০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে মানুষ

কমে যাচ্ছে আমানতের প্রবৃদ্ধি
-


গত এক বছরে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে; কিন্তু বিপরীতে মানুষের আয় বাড়ছে না। মূল্যস্ফীতির হিসাবে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। আয়ের সাথে ব্যয় মেলাতে না পেরে মানুষ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। ব্যাংকে কমে যাচ্ছে আমানতের প্রবৃদ্ধি। অক্টোবর শেষে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে ৭ শতাংশে নেমে গেছে, যেখানে গত বছরের অক্টোবরে এ প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১১ শতাংশ।


বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত আগস্টে আমানতের গড় সুদহার ছিল ৪ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। আর গত অক্টোবরে তা আরো কমে নেমেছে ৪ দশমিক ১৩ শতাংশে। অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, অক্টোবরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। শুধু মূল্যস্ফীতির হিসাবে নিলে ব্যাংকে টাকা রেখে গ্রাহকের লোকসান হচ্ছে প্রতি ১০০ টাকায় প্রায় পাঁচ টাকা। অর্থাৎ ১০০ টাকা রেখে এক বছর পর প্রায় পাঁচ টাকা ক্ষয় হয়ে পাওয়া যাচ্ছে ৯৫ টাকা। এভাবেই গ্রাহকের অর্থ ব্যাংকে রেখে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। যেখানে ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার অবমূল্যায়িত হয়েছে এক বছরে প্রায় ২৮ শতাংশ, সেখানে ব্যাংকে আমানত রেখে প্রকৃত আয় না বেড়ে বরং কমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে ও আয়ের সাথে ব্যয় সমন্বয় না হওয়ায় মানুষ তাই ব্যাংকে জমানো অর্থ উত্তোলন করে নিচ্ছে।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত বছর অক্টোবরে আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল যেখানে প্রায় ১১ শতাংশ; চলতি অর্থবছরের অক্টোবরে তা কমে এসেছে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশে। চার মাসে ব্যাংকিং খাতে আমানত এসেছে যেখানে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা, যেখানে আগের বছরের একই সময়ে এসেছিল ৩৭ হাজার ১৮৭ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আমানত কমে যাওয়ার এ অস্বাভাবিকতা অর্থনীতির জন্য মোটেও সুখকর নয়। এটা থামানোর জন্য অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির সাথে সমন্বয় রেখে আমানতের সুদহার বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। একই সাথে চাহিদা কমাতে ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।


বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে; কিন্তু ব্যাংকে আমানত রেখে মুনাফা পাওয়া যাচ্ছে তার চেয়ে কম হারে। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ক্ষতি পোষাণোর জন্য আমানতের সুদহার বাড়ানো দরকার। আর আমানতের সুদহার বাড়ানো হলে ঋণের সুদহারও বাড়াতে হবে; কিন্তু ধনিক শ্রেণীরা তা করতে দিচ্ছে না। এতে ধনীরা আরো লাভবান হচ্ছে। আমানতের সুদহার বাড়ানো দরকার। আর এ জন্য ঋণের সুদহারের সর্বোচ্চ সীমাও তুলে দিতে হবে। যেখানে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে অস্বাভাবিক হারে সেখানে টাকাকে শক্তিশালী করতে সুদহারের সীমা তুলে না দিলে হিতে বিপরীতে হবে বলে তারা জানিয়েছেন। আর এ কারণেই মানুষ ব্যাংকের জমানো সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে। সঞ্চয়পত্রে আর বিনিয়োগ করছে না।


ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ব্যাংকিং খাতে কিছু কিছু ব্যাংকের টাকার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। ব্যাংকগুলো দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে পারছে না। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে প্রতিদিনই রেপো ও বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় ধার নিচ্ছে। এ সঙ্কট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হলো ব্যাংকগুলো কাক্সিক্ষত হারে আমানত পাচ্ছে না। ব্যাংকিং খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে অস্বাভাবিক হারে। আর যে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে তা আমানতের সুদহার বিবেচনায় নিলে প্রকৃত আমানতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে না। কারণ প্রতি বছর এমনিতেই ১০০ টাকা আমানতের সাথে পাঁচ টাকা সুদ যুক্ত হয়ে ১০৫ টাকা হচ্ছে। সেখানে আমানতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ৭ শতাংশ হারে। এ হিসাবে আমানতের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে মাত্র ২ শতাংশ হারে।


এ দিকে পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। মানুষ পণ্যমূল্যের জাঁতাকলে পিষ্ট। সব ক্ষেত্রেই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও আয় তেমন বাড়েনি। বরং ক্ষেত্রবিশেষ কমে গেছে। দুই বছরের করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক কর্মক্ষম শ্রমিক। যেসব কারখানা চালু আছে তারা ঠিকমতো কর্মীর বেতনভাতা দিতে পারছে না। এতে কমে গেছে মানুষের আয়। কিন্তু ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র। ৮৪ টাকার ডলার শুধু ব্যাংকের হিসাবেই ১০৮ টাকা উঠে গেছে। এ সময় টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ২৮ শতাংশ। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এর সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে লোডশেডিং। ফলে উৎপাদন ব্যয় আরো বেড়েছে। এক দিকে ব্যয় বেড়েছে, অপর দিকে মুনাফা বাড়ছে না। বাধ্য হয়ে মানুষ ব্যাংকের আমানত তুলে নিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।


ব্যাংকের আমানত কমে যাওয়ার ধারা অব্যাহত থাকলে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা আরো কমে যাবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বিনিয়োগে। এমনিতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা শিথিলতার কারণে গত দুই বছরের ব্যাংকের ঋণ আদায় বাড়েনি। এর ফলে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এর ওপর আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা আরো কমে যাবে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এমনি পরিস্থিতিতে উন্নতির জন্য আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে। আর আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে মুনাফার হার বাড়াতে হবে। আর আমানতের মুনাফা বাড়লে ঋণের মুনাফাও বাড়াতে হবে। সবমিলেই এ বিষয়টি নীতিনির্ধারকদের নজরে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা।

 


আরো সংবাদ



premium cement