৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১, ২৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে নতুন গরিব সোয়া ৩ কোটি

জনসংখ্যার ১৯.৫৪ শতাংশ নতুন করে গরিব; বেকারত্ব ৩% থেকে বেড়ে ১৪%; বস্তিতে দরিদ্রের হার উদ্বেগজনক; পিপিআরসি বিআইজিডির সমীক্ষা
-

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে গরিব হয়েছে। এই সংখ্যা জনসংখ্যার ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। শুধু তাই নয়, বিগত লকডাউনে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ সময়ে মানুষের আয় কমেছে, চাকরি হারিয়েছেন অনেকে। এই চিত্র উঠে এসেছে সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায়। বেকারত্বের হার মার্চের ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে আগস্টে ১৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রথম লকডাউনে ৪৫ শতাংশ পরিবার সামান্য ত্রাণ পেলেও দ্বিতীয় লকডাউনে সেটি নেমে এসেছে ২৩ শতাংশে। ব্যয়বহুল শহরের ব্যয়নির্বাহ করতে না পেরে গ্রামে কিংবা তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল শহরে চলে যাওয়া ১০ শতাংশ বস্তিবাসী এখনো ফিরে আসেনি। দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে বর্তমানে শহরের বস্তির ৭৭ শতাংশ পরিবার গরিব, যা উদ্বেগজনক।
দ্য পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) সমীক্ষাটি পরিচালনা করে। গতকাল বৃহস্পতিবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে সমীক্ষার ফল তুলে ধরা হয়। আর্থিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর করোনার প্রভাব জানতে এ সমীক্ষার চতুর্থ ধাপটি গত আগস্টে পরিচালিত হয়। চলতি বছরের আগস্টে শহুরে বস্তি এবং গ্রাম মিলিয়ে ৪,৮৭২ পরিবারের উপর করা সমীক্ষায় দেখা গেছে, সর্বশেষ লকডাউনের ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার হার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর আগের ধাপের সমীক্ষাগুলো ২০২০ সালের এপ্রিল, জুন এবং চলতি বছরের মার্চ মাসে করা হয়েছিল। সংবাদ সম্মেলনে সমীক্ষার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন, বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ইমরান মতিন।
সংবাদ সম্মেলনে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘২০২০ সালের জুনে নতুন দারিদ্র্যের হার অনুমান করা হয়েছিল ২১ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০২১ সালের মার্চে এটি কমে ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ হয়। গত এপ্রিলে শুরু হওয়া করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় এ হার আগস্টে বেড়ে হয়েছে ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ।
তিনি বলেন, ‘করোনা সঙ্কটের কারণে প্রাথমিক অবস্থায় আয় কমে গেলেও, সে ধকল সামলে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। এ ইতিবাচক ধারা দেখে অনেকে নতুন দারিদ্র্যের বিষয়টিকে ক্ষণস্থায়ী সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। তবে সঙ্কটের ১৮ মাস যাওয়ার পর করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানার পর আবারও সে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিপরীত দিকে ঘুরে যায় এবং নতুন দারিদ্র্যের সমস্যা আরো বেড়ে যায়। ২০২১ সালের এপ্রিলে দ্বিতীয়বারের মতো লকডাউন দেয়ার ফলে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সমীক্ষায় জানা গেছে, আয় পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিপরীত দিকে হাঁটছে এবং মহামারী আঘাত হানার ১৮ মাস পর সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী দরিদ্রদের মধ্যে ২৩ শতাংশের গড় আয় করোনা পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে কমে গেছে। একদিন পর পর এক বেলা খাওয়া বাদ দিয়েছে এরকম পরিবারের সংখ্যা ২০২১ সালের মার্চে ২ শতাংশ ছিল, যা আগস্টে বেড়ে ৭ শতাংশ হয়েছে।
সমীক্ষায় বলা হয়, ২০২০ সালের এপ্রিলে দেয়া প্রথম লকডাউনের ধাক্কা ধীরগতিতে হলেও সামলে উঠছিল শহরের বস্তি এবং গ্রামবাসী।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চের তুলনায় শহরের বস্তি এবং গ্রামবাসীর আয় ১৮ এবং ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে, যা পুনরুদ্ধারের ধারার বিপরীত। অধিকাংশের মতে সর্বশেষ লকডাউনের সিদ্ধান্ত ভালো হলেও জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকই জানিয়েছেন তাদের জীবিকার সঙ্কটের কথা। স্বল্পশিক্ষিত ও দরিদ্রদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জানিয়েছেন, তারা প্রত্যাশিত কাজ পাননি। প্রথম লকডাউনে ৪৫ শতাংশ পরিবার সামান্য ত্রাণ পেলেও দ্বিতীয় লকডাউনে সেটি নেমে এসেছে ২৩ শতাংশে।
ফলে জীবিকার যে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান ছিল, তা কিছুটা ঘুরে গেছে এবং আগস্টে মানুষের আয় করোনার আগের তুলনায় ২৩% কমেছে।
এই আয় কমার হারটা শহুরে বস্তির তুলনায় গ্রামে কিছুটা কম ছিলÑ কোভিড-পূর্ব সময়ের তুলনায় তা গ্রামে ১২% কম এবং শহুরে বস্তিতে ৩০% কম। মহামারীর পূর্বে কাজে নিয়োজিত ছিলেন এমন ১০ শতাংশ মানুষ এখনো কোনো কাজ পাননি।
কাজ এবং আয়ের অনিশ্চয়তায় গত ১৮ মাসে মানুষের জীবনযাপনের ঝুঁকি বেড়েছে। জীবনযাপনের জন্য অনেকেই পেশা পরিবর্তনের মাধ্যমে আয়ের চেষ্টা চালিয়েছে। এমন কি তারা তাদের দক্ষতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন কাজেও নিয়োজিত হয়। যেমন ১৭ শতাংশ দক্ষ কর্মী উদাহরণস্বরূপ, ইলেকট্রিশিয়ানÑ তারা দিনমজুরের মতো অদক্ষ কর্মী হিসেবেও কাজ করছেন। মহামারীতে পরিবারগুলোর ঋণের পরিমাণও বেড়েছে ধারাবাহিকভাবে।
মহামারীর পূর্বে অর্থাৎ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঋণের পরিমাণ তাদের বাৎসরিক আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ থাকলেও চলতি বছরের আগস্টে এই হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। অনেক পরিবারে গোশত, দুধ, কিংবা ফল খাদ্য তালিকায় থাকছে না এবং তাদের মাথাপিছু খাদ্য ব্যয় মহামারীর আগের তুলনায় এখনো কম। ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বিশেষত শিশুদের ওপর এমন অবস্থা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী পরিবারগুলোর দারিদ্র্যের হার মহামারী পূর্ববর্তী সময়ের চেয়ে ১৭% পয়েন্ট উপরে অবস্থান করছে এবং শহুরে বস্তিতে এই হার ২২ শতাংশ। দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে বর্তমানে শহরের বস্তির ৭৭ শতাংশ পরিবার দরিদ্র, যা উদ্বেগজনক।
সমীক্ষায় বলা হয়, গ্রামের এবং শহুরে বস্তির যেসব ঝুঁকিপূর্ণ পরিবার গড়ে কম আয় করলেও দারিদ্র্যসীমার উপরে ছিল, তারা লকডাউনে সবচেয়ে বেশি তিগ্রস্ত হয়েছে। এমন পরিবারের দুই-তৃতীয়াংশই আগস্টে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। এদেরকে দেশের ‘নতুন দরিদ্র’ জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আগস্টে সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী, বর্তমানে জনসংখ্যার ১৯.৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী ‘নতুন দরিদ্র’, যা ২০২১ সালের মার্চে অনুমিত ধারণার চেয়ে ৫% পয়েন্ট বেশি।
সমীক্ষায় আরো কিছু তথ্য উঠে এসেছে। অনেক ‘নতুন দরিদ্র’ পরিবার দীর্ঘমেয়াদি দারিদ্র্যে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মহামারী আসার পর দারিদ্র্য সীমার উপরে অবস্থানরত অন্তত ২৯ শতাংশ পরিবার দরিদ্র হয়ে পড়ে। সেই থেকে তারা নিজেদের অবস্থান এখনো উন্নত করতে পারেনি। দীর্ঘমেয়াদি এই দারিদ্র্যের কারণে পরিবারগুলোর স্বাভাবিক জীবিকা ব্যাহত হতে পারে এবং তারা দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে পড়তে পারে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘নতুনভাবে করোনা সংক্রমণের ঢেউ আসার হুমকি এখনো বিদ্যমান। স্বাস্থ্যসেবা, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক নীতিমালার সমন্বয়ে একটি সার্বিক পদক্ষেপ না নেয়া হলে কিছুতেই এ ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। কোভিডে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে সামাজিক ন্যায়বিচার একটি মৌলিক প্রশ্ন। কোনো ধরনের নীতি তৈরি না করে বা সামান্য কিছু সাহায্য করেই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষকে এ অবস্থায় রাখা যাবে না।

v


আরো সংবাদ



premium cement