০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮ মাঘ ১৪৩১, ১ শাবান ১৪৪৬
`

এক জীবনে ২৫ বার যমুনায় ভেঙেছে বাড়িঘর

ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন আব্দুল মতিনেরা
আবদুল মতিন, ২৫ বার যমুনার ভাঙনের শিকার : নয়া দিগন্ত -

সত্তর বছরের বৃদ্ধ আব্দুল মতিন খান। সিরাজগঞ্জের দুর্গম যমুনার চরে বাড়ি। এক জীবনে ২৫ বার বাড়িঘর ভাঙন দেখেছেন তিনি। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার মেছরা ইউনিয়নের খিদিরপুর গ্রামে বর্তমান বসবাস তার। জেলা সদর হলেও তার এলাকাটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। ঢাকা থেকে যমুনা নদী পার হওয়ার সময় উত্তর দিকে তাকালে দেখা যাবে যমুনার চর। যত উত্তরে যাওয়া যাবে এই চরের প্রশস্ত আরো বেড়েছে। দুই পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদী। সিরাজগঞ্জ জেলা শহর রক্ষাবাঁধ থেকে শ্যালোর নৌকায় এসব দুর্গম চরে যেতে হয়। ওপারে নেমে আবার মোটরসাইকেলে চড়তে হয়। আর মালামাল পরিবহনের জন্য বেশি ব্যবহৃত হয় ঘোড়ার গাড়ি।
মেছরা ইউনিয়নের খিদিরপুর চরে আব্দুল মতিন খানের বাড়ির আঙিনায় কথা হয় এই প্রতিবেদকের। টিএনটিতে চাকরি করতেন। ২০১৩ সালে চাকরি থেকে অবসরে গেছেন। তার বাবা সেকেন্দার আলী খানের প্রায় দুইশ’ বিঘা জমি ছিল। তারা দুই ভাই। বড় ভাই মৃত, ছিলেন অবিবাহিত। তাই যত সম্পত্তি তার সবই উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার কথা। বয়স ৭০ হলে কি হবে, মানসিক এবং গায়ে গতরে তাকে এখনো অনেক শক্তই মনে হলো। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের মূল বাড়ি ছিল মেছরা ইউনিয়নেরই মেছরা মল্লিক পাড়ায়। বাপ-দাদার প্রায় ২০০ বিঘা জমি ছিল। সেই জমিজমার প্রায় সবই গ্রাস করে নেয় সর্বনাশা যমুনা। ১৯৭২ সালের দিকে প্রথম বাড়িঘর ভাঙনের শিকার হয় আব্দুল মতিন খানের। এরপর এক দুই বছর পরপরই ভাঙতে থাকে তাদের বাড়ি। এক সময়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে আব্দুল মতিন খানের পরিবার। সত্তরের দশকেই বাবাকে হারানো আব্দুল মতিনের ছোট একটি চাকরি মেলে টিএনটিতে। এই চাকরিকে অবলম্বন করেই এগোতে থাকেন।
আব্দুল মতিন খান জানান, এই জীবনে একবার দুইবার নয়, ছোট বড় মিলে মোট ২৫ বার ভাঙনের শিকার হয়েছি। মনে আছে, প্রথমবার ভাঙনের শিকার হই ১৯৭২ সালের দিকে। এক চর থেকে আরেক চরে বাড়িঘর করে থেকেছি। সর্বশেষ ভাঙনের শিকার হয়ে গত ১৪ বছর ধরে বসবাস করছি খিদিরপুর গ্রামে। তিনি বলেন, ২০-২২ বছর আগে এখানে (বর্তমান বাড়ি) প্রবাহমান নদী ছিল। গত ১৪ বছর আগে এখানে শুধু বাড়ি করার জমিটুকু ছিল। ফসলের জমি তখনো জাগেনি। আস্তে আস্তে অন্যান্য জমিও জাগতে (চর পড়তে) থাকে। বর্তমানে খিদিপুরসহ বিভিন্ন মৌজায় আমার প্রায় ৫০ বিঘা ফসলি জমি। ভুট্টা, সরিষাসহ নানা রকম ফসল বুনেছি এসব জমিতে। এর আগে ধানসহ অন্যান্য ফসল ছিল।
আব্দুল মতিন খানের বাড়িটি ওই রকম জাকজমক না হলেও বাড়ির চার দিকে আম-কাঁঠালসহ নানা রকম ফলজ ও কাঠের বৃক্ষরাজি ছেয়ে ফেলেছে। বাড়ির সামনেই দেখা মিলল পারিবারিক সবজি বাগান। মসলাজাতীয় ফসলও দেখা গেল তার জমিতে। বিদ্যুতের খাম্বা দেখা গেল বাড়ির আঙিনায়। তবে সংযোগ দেয়া হয়নি এখনো। বাড়িতে টিভি চলে আকাশ অ্যান্টিনায়। দুই ছেলে এক মেয়ের জনক আব্দুল মতিন। বড় ছেলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। ছোট ছেলে এমবিএ শেষ করেছে। মেয়েটা এইচএসসি পাসের পর বিয়ে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বাপ দাদার সময় আমাদের তো অনেক জমি জমা ছিল। আমরা খুব সুখেই ছিলাম। নদী ভাঙার পর আমরা এমন নিঃস্ব হয়ে গেলাম যে, অনেক সময় ঘরে খাবারও থাকত না। আমরা খুব অভাবী ছিলাম। রিজিকের মালিক তো আল্লাহ। আস্তে আস্তে এখন ভালো আছি। ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করছে। আমি নিজেও ছোটখাটো সরকারি চাকরি করতাম। সব মিলে ভালো আছি।
৭০ বছরের জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বৃদ্ধ আব্দুল মতিন খানের মুখ এখন তৃপ্তির হাসি। সংসারে ফের সুখ ফিরে এসেছে। যমুনার কড়াল গ্রাসে কেড়ে নেয়া জমিগুলো আস্তে আস্তে জাগছে। চাষাবাদ করে ভালোই চলছে দিনকাল। আব্দুল মতিনের মতো হাজারো মানুষের এমন জীবনকাহিনী যমুনা পাড়ে। জমিজমা, বাড়িঘর হারিয়ে পথের ফকির অসংখ্য মানুষ। প্রতিনিয়ত এই সংখ্যা বাড়ছে। আব্দুল মতিনের মতো অনেকের আবার সুদিন ফিরে আসছে বহু বছর পর।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল