২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
দীর্ঘক্ষণ রোদে থাকলে ফোস্কা পড়ছে

অব্যাহত তাপদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন

-


অব্যাহত তাপদাহে বিপর্যস্ত জনজীবন। দীর্ঘক্ষণ রোদের মধ্যে থাকলে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে গায়ে। বাতাসে যেন আগুনের হলকা। হঠাৎ নাকেমুখে লাগলে মনে হচ্ছে পুড়ে গেল। গত মে মাসের শেষ দিক থেকেই বাংলাদেশে শুরু হয় প্রচণ্ড গরম আবহাওয়া। এখন চলছে মাঝারি থেকে তীব্র তাপ প্রবাহ। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে গেছে। উচ্চ তাপমাত্রার সাথে বাতাসে বেশি মাত্রার আর্দ্রতার কারণে গরমের অনুভূতি বেড়েছে। বেশি আর্দ্রতার কারণে ঘাম শুকাতে পারছে না বলে মানুষের মধ্যে বাড়ছে অস্বস্তি। এ দিকে বিদ্যুতের ঘন ঘন লোডশেডিং মানুষের বিরক্তির মাত্রা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

দুপুরের দিকে রোদের উত্তাপ এত বেশি উঠে যাচ্ছে যে, শরীর থেকে ফোটায় ফোটায় ঝরে পড়ছে ঘাম। ভিজে যাচ্ছে পরনের কাপড়। পানি শূন্যতায় তপ্ত বাতাস সহ্য করতে না পেরে হিট স্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। হঠাৎ অজ্ঞান পড়ে রাস্তায় পড়ে যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে হিটস্ট্রোকের ঘটনা বেশি বাড়ছে। যারা রোদে বেশিক্ষণ ঘুরাফেরা করে অথবা উত্তপ্ত পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে তাদের গায়ের খালি অংশে ফোস্কা পড়ে যাচ্ছে। হাতের যে পিঠে রোদ লাগে সেখানে ফোস্কা পড়ে কালো হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, রোদে কাজ করতে যারা বাধ্য হচ্ছেন তাদের উচিৎ প্রচুর পানি পান করা এবং কিছুক্ষণ পরপর ছায়ায় বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজ করা।
মেয়ের শেষ দিকে বৃষ্টি হওয়ার পর দেশে আর ভারী বৃষ্টি হয়নি। ফলে সময়ের ব্যবধানে ডেঙ্গু জীবাণুবাহিত এডিস মশাসহ অন্যান্য মশার সংখ্যা বেড়ে গেছে। ঢাকা শহরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ধ্যার পর মশারির বাইরে অবস্থান করা সম্ভব হচ্ছে না। মশার কামড়ে কালো দাগ বসে যাচ্ছে শরীরে।

এ দিকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে দেশব্যাপী চলমান গরম আবহাওয়ার খুব বেশি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবে সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। ইতোমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে সামান্য কিছু বৃষ্টি হলেও তা দিয়ে উচ্চ তাপমাত্রাকে ঠাণ্ডা করে দেয়ার মতো কিছু ঘটছে না। আবহাওয়া অফিস বলছে, গতকাল সারা দেশে বান্দরবান (১২ মিলিমিটার) ছাড়া দেশের আর কোথাও বৃষ্টি হয়নি। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী বিভাগে চলছে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ। অন্য দিকে যশোর, রাজশাহী, দিনাজপুর, সৈয়দপুরের ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এসব অঞ্চলে তাপমাত্রা উচ্চতাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে উঠে যাচ্ছে।

কানাডার সাসকাচুয়ান ইউনিভার্সিটির আবহাওয়া গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলছেন, দেশব্যাপী চলমান তাপ প্রবাহ আরো এক সপ্তাহ অব্যাহত থাকতে পারে। এর মধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশে প্রবেশ করে বৃষ্টিপাত ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
মোস্তফা কামাল বলেছেন, জুনের ১২ তারিখ পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা জেলায় উচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি অথবা ক্ষেত্রবিশেষে এরচেয়ে বেশিও উঠে যেতে পারে। ১৪ জুনের আগে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলো ছাড়া অন্য কোথাও বৃষ্টির তেমন সম্ভাবনা নেই। এ দিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, আজ বুধবার বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের তাপমাত্রা সামান্য হ্রাস পেতে পারে। তবে বর্তমান অবস্থা থেকে আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাপমাত্রার কিছু পরিবর্তন হতে পারে। তবে তা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে সাধারণত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে থাকে; কিন্তু এ বছর দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের সর্বদক্ষিণের থানা টেকনাফ থেকে অনেক দূরে ছিল। ১৯৯৭-৯৮ সালে বাংলাদেশে এ অবস্থা ছিল বলে আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন। আবহাওয়া অফিস পূর্বাভাস দিয়েছে যে, মৌসুমি বায়ু টেকনাফ পর্যন্ত অগ্রসর হতে আরো কমপক্ষে পাঁচ দিন লেগে যেতে পারে। লক্ষণীয় যে, আবহাওয়া অফিস চলতি জুনের প্রথম দিন থেকেই মৌসুমি বায়ুর আগমনের সংবাদ দিচ্ছে যে, আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে টেকনাফ উপকূল পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারে।
গতকাল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল দিনাজপুর ও সৈয়দপুরে ৪০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং সর্বনিম্ন ছিল বান্দরবানে ২৩.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানী ঢাকায় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ৩৮.৭ ও ২৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে দেশের অধিকাংশ স্থানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রাও যেমন অনেক বেশি আবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রাও নিচে নামছে না।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এ বছর প্রশান্ত মহাসাগরে একটি সুপার এল নিনো গঠন হতে পারে। এর প্রভাব এখনি বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ায় লক্ষ করা যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তাপদাহ শুরু হয়েছে, এর বিপরীতে বৃষ্টি হচ্ছে না বলেই চলে। এই এল নিনোর কারণে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় অনেকটা পরিবর্তন আসতে পারে।

অসহনীয় তাপদাহ ও বিদ্যুতের মারাত্মক লোডশেডিংয়ে রাজশাহীতে মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, অসহনীয় তাপদাহ ও বিদ্যুতের মারাত্মক লোডশেডিংয়ে রাজশাহীর মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই। অব্যাহত তাপপ্রবাহে মানুষ ও পশুপাখিরাও হাঁসফাঁস করছে। রাজশাহীর ওপর দিয়ে সপ্তাহখানেক থেকে মাঝারি তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রতিদিনই বাড়ছে। এতে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রাজশাহীতে অব্যাহত তাপপ্রবাহে নতুন করে খরার কবলে পড়েছে আম ও লিচু। বৃষ্টি কম হওয়ায় এ বছর আমের আকারও হয়েছে ছোট।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্র জানায়, গত পাঁচ দিনের মধ্যে কেবল ৪ জুন রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। এদিন ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এর আগে ৩ জুন রাজশাহীর তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২ জুন ছিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সোমবার (৫ জুন) তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর মঙ্গলবার (৬ জুন) রাজশাহীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সূত্রটি আরো জানায়, সাধারণত দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মৃদু তাপপ্রবাহ বলা হয়। তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকলে তাকে মাঝারি তাপপ্রবাহ হিসেবে ধরা হয়। অর্থাৎ এখন রাজশাহী ওপর দিয়ে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। তবে এর মধ্যে বৃষ্টির দেখা মেলেনি।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্র জানায়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা নেই। সর্বশেষ গত ২৭ মে রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়। এদিন ৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এরপর আর বৃষ্টির দেখা মেলেনি।

নীলফামারীর সৈয়দপুরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
নীলফামারী প্রতিনিধি জানায়, জ্যৈষ্ঠের খরতাপে পুড়ছে নীলফামারী। তীব্র রোদ আর গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে এই এলাকার জনজীবন। প্রচণ্ড গরমের সাথে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুতের লোডশেডিং চলায় মানুষজনের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে নীলফামারীর সৈয়দপুরে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কয়েক দিন ধরে নীলফামারীতে তীব্র তাপদাহ বিরাজ করছে। সকাল থেকেই সূর্য জানান দিচ্ছে তার শক্তি। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাপদাহর মাত্রা আরো তীব্র আকার ধারণ করছে। মানুষজন এ অবস্থায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হচ্ছে না। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাচল কমে গেছে। এ দিকে তাপদাহের সাথে শুরু হয়েছে ঘনঘন লোডশেডিং। দিন-রাত, এমনকি মধ্যরাতেও এলাকাভিক্তিক ভাগ করে লোডশেডিং দেয়া হচ্ছে। খরতাপ আর লোডশেডিং দুটো মিলেই মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা শুরু হয়েছে।
সৈয়দপুর আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ লোকমান হোসেন জানান মঙ্গলবার বেলা ৩টায় সৈয়দপুরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস; যা দেশের মঙ্গলবারের এটাই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলে তিনি জানান।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement