মারিউপোলের পর দোনেতস্ক দখলে মরিয়া রাশিয়া
পুতিনের জয়ের দাবিকে ক্ষণস্থায়ী বলছেন জেলেনস্কি; নতুন পরিকল্পনার জন্য জার্মানিতে যাচ্ছেন মার্কিন সেনাপ্রধান- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২৩ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
গত দুই মাস ধরে চলমান যুদ্ধে সব থেকে বড় সফলতা পেয়েছে রাশিয়া। দীর্ঘ দিন অবরুদ্ধ করে রাখার পর সপ্তাহব্যাপী কঠিন যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অবশেষে ইউক্রেনের শহর মারিউপোল দখলে নিয়েছে রুশ সেনারা। যদিও আজভস্টাল স্টিল কারখানায় লুকিয়ে থাকা ইউক্রেনীয় সেনারা এখনো আত্মসমর্পণ করেনি। তবে তাদের নিয়ে আপাতত ভাবছেন না রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। মারিউপোলের পর এখন দ্রুততার সাথে গোটা দনবাস অঞ্চল কবজার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ খবর দিয়েছে ডয়চে ভেলে ও বিবিসি।
মারিউপোল দখলে নেয়ার কথা অবশ্য আগেই জানিয়েছিল রাশিয়া। এবার জানা গেল, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেতস্ক অঞ্চলের ৪২টি গ্রামও দখল করে নিয়েছে রুশ সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার বিকেলে রাশিয়া দাবি করে, মারিউপোল এখন সম্পূর্ণ তাদের দখলে। যদিও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন, মারিউপোল রাশিয়া দখল করে নিয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ সত্য নয়। এখনো সেখানে লড়াই চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনও জানিয়েছে, রাশিয়ার দাবি এখনো পর্যন্ত খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। তবে একটি উপগ্রহ চিত্রে মারিউপোলে আরো একটি গণকবরের চিহ্ন পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে নতুন তৈরি কয়েক হাজার মানুষের কবরের চিহ্ন মিলেছে বলে তারা জানিয়েছে। এ দিকে মস্কোর দাবি- মারিউপোল দখলে নেয়ার পর রাশিয়ার সেনারা পরবর্তী লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মারিউপোলের ইউক্রেনীয় প্রশাসনের দাবি, সেখান থেকে বেসামরিক মানুষের লাশ সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে রাশিয়ার সৈন্যরা। বহু বেসামরিক মানুষের লাশ ইতোমধ্যেই সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে।
ইউক্রেনের সেনাপ্রধানের গুরুত্বপূর্ণ সহকারী শুক্রবার জানিয়েছেন, দনবাস অঞ্চলের দোনেতস্কের ৪২টি গ্রাম রাশিয়ার হাতে চলে গেছে। দেশের জাতীয় টেলিভিশনে তিনি এ কথা বলেছেন। একই সাথে তার দাবি, ইউক্রেনের সেনারা তা পুনর্দখলের জন্য মরিয়া লড়াই চালাচ্ছে।
এ দিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়া যে সামরিক জয় পেয়েছে তা ক্ষণস্থায়ী। ইউক্রেনের সেনারা রুশ সেনাদের সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেবে। জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে এ কথা বলেন তিনি। তিনি আরো বলেন, দক্ষিণ ও পূর্বে আগ্রাসী শক্তি জয়ের জন্য যা যা করা দরকার করে যাচ্ছে, কারণ তাদের আলোচনা করার জন্য কিছু প্রয়োজন। কিন্তু কোনো কিছুই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে সাহায্য করবে না। তারা শুধু যুদ্ধে তাদের পরাজয়কে কিছুদিন পিছিয়ে দিতে পারবে।
অন্য দিকে বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে নতুন পদক্ষেপের পরিকল্পনার জন্য জার্মানিতে যাওয়ার কথা রয়েছে মার্কিন সেনাপ্রধানের। সেখানে ইউরোপসহ একাধিক দেশের সামরিক প্রতিনিধিদের সাথে তার বৈঠক করার কথা রয়েছে। ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে একটি সামরিক ঘাঁটিতে এই বৈঠক হওয়ার কথা। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, এই মুহূর্তে ইউক্রেনের পরিস্থিতি কী তা খতিয়ে দেখে তাদের আর কিভাবে সাহায্য করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা হবে।
দনবাসে রুশরা সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র এবং বোমা হামলা চালাচ্ছে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা দফতর জানিয়েছে, দনবাস অঞ্চলের ক্রামাটোরস্ক শহরে রাশিয়া ক্রমাগত রকেট হামলা চালাচ্ছে। আরো উত্তরে খারকিভের মেয়র জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টা ধরে সেখানে গোলাবর্ষণ চলছে। তিনি শহরের বাসিন্দাদের তাদের আশ্রয় কেন্দ্রের ভেতরেই থাকতে বলেছেন, কারণ দক্ষিণ-পূর্বের ইজিয়ুমে লড়াই চলছে।
তিনি বলছেন, শহরে এখনো দশ লাখ মানুষ রয়ে গেছে। তবে ৩০ শতাংশের মতো বাসিন্দাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, যাদের বেশির ভাগই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। সমর বিশেষজ্ঞ জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারন্স বলছেন, দনবাস অঞ্চলের উত্তর-পূর্ব দিকের লড়াইটা রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে তারা ইউক্রেনিয়ান বাহিনীকে ঘিরে ফেলতে চাইছে। যদি তারা একটা করতে পারে, সেটা হবে তাদের জন্য একটা বড় সাফল্য। যদিও রাশিয়া অবশ্য তাদের হামলা বৃদ্ধি নিয়ে এখনো কোনো বিবৃতি দেয়নি।
যুদ্ধের প্রথম থেকেই দেশটির অন্যতম প্রধান টার্গেট ছিল মারিউপোল দখল। কিয়েভ দখলে ব্যর্থ হওয়ার পর রাশিয়ার সব দৃষ্টি গিয়ে পড়ে মারিউপোলের ওপরে। শহরটিতে প্রবেশের পরেও বিভিন্ন স্থানে টানা যুদ্ধ চলে কয়েক সপ্তাহ। অবশেষে আজভস্টাল স্টিল প্ল্যান্ট বাদে গোটা মারিউপোল এখন রাশিয়ার দখলে। ওই প্ল্যান্টে এখনো প্রায় ২ হাজার ইউক্রেনীয় সেনা লুকিয়ে আছে বলে পুতিনকে জানিয়েছেন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সইগু। তবে প্ল্যান্টের মধ্যে অভিযান পরিচালনা করতে সেনাদের নিষেধ করেছেন পুতিন।
আজভস্টাল শিল্প এলাকা বিশাল বড় একটা এলাকা। এই শিল্পাঞ্চলে মাটির নিচে আছে বহু টানেল ও ওয়ার্কশপ। সেখানে মাটির নিচে আছে যেন আরেকটি নগরী। ইউক্রেনীয়রা রুশদের বিরুদ্ধে যে ধরনের প্রতিরোধ যুদ্ধে লিপ্ত, সে ধরনের যুদ্ধ চালানোর জন্য এটা আদর্শ জায়গা। তাই রুশরা যদি এই অঞ্চলটি দখল করার জন্য একটি পূর্ণ অভিযান চালায়, তাদের জন্য কাজটা সহজ হবে না। সেজন্যেই প্রেসিডেন্ট পুতিন, এখন এটি দখলের অভিযান চালানোর পরিবর্তে সেটি অবরোধের নির্দেশ দিয়েছেন বলে মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।
ইউক্রেনের ক্ষতি ৬ হাজার কোটি ডলার : প্রায় দুই মাস ধরে ইউক্রেনে অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। রুশ সামরিক বাহিনীর এই আগ্রাসনে ভবন ও অবকাঠামোগতভাবে ইউক্রেনের ক্ষতি মোটামুটিভাবে ছয় হাজার কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস। এ ছাড়া যুদ্ধ চলতে থাকলে এই ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে বলেও জানিয়েছেন তিনি। ডেভিড ম্যালপাসের ভাষায়, ‘যুদ্ধ এখনো চলছে এবং অবশ্যই ক্ষতির পরিমাণও আরো বাড়বে।’
শুক্রবার এই তথ্য জানিয়েছে রয়টার্স। এ দিকে বিশ্বব্যাংকের একটি ফোরামে দেয়া ভার্চুয়াল বক্তৃতায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, রাশিয়ার আক্রমণের ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রতি মাসে ইউক্রেনের ৭০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন। দোভাষীর মাধ্যমে দেয়া ওই বক্তব্যে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট বলেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের অবিলম্বে রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বাদ দেয়া প্রয়োজন। একইসাথে মস্কোর সাথে অবিলম্বে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য সব দেশের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের এই বৈঠকের সাইডলাইনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেনসহ বেশ কয়েকটি দেশের অর্থ কর্মকর্তারা যুক্ত ছিলেন। পরে এক সংবাদ সম্মেলনে ইয়েলেন বলেন, রুশ আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ইউক্রেনের পুনর্র্নির্মাণের কিছু খরচ রাশিয়াকে বহন করা উচিত।
এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাতে জব্দ রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থও ইউক্রেন পুনর্গঠনের কাজে লাগাতে আগ্রহী মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন। অন্য দিকে সম্মেলনে ব্যক্তিগতভাবে যোগ দেয়া ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ডেনিস শ্যামিহাল বলেছেন, ইউক্রেনের জিডিপি ৩০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। এ ছাড়া রুশ আগ্রাসনের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইউক্রেনের মোট ৫৬ হাজার কোটি মার্কিন ডলার লোকসান হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, রুশ আগ্রাসনের কারণে ডেনিস শ্যামিহাল যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলে ধরেছেন তা ইউক্রেনের অর্থনীতির আকারের তিনগুণ বেশি। ২০২০ সালে ইউক্রেনের অর্থনীতির আকার ছিল ১৫ হাজার ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা