে সাপমারারঝিরি ভেতরের ছড়ার আগা দিয়ে এসেছে জান্তা বাহিনীর ৪৬ যোদ্ধা। যারা বিজিবির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এর আগে সকালে ঘুমধুম রেজুপাড়া বিওপি বিজিবির কাছে আত্মসমর্পণ করে জান্তার অন্য এক সদস্য। বুধবার বিকেলে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের ৪৪ নম্বর পিলার এলাকায় পালিয়ে আশ্রয় নেয় আরো এক জান্তা সদস্য। এ নিয়ে দুই দিনে আশ্রয় নেয় ৬৫ জন।

এর দুই দিন আগে সীমান্তের ঘুমধুম ও হোয়াইক্যং পয়েন্ট দিয়ে আসে ১৬ জন। এভাবে চার দিনে জান্তা বাহিনীর ৮১ জন পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। যাদেরকে এখন নাইকক্ষ্যংছড়ি বিজিবি স্কুলে রাখা হয়েছে। পালিয়ে আসা প্রত্যেক যোদ্ধার অধিকাংশ অস্ত্র আরাকান আর্মি ও বিদ্রোহী আরএসও ছিনিয়ে নিয়েছে অভিযোগ পালিয়ে আসা জান্তা সদস্যদের। তারা যখন অসহায় তখন সুযোগ নিয়ে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দিচ্ছে বিদ্রোহীরা। তারা আরো জানান, আরো শতাধিক জান্তা বাহিনীর সদস্য পালিয়ে আসার অপেক্ষায় রয়েছে। নাই্যংছড়ি ও টেকনাফ সীমান্তজুড়ে ওপারে গোলাগুলি মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন সীমান্তের বাসিন্দারা। নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউপি চেয়ারম্যান নুরুল আবছার ইমন বলেন, মঙ্গলবার রাতে ৪৬ জন জান্তা বাহিনীর যোদ্ধা নিরস্ত্র পালিয়ে আসে। বিজিবি সূত্রগুলো জানায়, মঙ্গলবার রাত দেড়টায় তাদেরকে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরে নিয়ে আসা হয়। বিজিবি সদর দফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো: শরীফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, নাইক্ষ্যংছড়ি ব্যাটালিয়নের জামছড়ি বিওপির দায়িত্বপূর্ণ এলাকা দিয়ে মঙ্গলবার রাতে নতুন করে আরো ৪৬ জন বিজিপি সদস্য আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে ঢুকেছে ১৬ জন। ৪ দিনে মোট ৮১ জন জান্তা সদস্য এপারে পালিয়ে আসে। এর আগে কয়েক দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন আরো ৩৩০ জন জান্তা বাহিনীর সদস্য। যাদেরকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি নৌপথে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
মিয়ানমারে বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত শহরে কোণঠাসা জান্তা : মিয়ানমারের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণ্যিজ্যিক শহর মিয়াবতী। গত সপ্তাহেই জান্তা শাসকের কাছ থেকে এটি দখল করেছে দেশটির বিদ্রোহী যোদ্ধারা। সেখানে তুমুল লড়াইয়ের স্পষ্ট ছাপ রয়ে গেছে। গত সোমবার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এ অঞ্চলে বিরল প্রবেশাধিকার পেয়েছিল রয়টার্স।
রয়টার্সের সাংবাদিকরা সেখানকার সাতজন প্রতিরোধ কর্মকর্তার দেওয়া সাক্ষাৎকারের পাশাপাশি সংঘর্ষের বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান আছে এমন তিন থাই কর্মকর্তা এবং চার নিরাপত্তা বিশ্লেষকের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে শহরটির একটি চিত্র তুলে ধরেছেন। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার একটি প্রতিবদেন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থাটি।

রিপোর্টে বলা হয়েছে, তুমুল লড়াই হওয়া এ স্থানটি সীমান্ত শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত। সেখানে পরিত্যক্ত বাড়িগুলোর দেয়ালে বুলেটের গর্ত রয়ে গেছে। বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গ্যাস স্টেশন। বিমান হামলায় মাটির সাথে মিশে গেছে ভবনগুলো। মিয়াবতীতে জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা বিদ্রোহীরা রয়টার্সকে বলেছে, তারা এমন একটি আশাহত সামরিক বাহিনী সাথে লড়েছেন, যারা ভূমি রক্ষায় কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছিল না।
যুদ্ধের সাথে জড়িত একটি বিদ্রোহী ইউনিটের কমান্ডার সাও কাও রয়টার্সকে বলেছেন, ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা তিনটি ঘাঁটি দখল করতে এবং এলাকাটি নিয়ন্ত্রণে নিতে সক্ষম হই। এরপরই তারা পালিয়ে যায়।’ সম্প্রতি সামরিক প্রশাসনের প্রতি অনুগত জাতিগত মিলিশিয়া প্রহরীরা শহরের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াত। এপ্রিলের শুরুতে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ)-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহী বাহিনী অবরোধ করলে সেই সেনারা একপাশে দাঁড়িয়েছিল।
সাক্ষাৎকার দেয়া ব্যক্তিরা রয়টার্সকে দীর্ঘস্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সূক্ষ্ম কূটনীতির বিষয়টি জানিয়েছিল। তারা বলছিলেন, মূল জনসংখ্যা কেন্দ্রগুলো ধরে রাখতে এবং জান্তার পতন ঘটাতে চায় বিদ্রোহীরা। মিয়াবতীর পতন মানে মিয়ানমারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্থল সীমান্ত ক্রসিং প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে চলে যাওয়া। এর আগে গত বছর চীনা সীমান্তের কাছের মিউজ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার দাবি করেছিল বিদ্রোহীরা।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, বিদ্রোহীরা বর্তমানে দেশটির প্রায় সব প্রধান স্থল সীমান্ত থেকে জান্তাকে বিচ্ছিন্ন করেছে। একটি সমীক্ষায় থাইল্যান্ড-ভিত্তিক ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি-মিয়ানমার (আইএসপি) থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক বলেছে, মিয়াবতীর পতনের পর ভূমি-ভিত্তিক শুল্ক রাজস্বের ৬০ শতাংশ থেকে বঞ্চিত হয়েছে জান্তা।

বিশ্লেষকদের মতে, ২০২১ সালে অং সান সু চি’র নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ প্রথম জান্তাকে তাদের সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে ফেলেছে বিদ্রোহীরা। অক্টোবরের পর থেকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বড় ধরনের কোনো আক্রমণই প্রতিহত করতে পারেনি জান্তা। জান্তার সাথে কাজ করতে আগ্রহী থাইল্যান্ডের মতো প্রতিবেশীরা এখন সংঘাতের বিষয়ে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করেছে।
থাই ভাইস পররাষ্ট্র মন্ত্রী সিহাস্ক ফুয়াংকেটকিও বুধবার রয়টার্সকে বলেছেন, থাই নিরাপত্তা কর্মকর্তারা কেএনইউ এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর সাথে যোগাযোগ করছেন এবং তারা বিশেষ করে মানবিক ইস্যুতে ‘আরো সংলাপের জন্য উন্মুক্ত’ রয়েছেন। এ সময় তিনি আরো বলেন, ‘মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে আমরা অন্ধভাবে সমর্থন করছি না। তবে আমরা যেহেতু শান্তি চাই, তাই তাদের সাথে আমাদের কথা বলতে হবে।’
এ বিষয়ে জান্তার এক মুখপাত্রের কাছে মন্তব্যের জন্য অনুরোধ করা হলে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সাড়া পায়নি রয়টার্স। সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে মিয়ানমারের ঐক্যকে ক্ষুন্ন করার জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে অভিযুক্ত করেছেন জান্তাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। এ সময় প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ‘সন্ত্রাসী’ বলেও অভিহিত করেছে তার সরকার।
জান্তা ত্যাগ করার পরও মিয়াবতী এবং এর আশপাশের কিছু অংশে টহল দিচ্ছে ডেমোক্্র্যাটিক কারেন বৌদ্ধ আর্মি এবং কারেন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) বাহিনী। তবে দলগুলো প্রতিরোধ বিদ্রোহীদের কাছেও আনুগত্য স্বীকার করেনি।

 


আরো সংবাদ



premium cement