বিদেশী ঋণের উল্লম্ফন বেসরকারি খাতে
৫ বছরে বেড়েছে ১১১.৩২ শতাংশ- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০
বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়েই চলেছে। গত পাঁচ বছরে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিদেশী ঋণ নেয়া বেড়েছে প্রায় ১১১.৩২ শতাংশ। ২০১৭ সাল শেষে দেশে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের স্থিতি ছিল এক হাজার ২২৮ কোটি ডলার, গত জুন শেষে তা বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৫৯৬ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়েছে এক হাজার ৩৬৭ কোটি মার্কিন ডলার। এসব ঋণের মধ্যে বেশির ভাগই ৭০ শতাংশই স্বল্পমেয়াদি এবং ৩০ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে। বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়ে যাওয়ায় চাপ বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ এসব ঋণ বৈদেশিক মুদ্রায় নেয়া হয়। সুদে-আসলে বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতে হয়। এ কারণে যে খাতে ঋণ অনুমোদন করলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ে ওই খাতেই বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ অনুমোদন দিতে হবে। এটি না করলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। হংকং, কোরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ এর আগে এ কারণে সমস্যায় পড়ে গিয়েছিল। তাদের বেসরকারি খাত একসময় বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে আবাসন খাতসহ নানা স্থানীয় ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিল। কিন্তু একসময় ওই সব খাতে সমস্যা দেখা দেয়ায় বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ফেরত দিতে সমস্যায় পড়ে যায়। এর ফলে ওই সব দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যায়। বর্তমানে আমাদের দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৩৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কটের কারণে প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রতিনিয়তই রিজার্ভ থেকে সরকারি কেনাকাটায় ডলার সরবরাহ করছে। এমনি পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়ে গেলে চাপ আরো বেড়ে যাবে। এরই মধ্যে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সমন্বয় না হলে এ সঙ্কট দিন দিন আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ নেয়া নানা ধরনের ঝুঁকি থাকে। প্রথমত, যাকে বা যে শিল্প গ্রুপকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আনার অনুমোদন দেয়া হবে, ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে, সেটি আগে যাচাই করতে হবে। কী উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হবে, সেটি বৈদেশিক মুদ্রা আয়বর্ধক খাত কি না, তা আগে দেখতে হবে। যদি ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা না থাকে বা যে উদ্দেশ্যে ঋণের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে সেটি থেকে যদি বৈদেশিক মুদ্রা আয় না হয় তা হলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের সাথে বিনিময় মূল্যের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ যখন ঋণ অনুমোদন দেয়া হচ্ছে, তখন প্রতি ডলার ছিল ৭৭ টাকা। এখন প্রতি ডলার ১১০ টাকা। এর ফলে মুদ্রার বিনিময়জনিত ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। তৃতীয় ঝুঁকি হলো বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেকেই বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে প্রকৃত পণ্য না কিনে অথবা কম দামের পণ্য এনে বেশি দাম দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করে থাকে। এরকম কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে এমন ঘটনা উদঘাটন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। আবার অনেকেই বৈদেশিক মুদ্রায় যে উদ্দেশ্যে ঋণ আনে, ওই কাজে আর ব্যবহার করেন না। কেউবা স্থানীয় ঋণ পরিশোধ করেন বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় বেসরকারি খাতে ঋণ ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। এসব ঝুঁকি কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি বাড়াতে হবে। তা না হলে বৈদেশিক মুদ্রায় দায় বেড়ে যাবে। চাপ বেড়ে যাবে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালের আগে বেসরকারি খাতে ঋণ অনুমোদন দেয়া হতো খুবই সীমিত আকারে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে ঢালাওভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ অনুমোদন দেয়া শুরু হয়। বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় দায় ২০১৫ সালে বেড়ে হয় ৮০০ কোটি ডলার। এরপর প্রতি বছরই বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিদায়ী অর্থবছর থেকে বেসরকরি খাতে ঋণ বেড়ে হয়েছে দুই হাজার ৫৯৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে এক হাজার ৭৭৮ কোটি ডলারই স্বল্পমেয়াদি, যা মোট বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ। বাকি ৮১৯ কোটি মার্কিন ডলার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। স্বল্পমেয়াদি ঋণ বেশি হওয়ায় প্রত্যাহারের ঝুঁকি বেশি থাকে। এ কারণে এ ঋণের ঝুঁকিও বেশি।
উল্লেখ্য, গত জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি মিলে বিদেশী ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার; যা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল চার হাজার ৫৮১ কোটি মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ে দেশে বিদেশী ঋণ বেড়েছে ১০৬ শতাংশের বেশি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা