২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আমানতকারীদের অর্থ দিতে পারছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠান

তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির শঙ্কা
-

স্বল্পমেয়াদি আমানত নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে স্বল্প সময়ের জন্য ধার নিয়ে বিনিয়োগ করছে। কিন্তু বিনিয়োগের অর্থ ফেরত আসছে না। এতে তহবিল সঙ্কটে পড়েছে বেশির ভাগ ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান। তারা মেয়াদ শেষে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। পাশাপাশি বেড়েছে ঋণঝুঁকির পরিমাণ। এ অভিযোগ করেছে খোদ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমনি পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় বলেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এমন কার্যক্রম কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। পাবলিক মানির ঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি আমানত পরিহার করে বন্ড ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সংগ্রহের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন নির্দেশনার বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বিএলএফসিএ’র চেয়ারম্যান ও আইআইডিএফসিএ এমডি মো: গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে তা সঠিক। তবে তিনি বলেন, এটি চলমান প্রক্রিয়া। প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মেয়াদে আমানত গ্রহণ করে। আবার বিনিয়োগও করে বিভিন্ন মেয়াদে। যখনই বিষয়টি অতিরঞ্জিত হয়ে যায় তখনই বিপত্তি দেখা যায়। তিনি বলেন, আগে যাদের মাঝে ঋণ বিতরণ করা হতো তারা নিয়মিত অর্থ ফেরত দিতো। কিন্তু পরপর দুই বছর করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ও পরবর্তীতে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ আদায়ের ব্যাপারে যেমন নীতিমালা শিথিল করেছিল, তেমনি ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমে গেছে। এমনি পরিস্থিতিতে ঋণের অর্থ যথাসময়ে ফেরত আসছে না। এতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমানতকারীদের অর্থ চাহিদামাত্র ফেরত দেয়া কষ্টকর হচ্ছে। কেউ বড় অঙ্কের টাকা ফেরত চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে মেটাতে না পারলেও কয়েক দফায় তা মেটানো হচ্ছে।

তবে কলমানি মার্কেট থেকে ধার নেয়া হয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আপৎকালীন সঙ্কট মেটানোর জন্য। এ অর্থ বিনিয়োগ করা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। এটা কেউ করলে চরম অন্যায় করেছে। তিনি বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে দীর্ঘমেয়াদে তহবিল সংগ্রহের দিকে নজর দিচ্ছি। আগের চেয়ে পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে বলে তিনি দাবি করেন।

এ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে অভিযোগ করা হয়েছে, বাস্তব অবস্থা তার চেয়ে অনেক খারাপ বলে জানিয়েছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। তাদের মতে, বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকদের আমানতের অর্থ যথাসময়ে ফেরত দিতে পারছে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, একটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান সঙ্কট মেটাতে তাদের আমানতের অর্থ ফেরত নেয়ার জন্য এসেছিল। কিন্তু এক মাসে তাদের অর্থ ফেরত দিতে তারা পারেননি। কয়েক দফায় ওই অর্থ ফেরত দিয়েছেন। এমনি অভিযোগ শোনা গেছে আরো কয়েকজন গ্রাহকের কাছ থেকে।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আপৎকালীন সঙ্কট মেটাতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে (কলমানি মার্কেট) থেকে ধার নেয়। এ ধারের মেয়াদ হয় এক দিন থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাত দিন। এ কারণে এ উৎস থেকে তহবিল সংগ্রহ করতে ব্যয়ও বেশি হয়। যখন বাজারে টাকার চাহিদা কম থাকে তখন কলমানি মার্কেটে সুদহার কম থাকে। আর যখন চাহিদা বেশি থাকে তখন সুদহার বেশি হয়। বছরখানেক আগেও কলমানি মার্কেটে আমানতের সুদহার ৩ শতাংশের নিচে ছিল। কিন্তু সেই কলমানি মার্কেটের গড় সুদহার বেড়ে হয়েছে ৭ শতাংশের ওপরে। আর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানভেদে এ সুদহার ৮ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ কলমানি মার্কেট থেকে ধার নিয়ে কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করছে। আবার স্বল্পমেয়াদে আমানত নিয়েও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করছে। কিন্তু ওই সব আমানতকারীরা মেয়াদ শেষে আমানতের অর্থ ফেরত পাচ্ছে না। আবার কলমানি মার্কেট থেকে তহবিল সংগ্রহ করেও অনেক প্রতিষ্ঠান ফেরত দিচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে এটা প্রত্যাশিত নয়। এটা তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে, পাশাপাশি পাবলিক মানির ঝুঁকির পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠার উদ্দেশই হলো দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সংগ্রহ করে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা। কিন্তু এ উদ্দেশ্য মানছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনি পরিস্থিতিতে বিদ্যমান তহবিল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা এড়াতে সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পাবলিক মানি ঝুঁকি হ্রাসের জন্য আন্তঃব্যাংক লেনদেন পরিহার করতে হবে। একই সাথে বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অন্যথায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।

 

 

 


আরো সংবাদ



premium cement