১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

২ নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিকে হত্যার পর বুলডোজার দিয়ে চাপা

-

- ১৩ শিশুকে গুলি করে হত্যা
- জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞকে হুমকি
- আরো এক মার্কিন কর্মকর্তার পদত্যাগ

আত্মসমর্পণ করতে সাদা কাপড় উড়িয়েছিলেন ফিলিস্তিনি নিরস্ত্র নিরীহ কয়েকজন। কিন্তু বাঁচার কোনো সুযোগ না দিয়ে ইসরাইলি সেনাদের গুলিতে তাদের বুক এফোড় ওফোড় হয়ে গেল। মারা গেলেন তারা। সেই লাশ ইসরাইলি সেনারাই বুজডোজার দিয়ে গাজা সিটির কাছেই বালুচাপা দিয়েছে। এমন ভিডিওফুটেজ ছড়িয়ে পড়ার পর নিন্দার ঝড় উঠেছে। আলজাজিরা।
এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে হামাস। তারা বলেছে, ইসরাইল যে কী মাত্রায় ফ্যাসিবাদী চালাচ্ছে এটি তার আরেকটি প্রমাণ। তারা জায়নবাদী অপরাধ করছে। এটি তার প্রমাণ।

ঘটনাটি ঘটেছে গাজা সিটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নাবলুসিতে। নৃশংস হত্যার শিকার ওই ফিলিস্তিনিরা আল-রশিদ সড়ক দিয়ে গাজার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত নিজ বাড়িতে ফেরার চেষ্টা করছিলেন। তখনই ইসরাইলি সেনাদের বর্বরতার মুখে পড়েন তারা। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হওয়ার পরই দুই নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিকে হত্যার ভিডিও সামনে এলো।
ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, একজন ব্যক্তি ইসরাইলি সেনাদের কাছে যাচ্ছেন। তার হাতে সাদা কাপড় ছিল। অপরজন অন্য দিকে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পুরো সময় তিনি সাদা কাপড় তুলে রেখেছিলেন। যে ব্যক্তি অন্য দিকে যাচ্ছিলেন তার কাছে যায় ইসরাইলিদের একটি সাঁজোয়া যান। সেখান থেকে তাকে গুলি করা হয়। এরপর সাথে সাথে বালুতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। গুলি করে হত্যার পর বুলডোজার দিয়ে দু’জনের লাশ দ্রুত সময়ের মধ্যে বালুতে পুঁতে ফেলা হয়। তবে বুলডোজার দিয়ে লাশগুলো এমনভাবে নাড়ানো হচ্ছিল যেন এগুলো কোনো পশুপাখির লাশ। এ ঘটনাকে ‘নৃশংস যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে দ্য কাউন্সিল অব আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স (সিএআইআর)। সংস্থাটি বলেছে, ইসরাইলি সেনারা খেয়ালখুশিমতো ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে এবং লাশগুলোর সাথে এমন আচরণ করেছে যেন এগুলো ‘ময়লা’। এ ঘটনার তদন্ত জাতিসঙ্ঘকে অবশ্যই করতে হবে।

১৩ শিশুকে গুলি করে হত্যা : তা ছাড়া ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর নামের একটি মানবাধিকার সংস্থা অভিযোগ করেছে, মাত্র এক সপ্তাহে ইসরাইলি বাহিনী আল-শিফা হাসপাতালে এবং এর কাছাকাছি ১৩ শিশুকে সরাসরি গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। আলজাজিরার লাইভ রিপোর্টে এবং মিডল ইস্ট আইয়ের রিপোর্টে এ খবর জানানো হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাটি তাদের একটি দলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, আল-শিফা হাসপাতালে ইসরাইলের অভিযান অব্যাহতভাবে চলছে। স্থানীয় কিছু পরিবার তাদের বাড়ির ভেতরেই অবস্থান করছে। কিন্তু কিছু পরিবার নিরাপদ হিসেবে মনোনীত রাস্তা ধরে পালানোর চেষ্টা করছিল। তখন সেখানে মারাত্মক এ গুলির ঘটনা ঘটেছে। সেই হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী।

ইসলাম আলি সালোহা নামের এক ফিলিস্তিনি ইউরো-মেডকে বলেছেন, ইসরাইলি বাহিনী গত রোববার আল-শিফার কাছে তার দুই ছেলেকে গুলি করে হত্যা করেছে। তারা হলো ৯ বছর বয়সী আলী এবং ছয় বছর বয়সী সাইদ মুহাম্মদ শেখা। ইসরাইলি সেনাবাহিনী পালিয়ে যাওয়ার জন্য ওই রাস্তাকে নিরাপদ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সেই রাস্তায়ই ওই দুই শিশুকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে। ইসলাম আলি সালোহা আরো বলেন, ‘ইসরাইলি বাহিনী আমার ছেলেদের লক্ষ্য করেই গুলি চালিয়েছিল। সালোহা বলেন, ‘তার ছেলেরা এবং প্রতিবেশীরা বাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছিল, কারণ ইসরাইলি বাহিনী তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল। তারা বলেছিল ভবনটিতে বোমা হামলার হতে পারে।’
মিডল ইস্ট মনিটরের খবরে বলা হয়েছে, ‘ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর জানিয়েছে, আল-শিফা হাসপাতাল এবং এর আশপাশে ইসরাইলি দখলদার বাহিনী ১৩ শিশুকে হত্যা করেছে। এনজিওটি নিশ্চিত করে জানিয়েছে, ৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী গাজার শিশুদের হত্যার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য এবং সাক্ষ্য পেয়েছে।’

জাতিসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞকে হুমকি : এ দিকে রয়টার্স জানায়, ফ্রান্সেস্কা আলবানিজ ফিলিস্তিনের গাজা ও পশ্চিমতীরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত। গত মঙ্গলবার তিনি একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। তাতে তিনি বলেন, হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরুর পর গাজায় ইসরাইলি বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে বলে বিশ্বাস করার যৌক্তিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। এর পরই তিনি হুমকি পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে ফ্রান্সেস্কার উপস্থাপন করা প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘এনাটমি অব জেনোসাইড’। এ প্রতিবেদনকে চূড়ান্তভাবে খারিজ করে দিয়েছে ইসরাইল। এরপর বুধবার হুমকি পাওয়ার কথা জানান এ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ। নিজের এ কাজের কারণে হুমকি পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে ফ্রান্সেস্কা বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি হুমকি পেয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত আমি অতিরিক্ত সতর্কতার প্রয়োজনবোধ করিনি। আর চাপের কথা বললে, সেটি আছে। তবে তা কাজের প্রতি আমার প্রতিশ্রুতি কিংবা কাজের ফলাফল কোনোটাই বদলাতে পারবে না।’
আরো এক মার্কিন কর্মকর্তার পদত্যাগ : মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের গাজা নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের মানবাধিকার কর্মকর্তা। গতকাল বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। খবরে বলা হয়েছে, সদ্য পদত্যাগ করা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওই মানবাধিকার কর্মকর্তার নাম অ্যানেল শেলিন। মধ্যপ্রাচ্যের এই বিশ্লেষক মার্কিন সরকারের পক্ষে মানবাধিকার বিষয়ে প্রচারের পাশাপাশি এ-সংক্রান্ত দায়িত্বও পালন করতেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইসরাইল নীতির বিরোধিতায় নিজের পদ ছেড়ে দেয়া মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের সর্বশেষ কর্মী তিনি।

আলজাজিরা বলছে, শেলিন বুধবার ওয়াশিংটন পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তার পদত্যাগের ঘোষণা দেন। তিনি এমন একসময়ে বাইডেন প্রশাসন থেকে সরে দাঁড়ালেন যখন গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় চলমান প্রায় ছয় মাসের ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩২ হাজার ৪৯০ জনে পৌঁছেছে এবং অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডে দুর্ভিক্ষ আসন্ন বলে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। শেলিন মার্কিন এই সংবাদপত্রকে বলেন, ‘আমি সত্যিই আমার কাজ আর করতে পারিনি। মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।’ শেলিনের পদত্যাগের আগে গত বছরের অক্টোবরে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের আরেক কর্মকর্তা জশ পল পদত্যাগ করেন। বাইডেনের গাজা নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করা ওই কর্মকর্তা ছিলেন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়ক ব্যুরোর একজন পরিচালক। এ ছাড়া একই কারণে গত জানুয়ারিতে পদত্যাগ করেন মার্কিন শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা তারিক হাবাশ। জ্যেষ্ঠ এই মার্কিন কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা বিভাগের পরিকল্পনা, মূল্যায়ন ও নীতি উন্নয়নের অফিসের বিশেষ সহকারী পদে ছিলেন।

বন্দীদের স্বজনদের বিক্ষোভ, কয়েকজন আটক
বিবিসি জানায়, গাজায় হামাসের হাতে বন্দীদের স্বজনদের কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। তেল আবিবে বিক্ষোভ করার সময় তাদেরকে আটক করে ইসরাইলি পুলিশ। এ খবর জানিয়েছে বিবিসি। গাজায় যুদ্ধবিরতি ও বন্দী মুক্তির বিষয়ে সর্বশেষ আলোচনা ভেঙে যাওয়ার পর, তেল আবিবে বিক্ষোভ করেছেন ইসরাইলি বন্দীদের স্বজনরা। মঙ্গলবার রাতে তেল আবিবে ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর সদর দফতরের বাইরে বিক্ষোভে অংশ নেন অন্তত ৩০০ মানুষ। এ সময় রাজধানীর একটি প্রধান সড়ক অবরোধ করে তারা। এ সময় তারা বিভিন্ন স্লোগানসংবলিত প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন। ইসরাইলি পুলিশ জানিয়েছে, জনদুর্ভোগ তৈরির জন্য চার বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে তারা। এক বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ জানিয়েছে, বেআইনি হওয়ার পরেও পুলিশ বন্দী পরিবারের সদস্যদের বিক্ষোভে বাধা দেয়নি। কিন্তু কয়েকজন বিক্ষোভকারী হাইওয়েতে গিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এতে যান চলাচলে বাধা তৈরি হয়। ইসরাইলের বিরোধীদলীয় নেতা ইয়ার লাপিদ বলেছেন, বন্দীদের পরিবারগুলোর প্রতি সরকারের আরো সহনশীলতা দেখানো উচিত। ইসরাইলের সড়কে প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ করছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু কাতার, মিসর ও আমেরিকার মধ্যস্থতায় ইসরাইলি কর্মকর্তাদের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ায় ইসরাইলে বিক্ষোভ বাড়ছে।

মধ্যস্থতাকারীরা ১৩০ জনের মধ্যে ৪০ জনের মুক্তির বিনিময়ে ৬ সপ্তাহের জন্য গাজায় ইসরাইলি হামলা বন্ধের জন্য আলোচনা চালাচ্ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে অন্তত ৩০ জন বন্দী এরই মধ্যে মারা গেছেন। ওই ৪০ জনের মুক্তির বিনিময়ে ইসরাইলের কারাগারে আটক ৭০০ থেকে ৮০০ ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিতে রাজি হয় ইসরাইল। বাস্তুচ্যুত কিছু ফিলিস্তিনি পরিবারকে ধাপে ধাপে দক্ষিণ গাজায় তাদের ঘরে ফেরার অনুমতি দিতেও রাজি হয়। কিন্তু স্থায়ী যুদ্ধবিরতি এবং গাজা থেকে পুরোপুরিভাবে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানায় হামাস।

 


আরো সংবাদ



premium cement