২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

রাখাইনে বাড়িঘরের চিহ্নও রাখা হয়নি

অনিশ্চয়তায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন
-

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কথা উঠলেই আবেগে উদ্বেলিত হয়ে পড়েন রোহিঙ্গারা। আবার প্রত্যাবাসনবিরোধী কিছু রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরতে চাইলে খুনোখুনিতে মেতে ওঠেন। সম্মানজনকভাবে রোহিঙ্গারা ফিরতে চায় নিজ দেশে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কবে নাগাদ শুরু হবে তা জানা না থাকলেও সময়ে-অসময়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা ওঠে ক্যাম্পে।

মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের রোহিঙ্গা যাচাই-বাছাইয়ের পর এরই মধ্যে প্রত্যাবাসন সেন্টার প্রস্তুতের নির্দেশনাও দিয়েছে মন্ত্রণালয়। যদিও ফেরত নেয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের আস্থায় নেয়ার দায়িত্ব মিয়ানমারের বলে জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো: মিজানুর রহমান। উখিয়া বালুখালী ১১ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা সোলতান আহমেদ বলেন, কোনো ছলচাতুরী করে নয়, সম্পূর্ণ নাগরিক সুবিধা দিয়ে তাদের ফেরাতে হবে। স্বদেশে তাদের এমনভাবে ফেরাতে হবে, যেখানে থাকতে হবে অবাধ চলাফেরার স্বাধীনতা। একই ক্যাম্পের আরেক রোহিঙ্গা নারী জান্নাত আরা ও সেতারা বেগম বলেন, স্বদেশে ফেরাতে হলে তাদের প্রথমে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দিতে হবে। যেসব জায়গা জমি কেড়ে নেয়া হয়েছিল তা ফেরত দিতে হবে। সম্প্রতি নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের দাবিতে উখিয়ায় রোহিঙ্গা নারীদের সমাবেশ হয়েছে। এফডিএমএন রিপ্রেজেনটেটিভ কমিটির আয়োজনে লম্বাশিয়া ১ ইস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রচলিত প্রথা ভেঙে প্রথমবারের মতো উখিয়া- টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন বয়সী হাজারো রোহিঙ্গা নারী যোগ দেন। ২০ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নারীনেত্রী রশিদা খাতুন বলেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। তবে এই আশ্রিত জীবন আর চাই না। ফিরতে চাই নিজেদের প্রিয় মাতৃভূমি আরাকানে। মে মাসে মিয়ানারের রাখাইনের মংডু শহরে ঘুরে এলেন ২০ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি। এসময় শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো: মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে সাতজন বাংলাদেশী কর্মকর্তাও সফর করেন।

সেদিন (৫ মে) সকাল ৯টায় টেকনাফের বাংলাদেশ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি দিয়ে প্রতিনিধি টিম “গো সি অ্যান্ড ভিজিট” কর্মসূচির অংশ হিসেবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহর ও আশপাশের গ্রাম, স্থাপনা পরিদর্শন শেষে বিকেল ৬টায় ফিরে এসেছেন।

কক্সবাজারের শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মো: মিজানুর রহমান মিয়ানমার থেকে ফিরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন ছাড়া বাংলাদেশের সমস্যা শেষ হবে না। ৭০ বছরের সমস্যা একদিনে শেষ হওয়ার কথা না। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা পরিলক্ষিত হয়েছে। তারা অনেক আন্তরিক বলে মনে হয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, আমাদের ‘গো সি অ্যান্ড ভিজিট’ দাবির প্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের মংডু ও আশপাশের গ্রাম, স্থাপনা দেখানোর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তারা মিয়ানমারে প্রত্যাবাসিত রোহিঙ্গাদের আস্থা ফিরাতে চায়।

বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই করা প্রায় ২২০ পরিবারের মধ্য থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত টেকনাফ ২৬ নম্বর ক্যাম্পের ১৪ পরিবার, ২৭ নম্বর ক্যাম্পের ৪ পরিবার ও ২৪ নম্বর ক্যাম্পের ২ পরিবারসহ মোট ২০টি পরিবারের ৩ জন নারী সদস্যসহ ২০ সদস্যের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি করিম উল্লাহ, মো: সেলিম, রশিদ উল্লাহ. ছৈয়দ আলম, অলি হোসেন, মো: ফারুক, মোহাম্মদ ইলিয়াস, সাঈদ আলম, আবুল হোসেন, আবু সুফিয়ান, আবু তৈয়ুব, মো: ইলিয়াস, নোমান, মো: তাহের, মো: আলম, আবু সামা, আবদু সালাম, জমিলা, রহিমা খাতুন ও সুবিয়া খাতুন স্পিডবোটযোগে মংডু ঘুরে আসেন।

নিজ দেশের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে এসে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি জমিলা, আবু সুফিয়ান, করিম উল্লাহ সাংবাদিকের সাথে কথা বলেন। তারা জানান, ‘নিজ গ্রামের চিহ্ন পর্যন্ত সেখানে অবশিষ্ট নেই। কিছু ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে আমাদের রাখার জন্য। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ আমাদের নাগরিকত্ব ফায়সালা নিয়ে কোনো সদুত্তর দেননি। এভাবে আমরা সেখানে কিভাবে ফিরে যাবো?’

আরআরআরসির সামনে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য মো: সলিম। তিনি বলেন, রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি প্রত্যাবাসনের উপযোগী না। ছয় বছর আগে ফেলে আসা জন্মভূমিতে গড়ে তোলা হয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী ও পুলিশের ব্যারাক, ফাঁড়ি ও চৌকি। কিছু জায়গাতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য শেড তৈরি হয়েছে। ওই শেডে রোহিঙ্গারা থাকতে রাজি হবে না।

রাখাইনে ফেলে আসা জন্মভিটাতে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন করা না হলে বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরে থাকা কোনো রোহিঙ্গা ফিরতে রাজি হবে না।

একই কথা বলেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্য মোহাম্মদ তাহের (৪৫)। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি ও পরিবেশ কোনোটাই নেই। তাদের (রোহিঙ্গা) গ্রামগুলো সেনাবাহিনীর দখলে। মংডু শহর থেকে উত্তর দিকে সাত কিলোমিটার দূরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের গুচ্ছগ্রাম আদলের মডেল ভিলেজ। কয়েক শ’ একর জমিতে তৈরি হচ্ছে প্রায় চার হাজার রোহিঙ্গা ধারণক্ষতার ১৫টি পৃথক ‘মডেল ভিলেজ’। ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে পৃথক দুটি ভিলেজ। একটি ভিলেজে ২১৫ পরিবার এবং আরেকটিতে ৯৯ পরিবারের থাকার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সেদিন দুপুরে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মডেল ভিলেজ দেখানো হয়। তখন রোহিঙ্গাদের বোঝানো হয়, মডেল ভিলেজে যারা থাকবেন, তাদের সরকারি উদ্যোগে আড়াই কানি (এক একর) করে চাষাবাদের জমি দেয়া হবে, রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়ালেখার সুযোগ দেয়া হবে, যা আগে হতো না।

আরআরআরসি কার্যালয় সূত্র মতে, চীনের মধ্যস্থতায় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তখন প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ থেকে যে আট লাখ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে থেকে পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে এক হাজার ১৪০ জন রোহিঙ্গাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সম্মতি পাওয়া গিয়েছিল। অবশিষ্ট ৪২৯ জন রোহিঙ্গার বিষয়ে মিয়ানমারের আপত্তি ছিল। বাংলাদেশ সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধিদল গত মার্চ মাসে টেকনাফে এসে ৪২৯ জন রোহিঙ্গার পাশাপাশি তাদের পরিবারে জন্ম নেয়া আরো ৫১ জন শিশুর তথ্য সংগ্রহ করেন। রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জনের জন্য তাদের (রোহিঙ্গা) প্রতিনিধিদলকে রাখাইনের পরিস্থিতি দেখার সুযোগ দেয়া হয়েছে।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩ আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে আট লাখ এসেছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কয়েক মাসে রাখাইন রাজ্য থেকে। রোহিঙ্গা ঢলের ছয় বছরেও একজন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। এর আগে দুবার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা ভণ্ডুল হয়েছিল।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করতে ঢাকায় এসেছেন চীনের বিশেষ দূত দেং শিজুন। তিন দিনের সফরে তিনি গত রোববার ঢাকায় আসেন। গত সোমবার (৩১ জুলাই) তিনি ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমে নের সাথে বৈঠক করেন। এছাড়া তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

চীনের বিশেষ দূতের এ সফর, সাক্ষাৎ ও বৈঠক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ, চীন কোনো পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ঢাকায় আলোচনাগুলোতে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের আওতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ, বিশেষ করে পাইলট প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ সফরের আগে মিয়ানমার সফর করেন চীনের বিশেষ দূত।

ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের আওতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমিত পরিসরে হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর চেষ্টা করছে।
এ বছর বর্ষা শুরুর আগেই প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার চেষ্টা ছিল। কিন্তু তা শুরু করা যায়নি। আগামীতে প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য আলোচনা চলছে। তবে জাতিসঙ্ঘ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো এখনই প্রত্যাবাসন শুরুর বিরুদ্ধে। তারা মনে করে মিয়ানমার পরিস্থিতি এখন প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল নয়। বাংলাদেশ জোর দিয়ে বলেছে, প্রত্যাবাসন হবে স্বেচ্ছায়। কাউকে জোর করে ফেরত পাঠানো হবে না।

 


আরো সংবাদ



premium cement
দৌলতদিয়ায় ৫২ হাজারে পদ্মার বোয়াল বিক্রি দেশের মেরিন অ্যাকাডেমিগুলোকে আন্তর্জাতিক মানের করা হবে : নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা গণঅভ্যুত্থানের চেতনার আলোকে বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে : অধ্যাপক মুজিবুর সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুলের নামে মামলা ইমরান খান ও বুশরার বিরুদ্ধে আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রায় স্থগিত এখন পর্যন্ত পুতিন-ট্রাম্প বৈঠকের আয়োজনের জন্য কোন বাস্তব তাগিদ নেই : ক্রেমলিনের মুখপাত্র চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা গতবারের চেয়ে বেশি হবে : টি বোর্ড চেয়ারম্যান ইয়েমেনের হাউছিদের বিরুদ্ধে ‘শক্তি, প্রত্যয়’ নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি নেতানিয়াহুর স্ত্রী-মেয়েসহ সোলায়মান জোয়ার্দারের ৩৫টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পেছনে মাস্কের নেপথ্য শক্তি হওয়াকে অস্বীকার ট্রাম্পের স্ত্রী-সন্তানসহ শাহরিয়ার আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

সকল