৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭ মাঘ ১৪৩১, ১৮ রজব ১৪৪৫
`

খাবারে ট্রান্সফ্যাট বেশি হলে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও বেশি

-

খাবারে ট্রান্সফ্যাট বেশি হলে হার্ট অ্যাটাকসহ অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকিও বেশি। খাবারে অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাট (ট্রান্স ফ্যাটি এসিড) থাকায় বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৮ হাজার মানুষ বিভিন্ন ধরনের হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। কমদামের ভেজিটেবল ওয়েলে (উদ্ভিজ্জ তেল) বিশেষ উপায়ে নির্দিষ্ট মাত্রায় হাইড্রোজেন চালানো হলে তেল কঠিন আকার ধারণ করে থাকে। নানা ধরনের ফ্লেভার দিয়ে এটাকে সুস্বাদু করা হয়, এটাই ট্রান্সফ্যাট। ট্রান্সফ্যাট যুক্ত তেলে বেশি পরিমাণে ক্ষতিকর চর্বি থাকে। এটি আর্টারিতে (রক্তনালী) বসে গিয়ে নালীকে কঠিন ও সঙ্কীর্ণ করে তোলে। এ ছাড়া ট্রান্সফ্যাটে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে, উচ্চরক্তচাপ হয়ে থাকে। এই ট্রান্সফ্যাট শরীরে থাকা এইচডিএল নামক ভালো কোলেস্টেরলকে কমিয়ে দেয়।
প্রাকৃতিক ট্রান্সফ্যাট (আরটিএফএ) দুধ, মাখন, ঘি, গরুর গোশত, ছাগলের গোশতের মতো প্রাণিজ উৎস থেকে আসে এবং এসব সুস্বাদু খাবার একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত ক্ষতিকর নয়। কিন্তু শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদিত ট্রান্সফ্যাট (আইটিএফএ) উদ্ভিজ্জ তেলের হাইড্রোজেনেশনের সমন্বয়ে গঠিত হয়।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব:) আব্দুল মালিক ট্রান্সফ্যাট সম্বন্ধে বলেন, ‘খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাটের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারের কারণে হাজারো প্রাণ হুমকির মুখে পড়েছে। এর ঝুঁকি মোকাবেলায় জনগণকে সচেতন করতে হবে। খাবারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মোট ফ্যাটের সর্বোচ্চ ২ শতাংশ ট্রান্সফ্যাট সীমা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে তা না হলে, দিন দিন মৃত্যুঝুঁকি আরো বাড়বে।’ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য রক্ষায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে আমাদের দৈনন্দিন খাবারগুলো থেকে শিল্পজাত ট্রান্সফ্যাট নির্মূলের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আমাদের দেশে বেশি মাত্রায় ট্রান্সফ্যাট ব্যবহার হচ্ছে কিন্তু এগুলো নিয়ে খুব বেশি আলোচনা নেই। সরকারি পর্যায় থেকে খুব বেশি নজরদারিও নেই।
এ দেশের কোনো কোনো খাবারে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি এবং তা ২ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে।’ ডোবানো তেলে ভাজা খাবার, যেমন : শিঙ্গাড়া, পুরি, বিস্কুট, চানাচুর, চিপসের মতো বেকারি পণ্য তৈরিতে আংশিকভাবে হাইড্রোজেনেটেড তেল ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া রেস্টুরেন্টের খাবার ও অনেক ফাস্টফুডের কড়া ভাজার কারণে ওই খাবারের তেল ট্রান্সফ্যাট হয়ে রূপান্তর হয়ে যায়। অন্য দিকে রান্নার কাজে একই তেল বারবার ব্যবহার করলেও তাতে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়ে থাকে।
ট্রান্সফ্যাট হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। হৃদরোগ বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর সবচেয়ে বড় কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে উচ্চ ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার গ্রহণের কারণে প্রায় আট হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ডব্লিউএইচওর প্রতিবেদনে বলা হয়, খাবারে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করছে না। অপর দিকে ভারত ২০২২ সালের মধ্যে ভোজ্যতেল ও এ জাতীয় পণ্যে ট্রান্সফ্যাটের সীমা ৫ শতাংশ থেকে ২ শতাংশে নামিয়ে আনতে কাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রান্সফ্যাটের সহজলভ্য কিছু বিকল্প রয়েছে যা খাবারে ব্যবহার করা যায়, সেগুলো স্বাস্থ্যকরও। বিশ্বের ছয়টি দেশে ২০১৮ সালে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাট নিষিদ্ধ করেছে এবং আরো ২৫টি দেশ একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরবর্তী দুই বছরে তা কার্যকর হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে ঢাকায় ব্যবহৃত পারশিয়াল হাইড্রোজিনেটেড ওয়েলে (পিএইচও) ১০ গুণ বেশি ট্রান্সফ্যাট রয়েছে। পিএইচও বাংলাদেশে ডালডা বা বনস্পতি ঘি হিসেবে সমধিক পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত ভোজ্যতেল কারখানার মধ্যে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করে ঘন করা হয় এবং এটাকে ঘি হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয়। কথিত এই ঘির মধ্যে দুধের কিছু নেই। প্রকৃতপক্ষে ঢাকার বাজারে প্রাপ্ত প্রতি ১০০ গ্রাম পিএইচওতে ট্রান্সফ্যাট রয়েছে ২০.৯ গ্রাম পর্যন্ত। এটা মানবস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ঢাকার শীর্ষ কোম্পানিগুলোর পারশিয়াল হাইড্রোজিনেটেড ওয়েলের (পিএইচও) নমুনা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা এসব তথ্য উপস্থাপন করেন।
বাংলাদেশে পিএইচও বা ডালডা সাধারণত ভাজা পোড়া স্ন্যাক্স ও বেকারিপণ্য তৈরি এবং হোটেল-রেস্তোরাঁ ও সড়কসংলগ্ন দোকানের খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের খাবারে ক্ষতিকর ট্রান্সফ্যাট উপাদানের উপস্থিতি সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য-উপাত্ত না থাকার কারণেই এই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন ও গবেষণা উপদেষ্টা আবু আহাম্মদ শামীমের সহায়তায় এই গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (হার্ট ফাউন্ডেশন) গবেষকরা। গবেষকেরা বলছেন, ঢাকার পিএইচও নমুনার ৯২ শতাংশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সুপারিশকৃত মাত্রা ২ শতাংশের চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। বাসা অথবা বাড়িতে ব্যবহার না হলেও পিএইচও বেকারি ও বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা খাবারে ব্যবহৃত হয়। পিএইচও উৎপাদনকারী কারখানা থেকে ব্র্যান্ডগুলোর মোট ২৪টি নমুনা সংগ্রহ করে পর্তুগালের ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট ফুড কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির সহায়তায় সেগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন গ্যাস ক্রোমাটোগ্রাফি ব্যবহার করে ট্রান্সফ্যাটি এসিডের মাত্রা নির্ণয় করা হয়।
গবেষকরা জানান, পিএইচও বিশ্লেষণ করে প্রতি ১০০ গ্রাম নমুনায় গড়ে ১১ গ্রাম ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। এ ছাড়া, একই ব্র্যান্ডের পিএইচও নমুনার মধ্যে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতির ব্যাপক তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। যেমন, একটি পিএইচও ব্র্যান্ডের ৭টি নমুনায় ০.৬৯ গ্রাম থেকে শুরু করে ১৪.৫ গ্রাম পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে।
গবেষকদলের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা: সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, এই গবেষণা প্রমাণ করে বাংলাদেশে অনেক পণ্যেই বিপজ্জনক মাত্রায় ট্রান্সফ্যাট রয়েছে। এই ট্রান্সফ্যাট অধিক হারে ব্যবহার হলে হৃদরোগ ও হৃদরোগজনিত মৃত্যুঝুঁকি তৈরি করছে।
জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারের উচিত হবে সব ধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাবারে ট্রান্সফ্যাটি এসিডের সর্বোচ্চ পরিমাণ মোট ফ্যাট বা তেলের ২ শতাংশ পর্যন্ত সীমিত করে নীতিমালা প্রণয়ন করা।
অধ্যাপক নাজমা শাহীন বলেন, ‘বাংলাদেশে বিরাজমান হৃদরোগজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে অতিদ্রুত ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা জরুরি ভিত্তিতে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা উচিত এবং সব ধরনের ফ্যাট, তেল এবং খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ সীমাও মোট ফ্যাটের ২ শতাংশ নির্ধারণ এবং তা কার্যকর করা উচিত হৃদরোগ থেকে বেঁচে থাকার জন্য।

 


আরো সংবাদ



premium cement