২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
নাগরিক প্লাটফর্মে ড. দেবপ্রিয়

রাজনৈতিক উপাদান বর্জিত আমলাতান্ত্রিক বাজেট এটি

-


দেশে নির্বাচনী ডামাডোল বাজলেও এবারের বাজেট নির্বাচনী বাজেট হয়নি। এটা হলো রাজনৈতিক উপাদান বিবর্জিত আমলাতান্ত্রিক বাজেট। প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে রাজনীতিবিদ, সংসদ সদস্য ও নাগরিকদের কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্লাটফর্মের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে বাজেটে জনতুষ্টি অর্জনের মতো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বাজেট গাম্ভীর্য হারিয়ে এখন প্রামাণ্য প্রদর্শনীতে পরিণত হয়েছে। সরকার দেশ-বিদেশ থেকে ঋণ করে ঘি খাচ্ছে।

রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে সিপিডি এবং এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২৩-২০২৪ : অসুবিধাগ্রস্ত মানুষগুলো কি পেল?’ শীর্ষক গতকাল এক মিডিয়া ব্রিফিং এ তিনি এই মন্তব্য করেন। নাগরিক প্লাটফর্মের আহ্বায়ক এবং সিপিডি সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মূল প্রতিবেদন উপস্থাপনা করেন। সিপিডি ট্রাস্টি বোর্ড এবং নাগরিক প্লাটফর্ম কোর গ্রুপ সদস্য অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সিপিডি সম্মাননীয় ফেলো ও নাগরিক প্লাটফর্ম কোর গ্রুপ সদস্য প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম, দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্র (ডিএসকে) নির্বাহী পরিচালক ড. দিবালোক সিংহ, নিউ এজ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতি ও নাগরিক প্লাটফর্ম কোর গ্রুপ সদস্য আসিফ ইব্রাহিম, প্রোগ্রাম হেড, ব্র্যাক শিক্ষা উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (ব্র্যাক আইইডি) সমীর রঞ্জন নাথ, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, সিপিডি তৌফিকুল ইসলাম খান।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেটে আগে যে গাম্ভীর্য ছিল, এখন অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রমাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর অংশ হয়ে গেছে। বাজেটের ভেতর দিয়ে গত ১৫ বছরে সরকারের যে অর্জনগুলো ছিল, ওই শত শত পৃষ্ঠার ভেতর দিয়ে মনে দাগ কাটেনি। তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণের মরিয়া চেষ্টার ফলে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে এগুলোকে রাজনৈতিক বিবেচনায় মূল্যায়ন করা হয়েছে বলেও মনে হয় না। এটা যে নির্বাচনী বাজেট না তা লক্ষণীয়। পদক্ষেপগুলো একটি রাজনৈতিক সরকারের বিবেচনায় কতটুকু গ্রহণযোগ্য তাতে সন্দেহ আছে। এই বাজেট আমলাতান্ত্রিকভাবে রাজস্ব আহরণের প্রয়োজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়েছে। ওই পদক্ষেপগুলো একটি রাজনৈতিক সরকারের বিবেচনায় কতখানি গ্রহণযোগ্য এটা আমার সন্দেহ আছে। এটা খুবই আমলাতান্ত্রিকভাবে রাজস্ব আহরণের প্রয়োজনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়েছে। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে তার অনেকগুলো পদক্ষেপ, দুই হাজার টাকা (টিনধারীদের ন্যূনতম কর) তো বটেই, সারচার্জ- এ ছাড়া অন্যান্য যেগুলো আছে নি¤œ মধ্যবিত্ত, অনেক সময় দরিদ্র মানুষকে প্রভাবিত করবে নেতিবাচকভাবে।

উপস্থাপনায় দেবপ্রিয় বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে রকম, অর্থনৈতিক পরস্থিতি যে রকম, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা যেটি নির্ধারণ করতে হচ্ছে, এত দিনের ঘাটতিপূরণ করার জন্য, তা বর্তমানের বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হচ্ছে না। যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে সেটিও বাস্তবসম্মত না। এটি সবাই জানে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা রাজস্ব আদায়ের মরিয়া চেষ্টা, এটা কিছুটা হলেও অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে, আইএমএফের শর্ত পূরণ করার জন্য, কিন্তু এখানে কোনো রাজনৈতিক ধোলাই হয়নি। রাজনৈতিক ধোলাই যদি হতো, সংসদ সদস্য ও স্থায়ী কমিটিগুলোর কাছে নিয়ে যেতেন, এগুলোর অনেকগুলোতেই উনারা রাজি হতেন না। তার প্রকাশ কিন্তু এখন সংসদ আলোচনায় ক্রমান্বয়ে বেড়বে।

বিদ্যুতের আলোচনা, আমদানি নিয়ন্ত্রণের আলোচনা- এগুলো সবই আগামীতে আসবে। তিনি বলেন, বহু আগে একজন মরহুম অর্থমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, প্রত্যেক বাজেটই তো নির্বাচনী বাজেট। আমি গত ৫ বছর ধরেই তো নির্বাচনী বাজেট দিয়ে যাচ্ছি। এটি একটি রাজনৈতিক উত্তর হতে পারে। নির্বাচনী বাজেটের ভেতর কী থাকে? খরচযোগ্য তদারকিহীন টাকা (লোস মানি) থাকে, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন জায়গায় লুকায়িত যে অর্থ রয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তা তার চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, আপনি যদি জনতুষ্টি চান তাহলে তো সামাজিক সুরক্ষা খাতে আরো বেশি বরাদ্দ দেবেন। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড যেটি দেড় বছর ধরে শুনছি, এখনো জানি না কয়টি কার্ড দিয়েছে, কোন ফ্যামিলি পেল? তিনি বলেন, রাজনীতি যদি থাকত তাহলে জনপ্রতিনিধিরা বলত ওখানে টাকা দাও। ওখানে খাদ্য সাহায্য দাও, শহরের ভেতরে ওএমএসের পরিমাণ আরো বাড়াও, ট্রাকের সংখ্যা বাড়াও, জেলা পর্যায়ে ওএমএস নিয়ে যাও। এই রিটার্ন সনদ পেতে দুই হাজার টাকা, এটা কেউ দেয়? কত টাকা এটা থেকে আদায় হবে? কেউ বলছে এক হাজার কোটি টাকা আদায় হতে পারে।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বণ্টনে ন্যায্যতা না থাকলে বাজেটের দর্শন প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সরকারের বিনিয়োগসহ সার্বিক বিনিয়োগ ব্যত্যয় হলে কর্মসংস্থান হয় না। আয় বাড়ে না। মানুষ সুফল পায় না। তিনি বলেন, আগামী এডিপিতে এক হাজার ২৫০টি প্রকল্পের মধ্যে ৮৭৮টি প্রকল্পই ২০২৪ সালে সমাপ্ত করতে হবে। এসব হলো টেনে আনা প্রকল্প। এটা একটা সমস্যা। প্রকল্পগুলোর গড় মেয়াদকাল চার বছরের বেশি। এক চতুর্থাংশ প্রকল্প ওভাররান করছে। তিনি বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব, বার বার সংশোধনের মাধ্যমে সময় বাড়ানো, ফলে ব্যয় বাড়ছে। এসবের জন্য কোনো জবাবদিহিতা নেই। পুরস্কার ও তিরস্কার নেই।

সুলতানা কামাল বলেন, এবারের বাজেট দেয়ার পরে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মনে হয়েছে দরিদ্র মানুষেরা ও পিছিয়ে পড়া মানুষরা বা যাদেরকে পেছনে রাখা হয়েছে তারা অদৃশ্য। তাদের জন্য খুব কিছু যে রয়েছে তা আমরা দেখতে পারছি না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাজেট ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা দেখলে মনে হয়, দরিদ্র মানুষেরা দরিদ্র হয়ে জন্মায় এবং দরিদ্র থাকে বলেই কিছু অধিকার তাদের প্রাপ্য হবে না।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দরিদ্র মানুষ তো দূরের কথা। আজ সারা বাংলাদেশে জ¦ালানি ক্ষেত্রে যে হাহাকার, আমরা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। গত বছর থেকে বিভিন্ন ধরনে জ্বালানির যে দাম বেড়েই চলছে, এটার অভিঘাত সবাই ভোগ করছে। তিনি বলেন, আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনে বিনিয়োগ বেশি দরকার। কিন্তু এবার বাজেটে সেই বরাদ্দটা বেশি এই খাতে দেখছি না।

 


আরো সংবাদ



premium cement