২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

৮ বছরে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি

-

মূল্যস্ফীতির ‘পাগলা ঘোড়া’কে কোনোভাবে সামলানো যাচ্ছে না। বিগত আট বছরের মধ্যে গেল মে মাসে দেশে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি রেকর্ড করা হয়েছে। অন্য দিকে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হার আরো বেশি। বিগত ১২ বছরের তুলনায় মে মাসে এই হার ছিল সর্বোচ্চ। শহরের চেয়ে গ্রামে খাবারের দাম বেশি। গ্রামে মে মাসে খাদ্যমূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
মে মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী গত ৮ বছরের মধ্যে দেশে এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির রেকর্ড। এর আগে ২০১৪ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ। গতকাল বিবিএস এ তথ্য প্রকাশ করেছে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ আর খাদ্য বহির্ভূত খাতে ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে খাদ্য খাতে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, তবে খাদ্য বহির্ভূত খাতে কমেছে।
গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ১৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ ছিল। এপ্রিলে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ আর খাদ্য বহির্ভূত খাতে ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। উল্লেখ্য, গত ৯ জুন বাজেট বক্তৃতায় আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতিকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশের ঘরে ‘বেঁধে’ রাখার কথা বলেছেন।
এ দিকে দেশের মূল্যস্ফীতি আরো বেশি হবে বলে মনে করেন দেশের অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো। যেমন গত ৩ মার্চ ‘সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং’ (সানেম) কর্তৃক প্রণীত ‘বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতির সরকারি পরিসংখ্যান কি বাংলাদেশের প্রান্তিক পরিবারগুলোর প্রকৃত মুদ্রাস্ফীতির প্রতিফলন করে’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদন বলা হয়, মূল্যস্ফীতি সরকারি তথ্যের দ্বিগুণেরও বেশি।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, পণ্যমূল্য নিয়ে সরকারি সংস্থা বিবিএস যে তথ্য দিচ্ছে তা, বাস্তবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এ ক্ষেত্রে যদি সঠিক তথ্য তুলে আনা না হয়, তবে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া টেকসই হবে না। বিবিএস পুরনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, যা বর্তমান সময়ের সাথে সামঞ্জস্য নয়। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই চাপে আছে। ভাত না খেয়ে অন্যকিছু খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করছে অনেক মানুষ।
সানেমের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘শহর ও গ্রামাঞ্চলের নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র সিপিআইয়ের সরকারি হিসাবে প্রতিফলিত হয় না। সিপিআই গণনা করার জন্য বিবিএস যে ভোগ্যপণ্যের তালিকা ব্যবহার করে, তাতে নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর ভোগ বা ব্যয়ের প্রকৃত চিত্র আড়ালে থেকে যায়। অতএব, মূল্যস্ফীতির ফলে প্রান্তিক দরিদ্র পরিবারগুলো যে চাপের মুখে পড়ে, তা সরকারি পরিসংখ্যানে প্রতিফলিত হয় না।
একই কথা বলেছেন গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গত ১৬ মে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত ‘বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, জাতীয় বাজেট ও অসুবিধাগ্রস্ত মানুষের প্রত্যাশা’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসাব বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত নয়। বাজারের যে অবস্থা তাতে মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের হিসাবের সাথে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক। বিবিএস ২০০৫-২০০৬ সালের ভোক্তাদের মাথায় রেখে মূল্যস্ফীতি ঠিক করে। ১৭ বছর পরে সেই মানুষদের পরিবর্তনকে তারা ধরছে না। গ্রামে মূল্যস্ফীতি শহরের চেয়ে বেশি।
গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের কাছাকাছি : শহরের চেয়ে গ্রামে খাবারের দাম বেশি। মে মাসে গ্রামে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশে উঠেছে। বিবিএসের তথ্যে দেখা যায়, মে মাসে বাংলাদেশে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, তার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ।
আগের মাস এপ্রিলে ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মে মাসে মার্চের চেয়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে।
মে মাসে গত কয়েক মাসের মতো শহরের চেয়ে গ্রামে মূল্যস্ফীতি বেশি হয়েছে; এই মাসে গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ৮ শতাংশ, ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এপ্রিলে ছিল ৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। মে মাসে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এপ্রিলে এই হার ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
মে মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৬ দশমিক ২৬ শতাংশ।
আগের মাস এপ্রিলে গ্রামে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ।
মে মাসে শহর এলাকায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আগের মাস এপ্রিলে শহর এলাকায় খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ। ওই বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ।
২০১২-১৩ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশে নেমে আসে। ওই বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয় ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ।


আরো সংবাদ



premium cement