২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে ব্যাংক

কমে যাচ্ছে রফতানি আয়, আমদানিতে আরো কড়াকড়ি, ৫ মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত
-

ডলারের সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো এখন বিদেশী মানি এক্সচেঞ্জের কাছ থেকে বেশি দরে ডলার কিনছে। ব্যাংকভেদে প্রতি ডলারের পেছনে রেমিট্যান্স আনতে ১০৫ টাকা থেকে ১০৮ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করছে। আমদানি ব্যয় কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে। দিন দিন আরো কড়াকড়ি করছে পণ্য আমদানিতে। এখন ৩ মিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৩০ লাখ ডলারের পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে বলা হয়েছে। আগে ছিল ৫ মিলিয়ন ডলার। তবে, নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে রফতানি আয় নিয়ে। অর্থবছরের প্রথম মাসেই অর্থাৎ গত জুলাইতে রফতানি আয় আগের মাস জুনের তুলনায় সাড়ে ২৩ শতাংশ কমে গেছে। যদিও আগের বছরের জুলাইয়ের তুলনায় ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ বেড়েছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, গত জুনে রফতানি আয় হয়েছিল ৪৯১ কোটি ডলার, পরের মাস অর্থাৎ জুলাইতে তা কমে হয়েছে ৩৯৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, একদিকে ডলারের সঙ্কট, অপরদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রফতানি আদেশ কমে যাচ্ছে। একই সাথে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কটের কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। একদিকে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, অপরদিকে কমছে রফতানি আদেশ। সবমিলেই রফতানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অপরদিকে, আমদানি ব্যয় কমানোর নানামুখী পদক্ষেপ নেয়ার পরেও অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বিশেষ করে জ্বালানি তেল আমদানিতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। সবমিলেই বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ আরো বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

৫ মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত : বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। একদিকে আমদানি ব্যয় কমাতে ২৭টি পণ্যের আমদানিতে ব্যাংকঋণ তুলে দেয়া হয়েছে। এসব পণ্য আমদানিতে আমদানিকারকের শতভাগ অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অপরদিকে, আমদানিতে কিছু বিধিনিষেধ আনা হয়েছে। বড় অঙ্কের এলসি কমাতে বলা হয়, ৫ মিলিয়ন ডলারের ওপরে পণ্য আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। ওখান থেকেও আরো শক্ত অবস্থান নিয়েছে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এখন বলা হচ্ছে, ৩ মিলিয়ন ডলারের ওপরে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। একই সাথে ব্যাংক ও মানিচেঞ্জারগুলোতে অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মো: সিরাজুল ইসলাম গতকাল সাংবাদিকদের জানান, ডলার সঙ্কটের কারণে আমরা আমদানিতে বেশ কিছু শর্ত দিয়েছি। এখন ৩ মিলিয়নের (৩০ লাখ ডলার) বেশি আমদানি এলসি খোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে বলা হয়েছে। আগে যেটা ছিল ৫ মিলিয়ন। এর ফলে গত জুনের তুলনায় জুলাই মাসে আমাদের আমদানি এলসি অনেক কমেছে। তিনি বলেন, বাজারে কেউ যেন ডলার নিয়ে কারসাজি করতে না পারে সে জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজার তদারকি অব্যাহত রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, কারসাজির দায়ে ইতোমধ্যে ৫টি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। আরো ৪২টিকে শোকজ করা হয়েছে। তিনি জানান, যতদিন পর্যন্ত কারসাজি বন্ধ না হবে ততদিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাজার তদারকি অব্যাহত রাখা হবে।

বেশি দরে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করা হচ্ছে : ব্যাংকগুলোর ডলার যখন উদ্বৃত্ত ছিল তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার দরে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে ডলার কিনে নিয়েছিল। কিন্তু গত বছরের আগস্ট থেকে ব্যাংকগুলোর ডলার সঙ্কট শুরু হয়েছে। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে গত অর্থবছরে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে বাজার স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে এ সঙ্কট আরো বেড়ে যায়। ব্যাংকগুলো ডলারের অভাবে হাহাকার করতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে প্রায় প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করছে। কিন্তু শুধু জ্বালানি তেল, সার ও ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। গতকালও সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার বিক্রি করেছে।

অন্য এলসির ক্ষেত্রে ডলার সরবরাহ না করায় ব্যাংকগুলো মরিয়া হয়ে উঠেছে ডলার সংগ্রহের জন্য। এ কারণে বিদেশী রেমিট্যান্স হাউজগুলোর কাছ থেকে অনেকটা প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ডলার সংগ্রহ করছে। গতকালও ব্যাংকভেদে ১০৫ টাকা থেকে ১০৮ টাকা পর্যন্ত ডলার সংগ্রহ করেছে ব্যাংকগুলো। গতকাল মঙ্গলবার খোলাবাজারে ১০৯ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দেশে খোলাবাজারে ডলারের দাম প্রথমবারের মতো ১০০ টাকার ঘর পেরিয়ে যায় গত ১৭ মে। এরপর আবার কমে আসে। পরে গত ১৭ জুলাই ফের ১০০ টাকা অতিক্রম করে। গত সপ্তাহে নগদ ডলার ১১২ টাকায় উঠেছিল।

রফতানি আয় কমছে : এই মুহূর্তে অর্থনীতির জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো অর্থবছরের প্রথম মাসেই রফতানি আয়ে হোঁচট খাওয়া। গত জুনের তুলনায় গত মাসে (জুলাইতে) রফতানি আয় কমে গেছে সাড়ে ২৩ শতাংশ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী গত জুনে রফতানি আয় হয়েছিল ৪৯১ কোটি ডলার। জুলাইয়ে হয়েছে ৩৯৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। এক মাসের ব্যবধানে রফতানি আয় কমেছে সাড়ে ২৩ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরের জুলাইয়ের তুলনায় রফতানি আয় বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। একই সাথে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি আয় ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি এসেছে। এ দিকে রফতানি আয় কমায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় আগামীতে চাপ আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রফতানি। এটি কমে গেলে ডলারের প্রবাহও কমে যাবে। তখন চাপও বাড়বে। এতে মুদ্রা বাজারে আরো অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে গত মে মাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে রফতানি কমার কারণে মুদ্রা বাজারে অস্থিরতা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চলতি বছরের জুলাইয়ে রফতানি আয় কমবে এটা আগে থেকেই আঁচ করা গিয়েছিল। কেননা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বের অনেক দেশে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়।

মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যায়। যে কারণে অনেক দেশ সুদের হার বাড়িয়ে সঙ্কোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশে রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসছে ইউরোপ, কানাডা ও আমেরিকার দেশগুলো থেকে। ওই সব দেশে মন্দা থাকায় রফতানি আয়ও কমছে। যার প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে চাপ বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, রেমিট্যান্স প্রবাহ আবার বাড়তে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ায় ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকিং চানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে গত মাসে। জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ২০৯ কোটি ডলার। যা গত ১৪ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।

 


আরো সংবাদ



premium cement