রিজার্ভ হ্রাস অর্থনীতির সঙ্কট বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশে

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস বাংলাদেশের অর্থনীতি সঙ্কটে পড়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেছে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি বলছে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম এবং পরিবার ও ব্যবসার জ্বালানি চাহিদা মেটানোর বিষয়ে বাংলাদেশ বেশ সঙ্কটের মধ্যে ছিল। আর এসব কারণে দেশটি জিডিপি প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ২ শতাংশের ঘরে নেমে আসবে।
গত মঙ্গলবার ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টস জানুয়ারি ২০২৩’ নামক এক বার্ষিক প্রতিবেদনে সংস্থাটি এই কথা বলেছে।

বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে গত বছরের অক্টোবরে বলা হয়েছিল, ৬ দশমিক ১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে বাংলাদেশের। উল্লেখ্য, চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু চলতি ডিসেম্বরে তা কমিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, গৃহস্থালির আয় ও সংস্থাগুলোর ব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব, সেইসাথে জ্বালানি ঘাটতি, আমদানি বিধিনিষেধ এবং মুদ্রানীতি কঠোর হওয়ার কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫.২ শতাংশে নামবে বলে আশা করা হচ্ছে। রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অনুমিত এই প্রবৃদ্ধি আগের বছরের ৭.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় কম। কিন্তু আশা করা হচ্ছে, এটি আবারো বাড়বে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ তার সম্ভাব্য গতিতে ফিরে আসবে।
অবশ্য পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির প্রভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম এবং পরিবার ও ব্যবসার জ্বালানি চাহিদা মেটানোর বিষয়ে বাংলাদেশ বেশ সঙ্কটের মধ্যে ছিল।

ওয়াশিংটনভিত্তিক এই ঋণদাতা সংস্থার মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস বাংলাদেশের অর্থনীতি সঙ্কটে পড়ার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির জেরে সরকার জ্বালানি খরচ কমাতে ব্ল্যাকআউট এবং কারখানা বন্ধ করার মতো পদক্ষেপ নিয়েছে। একই সাথে যানবাহন ক্রয় বন্ধ করে দেয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের জন্য অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে বিলাসবহুল পণ্য ক্রয় করাও কঠিন করেছে বাংলাদেশ সরকার। বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনা মহামারীর কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ। এ ছাড়া চলতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতি ‘বিপজ্জনকভাবে মন্দার কাছাকাছি’ আসবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে বিশ্বব্যাংক। মঙ্গলবার সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং চীনের দুর্বল প্রবৃদ্ধির জেরে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এ দিনই ২০২৩ সালের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস প্রায় অর্ধেক কমিয়েছে তারা। মূলত সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানোর প্রবণতা, ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন অব্যাহত ও বিশ্বের প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর নড়বড়ে অবস্থানের কারণে দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি হয়েছে।

আর এর জেরেই বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে বিশ্ব ব্যাংক। ব্যাংকটি জানিয়েছে, তারা ২০২৩ সালে বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৭ শতাংশ হবে বলে প্রত্যাশা করছে। ২০০৯ সাল ও ২০২০ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়টা বাদ দিলে গত তিন দশকের মধ্যে এটিই হবে সবচেয়ে ধীর প্রবৃদ্ধির হার। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, প্রবৃদ্ধির হার কমায় উদীয়মান অর্থনীতি ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। এসব দেশ ঋণের বোঝা মোকাবেলা করতে সমস্যায় পড়বে। এ ছাড়া দুর্বল মুদ্রা, আয়ের প্রবৃদ্ধিতে স্থবিরতা ও বাণিজ্য খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমতে থাকায় পরবর্তী দুই বছরে এই দেশগুলোতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হবে বলে ধারণা করা হয়েছে, যা গত ২ দশকের তুলনায় অর্ধেক।
বিশ্বব্যাংক উল্লেখ করেছে, ২০২২ সালের শেষের দিকে এসে জ্বালানি ও নিত্যপণ্যের অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের কারণে কিছু পরিমাণে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে এসেছে, তবে সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, সরবরাহ খাতে নতুন করে বিঘ্ন দেখা দেয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি এবং সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতির ধারা অটুট থাকতে পারে।
সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো প্রতিক্রিয়া হিসেবে পলিসি রেট বর্তমান প্রত্যাশিত হারের চেয়ে বেশি হারে বাড়াতে পারে। এসব উদ্যোগের পরিণাম হিসেবে বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে।