২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ডেঙ্গুতে ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু ১৯, ভর্তি ১৭৯২ জন

-

ডেঙ্গুতে প্রতিদিনই মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। এবার ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হলো ১৯ জনের এবং একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে এক হাজার ৭৯২ জন। চলতি বছর এমনকি এর আগে কখনো ২৪ ঘণ্টায় এত ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়নি দেশে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে প্রতি মিনিটে একজনের (১.২৪ জন) বেশি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছেন এদের বেশির ভাগই মুমূর্ষু। কারো চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, কারো দাঁত দিয়ে আবার কারো শরীরে উঠেছে র‌্যাশ।
সাধারণ ডেঙ্গু অর্থাৎ প্রাথমিক ডেঙ্গু হলে বা শরীরে মারাত্মক কোনো লক্ষণ নেই এমন ডেঙ্গু আক্রান্তকে হাসপাতালে ভর্তিও করা হচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে অথবা হাসপাতাল থেকে মুমূর্ষু না হলে হাসপাতালে ভর্তি হতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। জরুরি বিভাগে ভর্তি হতে এলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা সাধারণ মানের আক্রান্ত হলেই ওষুধ লিখে দিয়ে প্রচুর পানি, স্যালাইন, ডাবের পানি ও ভিটামিন সি-জাতীয় ফল বেশি করে খেতে পরামর্শ দিয়ে বাসায় থাকতে বলছেন এবং নির্দিষ্ট দিন পর আবার আসতে বলে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এর কারণ অবশ্য হাসপাতালের ধারণক্ষমতা। হাসপাতালগুলো এখন ডেঙ্গু রোগীতে ঠাসা। সরকারি হাসপাতালে রোগী ভর্তির জায়গা নেই। অনেক হাসপাতালে মোট ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর মুগদা হাসপাতাল একটি। এটা কাগজে-কলমে ৫০০ বেডের একটি হাসপাতাল; কিন্তু এই হাসপাতালে সবসময় ৫০০-এর বেশি ডেঙ্গু রোগীই ভর্তি থাকছেন। ফলে অন্য রোগীর চিকিৎসায় এই হাসপাতাল সমস্যায় পড়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
বরাবরের মতো ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজধানীতে। ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ভর্তি হয়েছেন ৯২২ জন। এখানে প্রতি দেড় মিনিটেরও কম সময়ে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। অন্য দিকে ঢাকার বাইরে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল একই সময়ে ভর্তি হয়েছেন ৮৭০ জন। গতকাল বুধবার ৮টা পর্যন্ত এর আগের ২৪ ঘণ্টায় দেশে যত ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে এর হিসাব।
এবার বৃষ্টিপাতের ধরনে খুব বেশি পরিবর্তনের কারণে বেড়েছে ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশা। সময় মতো মশক নিধন অভিযানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ব্যর্থ হওয়ায় এমন হয়েছে বলে মনে করছেন ঢাকাবাসী। লোক দেখানো ফগিং (ধোঁয়া ছড়ানো) করা হলেও লার্ভা ধ্বংসে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই বলে ঢাকার মানুষ অভিযোগ করছেন। তা ছাড়া মশা নিধনে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয় সেগুলো খুব বেশি কার্যকর নয় বলে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার গবেষকরা বলছেন। তারা বলছেন, একই কীটনাশক বারবার প্রয়োগ করায় মশা নিজের মধ্যে প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ফলে দীর্ঘ দিন থেকে ব্যবহৃত কীটনাশকে আর কাজ হচ্ছে না। সময় হয়েছে নতুন করে কীটনাশক নিয়ে আসার। এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ডা: মো: শারফুদ্দিন আহমদ।
চলতি জুলাই মাসের গত ১৯ দিনে (১৯ জুলাই সকাল পর্যন্ত) দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১৭ হাজার ৮১৪ জন। তবে এবার জুলাই মাসের ক’দিনেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৯৯ জনের। এটা নিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৪৬ জনের। সারা দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের যা অবস্থা তাতে গতকাল সকালের পর থেকে আরো এমন ১৯ জনের মৃত্যু হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে বলছেন জনস্বাস্থ্য ডা: আহমেদ পারভেজ জাবীন। ফলে আজ বৃহস্পতিবারই জুলাই মাসে এই ক’দিনে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ১০০ ছাড়াবে। এটা একটি নতুন রেকর্ড। কোনো মাসের মাত্র ২০ দিনে এর আগে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা কখনোই ১০০ হয়নি। তিনি বলেন, ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে যারা কাজ করেন তারা যদি স্বাস্থ্য অধিদফতরের হুশিয়ারি আমলে নিতেন তাহলে এমন পরিস্থিতি হতো না।
উল্লেখ্য, এডিস মশার লার্ভা ধ্বংসে সিটি করপোরেশনের নতুন উদ্যোগ নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। সিটি করপোরেশনের মেয়র সৈয়দ আতিকুল ইসলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘুরে এসে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, মশার লার্ভা ধ্বংসের কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু এবার এডিস মশার বংশ আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে তা স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডেঙ্গু প্রাক মৌসুম জরিপে উল্লেখ করেছে। ঢাকার মধ্যবাড্ডার বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান বলছেন, ‘ক্ষমতাসীনদের মধ্যে কথা বেশি পছন্দ করেন সিটি করপোরেশন মেয়র। এটা তার কথার কথা মাত্র। বাস্তবে তিনি কাজ করে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
ভোলায় বাড়ছে ডেঙ্গু নিউমোনিয়া, এক শিশুর মৃত্যু : ভোলা প্রতিনিধি জানান, ভোলায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়া সংক্রমণ। প্রতিদিনই এ দুই রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন গড়ে ২০ থেকে ৩০ রোগী। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ২৭ জন এবং নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়েছে ২০ জন।
গত ২০ দিনে জেলার ৬টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সও ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯৩ জন এবং নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়েছে ৪৩১ জন। যাদের মধ্যে গত ৩ দিন আগে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন এক শিশু মারা গেছে।
হাসপাতালে রোগীদের চাপ বেড়ে যাওয়ায় তাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা। চিকিৎিসকরা বলছেন, এ মওসুমে ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ অতিথের যে কোনো সময়ের চেয়ে অনেকটাই বেশি। এ মাসেই ডেঙ্গু-নিউমোনিয়ার সর্বোচ্চ রোকর্ড। যা ভাবিয়ে তুলেছে রোগীর স্বজনদের।
এদিকে, উপকূলীয় জেলা ভোলায় হঠাৎ করেই বাড়তে থাকা ডেঙ্গু ও নিউমোনিয়া নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্যবিভাগ। তবে সবচেয়ে বেশি শিশুদের নিউমোনিয়া। আক্রান্তদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছে স্বজনরা। হাসপাতালে দেখা গেছে আক্রান্তদের চাপ।
ভোলার ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, জুলাই মাসজুড়েই এ দুটি রোগের প্রকোপ অনেক বেশি। সপ্তাহে ১৩৬ জন নিউমোনিয়া ও ৭২ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।
বর্তমানে চিকিৎসাধীন আছেন নিউমোনিয়া আক্রান্ত ২০ জন এবং ডেঙ্গু আক্রান্ত ২৭ জন। ভোলার ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা: মু. মনিরুল ইসলাম বলেন, গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণের কারণে শিশুদের ঠাণ্ডা লেগে ছড়িয়ে পড়ছে নিউমোনিয়াসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগ। এক কথা বলা যায়, আবহাওয়ার পরবির্তনের কারণে রোগের প্রকোপ কিছুটা বেশি।
অন্যদিকে ডেঙ্গু বাড়লেও বর্ষার প্রবণতা কমে গেলে তা নিয়ন্ত্রণ চলে আসবে। তবে মানুষকে সচেতন হতে হবে। আমরা রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে যাচ্ছি। পর্যাপ্ত ওষুধ সরবরাহ রয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে।
ভোলার সিভিল সার্জন ডা: কে এম শফিকুজ্জমান বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় ৬টি স্বাস্থ্য কমপ্লেলেক্স পাঁচটি করে মোট ৩০টি ওয়ার্ড বাড়ানো হয়েছে। চিকিৎসক ও নার্সরা রোগীদের প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।


আরো সংবাদ



premium cement