৭ বছরে মাথাপিছু বিদেশী ঋণ বেড়েছে ১১৮ শতাংশ
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০৫
বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির ফলে গত সাত বছরে মাথাপিছু বিদেশী দায় ২৫৭ ডলার থেকে ১১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৫৬১ মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আর এই সাত বছরে বিদেশী মোট দায় বেড়েছে ১৩৩ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ৪১ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে সরকারি-বেসরকারি বিদেশী ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৯৬ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এ দিকে বিদেশী দায় বৃদ্ধির সাথে সাথে এর সুদ আসল পরিশোধের চাপও বাড়ছে। বিগত অর্থবছরে এ ক্ষেত্রে দায় পরিশোধের অঙ্ক ছিল ২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ অর্থবছরে ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ইআরডি সূত্র জানিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হলে অর্থনীতির জন্য ভবিষ্যতে বিপদ বাড়তে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বিদেশী দায়দেনা পরিস্থিতির অবনতি শুধু অঙ্কেই ঘটেছে, তাই নয়; একই সাথে অর্থনীতির মৌলিক সূচকগুলোর অনুপাতেও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে বিদেশী ঋণ পরিস্থিতি। ২০১৬ অর্থবছরে মোট জিডিপির সাড়ে ১৫ শতাংশ ছিল বিদেশী ঋণ। ২০২২ অর্থবছরে এটি দাঁড়িয়েছে ২০.৬ শতাংশে। একই সময়ে জাতীয় আয়ের অনুপাতে বিদেশী দায়দেনা ১৪.৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ সময়ে বিদেশী ঋণের থেকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হারও কমে গেছে। ২০১৬ অর্থবছরে মোট দায়দেনার ৭৩.৭ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল, যা ২০২২ অর্থবছরে নেমে এসেছে ৪৩.৬ শতাংশে।
সাধারণভাবে দায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে কি না তা বিবেচনার জন্য বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের চলতি হিসাবের প্রাপ্তির সাথে বৈদেশিক দায়ের অনুপাত গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হিসেবে দেখা হয়। ২০১৬ অর্থবছরে চলতি হিসাবে প্রাপ্তির ৭৮.২ শতাংশ ছিল বিদেশী দায়, যা ২০২২ অর্থবছরে ১১৭.৯ শতাংশে উন্নীত হয়। রফতানি আয়ের বিপরীতে বিদেশী দায় পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটেছে। ২০১৬ অর্থবছরে মোট রফতানি আয়ের ১২২.৫ শতাংশ ছিল বিদেশী মোট ঋণ, যা ২০২২ অর্থবছরে ১৮৭.৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এটি অবশ্য আগের অর্থবছরে ছিল রেকর্ড ২১৩.১ শতাংশ। গত অর্থবছরে রফতানির বিপুল প্রবৃদ্ধিতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
বিদেশী দায়দেনার মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ লেনদেনের ভারসাম্যে বেশি চাপ সৃষ্টি করে। একসময় এ কারণে বাংলাদেশ স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ গ্রহণকে উৎসাহিত করত না। কিন্তু সাত বছরে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণের হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৬ অর্থবছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অনুপাতে ২৩ শতাংশ ছিল স্বল্পমেয়াদি ঋণ, যা ২০১৯ অর্থবছরে ৩৪.৪ শতাংশে উন্নীত হয়। ২০২২ অর্থবছরে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ দাঁড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ৪৯.৪ শতাংশে। একই সময়ে মোট ঋণের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ ১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে সাড়ে ২১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
বিবেচ্য সাত বছরের ব্যবধানে সরকারি খাতের ঋণের অনুপাত কিছুটা কমলেও বেসরকারি ঋণের অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। বেসরকারি ঋণ সাত বছর আগে ছিল মোট ঋণের ২১.৪ শতাংশ। এখন তা মোট ২৭.১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বেসরকারি বিদেশী ঋণে সরকারের সার্বভৌম গ্যারান্টি থাকায় ঋণগ্রহীতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে দায় শোধ করতে হবে সরকারকে। বেসরকারি খাতের ঋণ গ্রহণ সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সেপ্টেম্বর-’২১ এর ১৯.৬৮ বিলিয়ন ডলার থেকে মাত্র ৯ মাস পরে জুন-’২২-এর বেসরকারি বিদেশী ঋণের স্থিতি ২৫.৯৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
এ দিকে দেশী-বিদেশী ঋণের অব্যাহত বৃদ্ধিতে সুদ পরিশোধের চাপও বাড়ছে। ইআরডি সূত্রের তথ্য অনুসারে, বিগত অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ডলার সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছে বাংলাদেশকে, যা চলতি অর্থবছরে ২.৭৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি ৩.২৮ বিলিয়ন ডলার এবং পরের বছর ৪.০২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ৫.২৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। বিদেশী ঋণে সুদের দায় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রয়েছে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর। এ প্রসঙ্গে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ও ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি মনে করেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণ উদ্বেগজনক হতে পারে যদি ধার করা অর্থ সঠিকভাবে ব্যবহার করা না যায়।
ড. মুজেরি উল্লেখ করেন, আমাদের মতো একটি দেশে বিদেশী ঋণ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কারণ আমাদের বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের অভাব রয়েছে। আমাদের মূলধন নেই। ফলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের অবকাঠামো ব্যয়বহুল এবং আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে তাদের অর্থায়নের সুযোগ সীমিত। তাই আমাদের মতো দেশের উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক ঋণ অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। তবে যদি ধার করা অর্থ হিসাব-নিকাশ করে ব্যবহার করলে এর সুবিধা প্রকল্পের ব্যয়ের চেয়ে বেশি হবে। তার মতে, আমরা যদি ঋণ পরিশোধের সময়সূচি অনুযায়ী ঋণ পরিশোধ না করি, তা হলে এটি আমাদের ক্রেডিট রেটিংকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেছে। কিন্তু যদি ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়, অথবা আমরা যদি তাদের থেকে সুফল পেতে না পারি, তা হলে সেগুলো বোঝা হয়ে যাবে। তাই ঋণ কতটা কাজে লাগাচ্ছি তা নিয়ে ভাবতে হবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা