দাতা সংস্থার প্রতিশ্রুতিতে ৬২ শতাংশ ভাটা
- হামিদ সরকার
- ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০
প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে প্রকল্পে সহায়তাকারী উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রতিশ্রুতি ও অর্থবছরের পরিমাণটাও আগের বছরের তুলনায় কমছে প্রতি মাসেই। কারণ উন্নয়ন প্রকল্প (এডিপি) বাস্তবায়নের ওপর বিদেশীদের অর্থছাড়ের মর্জি নির্ভর করে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে জুলাই-জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৬২.৪৩ শতাংশ ভাটায় পড়েছে। আর এই প্রতিশ্রুতি প্রতি মাসেই তুলনামূলকভাবে কমছে। পাশাপাশি অর্থছাড়ও কমেছে একই সময়ে ৯.২০ শতাংশ। বেড়েছে ঋণের দায় পরিশোধের পরিমাণ। আর সাত মাসে নতুন করে বিদেশী ঋণ পাইপলাইনে ৯৭২ কোটি ডলার আছে বলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যেসব প্রকল্প বিদেশী অর্থায়নে হচ্ছে সেগুলো যথাসময়ে সমাপ্ত এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য। তাদের মতে, তাহলেই অর্থছাড় বাড়বে। আর সেটা হলে দাতাসংস্থা প্রয়োজন হলে প্রতিশ্রুতিও বাড়াতে পারে।
ইআরডির সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বৈদেশিক সাহায্যের প্রতিশ্রুত অর্থের পরিমাণ ১৭৬ কোটি ৫৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে প্রতিশ্রুতি এসেছিল ৪৬৯ কোটি ৮১ লাখ ১৭ হাজার ডলার। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় প্রতিশ্রুতি কমেছে ৬২.৪৩ শতাংশ বা ২৯৩ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ডলার।
হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, জানুয়ারিতে ঋণের প্রতিশ্রুতির শীর্ষে আছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি)। এ উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে সর্বোচ্চ ৮৪ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতি বিশ^ব্যাংকের আইডিএ প্রোগ্রাম থেকে, ৩০ কোটি ডলার। এআইআইবির প্রতিশ্রুতি ২৫ কোটি ডলার, জাপান ৩৪ লাখ ডলার এবং অন্যরা মিলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৩৭ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার ডলার।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সাত মাসে অর্থছাড় হয়েছে ৪২৫ কোটি ৯৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার। জানুয়ারি ’২৩ পর্যন্ত উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে জাপান। তাদের কাছ থেকে ১০৪ কোটি ৮ লাখ ৮০ হাজার ডলার পাওয়া গেছে। এরপরই সবচেয়ে বেশি অর্থছাড় করেছে বিশ^ব্যাংক (আইডিএ) ৬৯ কোটি ৫৪ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এডিবির কাছ থেকে এসেছে ৬৩ কোটি ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ডলার, চীন ছাড় করেছে ৫৬ কোটি ২৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার, রাশিয়ার কাছ থেকে ছাড় হয়েছে ৪৬ কোটি ৩৮ লাখ ৪০ হাজার ডরার, এআইআইবি দিয়েছে ৩২ কোটি ৮৮ লাখ ৩০ হাজার ডলার, ভারত দিয়েছে ১৬ কোটি ৪৫ লাখ ৬০ হাজার ডলার ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে ছাড় হয়েছে ৩৬ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার ডলার।
ইআরডির হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, গত ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় এ অর্থবছরে সাত মাসে ঋণের সুদ পরিশোধের হার বেড়েছে। এ বছর জানুয়ারি পর্যন্ত সুদসহ ঋণ পরিশোধ হয়েছে ১২৮ কোটি ৪৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার। গত বছর একই সময়ে তা ছিল ১২২ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার ডলার। যা টাকায় ১২ হাজার ৪৩৬ কোটি ২৮ লাখ। কিন্তু ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় টাকার অঙ্কে সুদসহ ঋণ পরিশোধ গত বছরের চেয়ে বেশি। টাকার অঙ্কে এ বছর ঋণ পরিশোধ হয়েছে ৮ হাজার ৮৯২ কোটি ৯২ লাখ টাকা। গত বছর একই সময় তা ছিল ৭ হাজার ৬৯৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। আর এই সময়ে সুদ পরিশোধ হয়েছে টাকায় ৩ হাজার ৫৪৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
এ দিকে চলতি অর্থবছরে প্রকল্প সহায়তা ও বাজেট সহায়তায় প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। অর্থবছরের শুরুতে বৈদেশিক ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ দশমিক ৩৮২ বিলিয়ন ডলার। পরবর্তীতে আইএমএফ সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে রাজি হওয়ায় সেখান থেকে ৪৪৮ মিলিয়ন ডলার চলতি অর্থবছরে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে মোট ঋণ পাওয়া যাবে ১২ হাজার ৮৩০ মিলিয়ন ডলার বা এক লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৬ টাকা ধরে)।
বিদেশী ঋণ পাইপলাইনে আছে ৯৭২ কোটি ডলার। এর মধ্যে আমেরিকা ও জাপান থেকেই আসার কথা রয়েছে ২৫৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। বিশ^ব্যাংকের আইডিএ কর্মসূচির আওতায় পাইপলাইনে আছে ২৩৫ কোটি ২০ লাখ ডলার, এশিয়া, জেইসি ও এফঅ্যান্ডএফ থেকে ২২৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার, এডিবিতে ১৭৭ কোটি ২০ লাখ ডলার, ইউরোপের লাইনে জমা ৫৯ কোটি ডলার এবং জাতিসঙ্ঘের ১০ কোটি ৭০ লাখ ডলার পাইপলাইনে জমা আছে।
অন্য দিকে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে বা জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র ২৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে, যা গত ১০ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই অর্থ ব্যয়কেই সরকার এডিপির বাস্তবায়ন হিসেবে দেখিয়েছে। টাকার অঙ্কে ছয় মাসে এর পরিমাণ ৬০ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা বলে তুলে ধরা হয়েছে। সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে সেতু বিভাগ। এই অর্থবছরের এডিপিতে বৈদেশিক সাহায্য ধরা হয় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। আর ৬ মাসে খরচ হয়েছে মাত্র ২৬.২৬ শতাংশ, যা ২৪ হাজার ৪২২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পর থেকে বাস্তবায়নের এত কম হার আর দেখা যায়নি। ওই অর্থবছরের ছয় মাসে বাস্তবায়নের হার ছিল ২৫ শতাংশ। এ সময়কালের মধ্যে কোভিড মহামারী শুরুর ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেও এর চেয়ে বেশি ২৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছিল।
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলামের কাছে এই কমে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, প্রতিশ্রুতি তো অর্থহীন। এই অর্থে অর্থহীন, এই টাকা ছাড় করলে আমরা তো খরচ করতে পারি না। ফলে পাইপলাইনে এত বড় টাকা জমে গেছে। তিনি বলেন, পাইপলাইনে যে পরিমাণ টাকা জমে আছে তা মনে হয় ১০ বছরের ছাড়করণের সমান। তাই আপাতত চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ নাই। আমাদের চেষ্টা করতে হবে যেসব প্রকল্প বিদেশী অর্থায়নে হচ্ছে সেগুলো যথাসময়ে সমাপ্ত করা এবং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা। তাহলেই অর্থছাড় বাড়বে। আর সেটা হলেই দাতাসংস্থা প্রয়োজন হলে তখন প্রতিশ্রুতিও বাড়াতে পারে।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের অভিমত হলো, প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিশ্রুত অনেক অর্থ সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে অর্থছাড়ের সুযোগ নেই। সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হলে পাইপলাইনের অঙ্ক বেড়ে যায়। তিনি বলেন, বাস্তবায়নে গতিশীলতা বাড়াতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা