২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

নাব্যতা সঙ্কটে নদীমাতৃক দেশ

ক্রমেই ছোট হয়ে আসা ইছামতি নদী। মুন্সীগঞ্জ থেকে তোলা ছবি : নাসিম সিকদার -

-অস্তিত্ব সঙ্কটে ১৭৭টি নদী আড়াই হাজার কিমি নৌপথে লঞ্চ-স্টিমার চলার পানি নেই
-৩১০ নদীর বেশির ভাগই নাব্যতা সঙ্কটে ভুগছে

নাব্যতা সঙ্কটের কারণে নদীমাতৃক দেশ তার স্বাভাবিক রূপ হারিয়ে ফেলছে। অযতœ অবহেলা আর দখল দূষণে বিপন্ন দেশের নদ-নদী। ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে অনেক নদ-নদী। খননের অভাবে দেশের প্রধান প্রধান নদ-নদীতে এখন ধু ধু বালুচর। নাব্যতার অভাবে নদীগুলো হারাচ্ছে অস্তিত্ব, বন্ধ হচ্ছে দীর্ঘকালের নৌপথ।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, গত ৪০ বছরে ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। অন্য একটি সূত্র বলছে, দেশের প্রায় আড়াই হাজার কিলোমিটার নৌপথে এখন আর সহজে লঞ্চ-স্টিমার চলার মতো পানি নেই। দেশের ৩১০ নদীর মধ্যে বেশির ভাগই এখন নাব্যতা সঙ্কটে ভুগছে। এর মধ্যে ১৭৭টি নদ-নদী বর্তমানে অস্তিত্বের সঙ্কটে। এসব নদ-নদী আংশিক কিংবা পুরোপুরিভাবে মৃত।

শত শত বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরও দেশের মানুষের যোগাযোগের বৃহৎ মাধ্যম ছিল নৌপথ। গত দুই দশকেও নদীগুলো তার স্বরূপ ধরে রেখেছিল। কিন্তু সড়ক পথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকায় মানুষ সড়কে বেশি যাতায়াত শুরু করে। একই সময়ে নৌপথে চলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় ধীরে ধীরে নদীপথ তার প্রাণ হারিয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে।
দেশের বহু অঞ্চল থেকে এখনো রাজধানী ঢাকায় যাতায়াতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম নৌপথ। এ ছাড়া বহু অঞ্চলে নৌপথে যাতায়াত করা যায় সারা বছরই। কিন্তু সড়ক পথে যাতায়াত বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং সরকার কর্তৃক সড়ক যোগাযোগকে প্রাধান্য দেয়ার বিপরীতে নৌপথ নিয়ে গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করায় দিন দিন নদীগুলো নাব্যতা হারাচ্ছে। বর্ষাকালে নদ-নদীতে পর্যাপ্ত পানি থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে দেশব্যাপী নাব্যতা সঙ্কটের খবর পাওয়া যায় অহরহ। এই নাব্যতা সঙ্কটের মূলেই রয়েছে খনন কার্যক্রম না চালানো।
নৌপথের এই বেহাল দশার জন্য দূষণ-দখল ছাড়াও নিয়মিত খনন না করাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নদীমাতৃক দেশ হিসেবে দেশের প্রত্যেক অঞ্চলেই নৌপথে যোগাযোগ করার মতো নদী আছে। কিন্তু সড়ক পথের উন্নয়নের দিকে অতিরিক্ত নজর দিতে গিয়ে নৌপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নদ-নদীতে নাব্যতা বজায় রেখে যোগাযোগ স্বাভাবিক রাখতে নৌপথ নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।

অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিগত ৪০ বছরে ১৮ হাজার কিলোমিটার নৌপথ হারিয়ে গেছে। এ ছাড়া দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ৮৮টি নৌপথে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ৫৭টি রুটে ঝুঁঁকি নিয়ে দোতলা লঞ্চসহ বিভিন্ন নৌযান চলাচল করছে। বাকি ২৭টি নৌপথ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শুধু দক্ষিণাঞ্চলেই নয়, দেশব্যাপী যত নদী ও খাল আছে সবগুলোর একই চিত্র।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) জানায়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল, হাওরাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকাকে প্রাধান্য দিয়ে ১৭৮টি নদ-নদী খনন করে প্রবহমান করার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিআইডব্লিউটিএর মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে। তবে হতাশার ব্যাপার হলো, ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এর মধ্যে পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার মতো আন্তর্জাতিক নদীসহ দেশের সব নদী ক্রমান্বয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোর পানি কমে এমন অবস্থায় দাঁড়ায়, যাকে দেখলে আর নদী বলে মনে হয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীমাতৃক এই দেশে নদীর অবস্থা ক্রমান্বয়ে যেভাবে সঙ্কুচিত হচ্ছে, তাতে আগামী কয়েক বছরে নদীতে পানি প্রবাহ থাকবে কি না সন্দেহ। নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় দেশের অনেক জায়গায় হাল্কা নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নদীগুলোর সংস্কার এখনই অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। নদী রক্ষায় সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশনা জারি করায় কিছু তৎপরতা দেখা গেলেও এর পর নদী নিয়ে কারো উদ্যোগ নেই বললেই চলে।
জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অভিন্ন উৎসের ৫৪টি নদীর মধ্যে ৪০টির পানি প্রবাহ শুকনো মৌসুম শুরুর আগেই থেমে যায়। অন্য দিকে প্রতি বছর ৩ থেকে ৬ ফুট পলিতে এসব নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। ফলে নাব্যতার অভাবে একের পর এক নৌপথ বন্ধ হচ্ছে। পদ্মা-যমুনার মিলিত স্রোতে আরিচা, দৌলতদিয়া, পাটুরিয়া, নগরবাড়ী ফেরি সার্ভিস চালু রাখতে প্রতিদিন খরচ হচ্ছে লাখ লাখ টাকা।

বাংলাদেশের পানি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ১৯৯৭ সালে একটি কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছিল। এতে দেশের প্রবহমান নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সরকার নদী খনন ও ড্রেজিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিলেও এ কাজে আশানুরূপ সাফল্য দেখাতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ। বরং সংস্থাটির বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগই বেশি। বিশেষ করে মেগা প্রকল্পগুলোতে অর্জন অতি সামান্য হলেও অর্থ অপচয়ের মাত্রা অনেক বেশি।
একটি সূত্র জানায়, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে জামালপুরের নালিতাবাড়ি পর্যন্ত কংস ও ভোগাই নদীর ১৫৫ কিলোমিটার খনন প্রকল্প হাতে নেয় বিআইডব্লিউটিএ। এতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, নদী দু’টির প্রশস্ততা ৮০ থেকে ১০০ ফুট এবং শুকনো মৌসুমে গভীরতা ৮ থেকে ১০ ফুট হবে। কাগজে-কলমে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। তবে জানা গেছে, কংস ও ভোগাই নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা মোটেও বাড়েনি। তাদের দাবি, ১৩৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বেশির ভাগই পানিতে গেছে।

সূত্র আরো জানায়, ২০১৯ সালে পুরনো ব্রহ্মপুত্রের ২২৭ কিলোমিটার খনন শুরু হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পে বরাদ্দের পরিমাণ ২ হাজার ৭৬৩ কোটি টাকা। এতে বলা হয়েছিল চলতি বছরের জুন-জুলাইয়ের মধ্যে যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল থেকে কিশোরগঞ্জের টোক পর্যন্ত প্রশস্ততা ৩০০ ফুট ও গভীরতা অন্তত ১০ ফুট হবে। তাতে এ নৌপথ দিয়ে ঢাকা পর্যন্ত বড় নৌযান চলবে। কিন্তু সময় মতো কাজ না করে প্রকল্পের মেয়াদ আরো অন্তত তিন বছর বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে বলে বলে জানা যায়।
এ দিকে যমুনা নদীর গাইবান্ধার বালাসী থেকে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত ফেরিপথ চালুর লক্ষ্যে ২০১৭ সালে ১২৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকার প্রকল্প হাতে নেয় বিআইডব্লিউটিএ। খনন শুরুর এক পর্যায়ে সংস্থাটি জানায়, এই নৌপথে ফেরি চলাচল সম্ভব নয়। তবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে লঞ্চ চলাচল করবে। ২০২২ সালের ৯ এপ্রিল বালাসী-বাহাদুরাবাদ নৌপথে লঞ্চ চলাচল উদ্বোধন করা হয়। তবে তীব্র নাব্যতা সঙ্কটের কারণে এক মাসের মধ্যেই লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদী খননে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার জন্য বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের অদক্ষতা, উদাসীনতা, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও দুর্নীতি দায়ী। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে নয়া দিগন্তকে বলেন, নাব্যতা সঙ্কট নিরসন না হওয়ার প্রধান কারণ অনিয়ম ও দুর্নীতি। বেদখল এবং বিলুপ্ত নদী ও নৌপথ পুনরুদ্ধার করে প্রয়োজনীয় খননের জন্য বর্তমান সরকার পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিয়েছে কিন্তু গত ১৪ বছরেও আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগের কিছু সংখ্যক প্রকৌশলী, কর্মকর্তা ও কর্মচারী অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত উল্লেখ করে নদী ও পরিবহন বিষয়ক এই গবেষক বলেন, এসব দুর্নীতিবাজের কারণেই নদী খনন, নৌপথের পলি অপসারণ ও অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে না। তিনি বলেন, নৌ খাতে অর্থ বরাদ্দের খবরের পাশাপাশি নদী খননে শত শত কোটি টাকা দুর্নীতির খবরও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু সরকার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এতে দুর্নীতিবাজরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিভাগকে যত দিন অনিয়ম ও দুর্নীতিমুক্ত না করা যাবে, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না হবে, ততদিন নদী খননের জন্য ডজন ডজন মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েও নৌপথের নাব্যতা সঙ্কট দূর করা যাবে না।


আরো সংবাদ



premium cement