০৬ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

প্রধান সড়ক ফাঁকা : নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না পাড়া-মহল্লা

রাজধানীতে তৃতীয় দিনে গ্রেফতার ৬২১ জন; অভিযান চালাবে র্যাব
-

রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে যানবাহন ও মানুষের উপস্থিতি তুলনামূলক কম থাকলেও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে পাড়া-মহল্লার অলিগলি। কারণে-অকারণে এসব জায়গায় জটলা লেগেই থাকছে। কোনো কোনো স্থানে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি জনসমাগম হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। লকডাউনের কারণে অফিস বন্ধ থাকায় কর্মজীবীদের বাসায় থাকার কথা; কিন্তু ছুটি পেয়ে এসব কর্মজীবীর বেশির ভাগই বাসার বাইরে অলিগলিতে সময় পার করছেন। বাজার, চা-সিগারেটের অজুহাতে অনেকটা সময় থাকছেন পাড়ার দোকানে। আবার অলিগলিতে আগের মতোই সিগারেটের আড্ডা জমাচ্ছে উঠতি বয়সীরাও। প্রধান সড়কে খুব বেশি বের না হলেও মটরসাইকেল নিয়ে মহল্লার রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। মাঝে মধ্যে পুলিশের গাড়ি দেখলে কেউ দৌড়ে সরে যাচ্ছে। আবার কেউ নানা অজুহাত দেখিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে। তবে পাড়া-মহল্লার এই জটলা দূর করতে শিগগিরই অভিযান চালানো হবে বলে জানিয়েছে র্যাব। গতকাল কঠোর লকডাউনের তৃতীয় দিনে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে বাইরে বের হয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) হাতে গ্রেফতার হয়েছেন ৬২১ জন। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৩৪৬ জনকে জরিমানা করা হয়েছে এক লাখ ছয় হাজার ৪৫০ টাকা। ডিএমপির আটটি বিভাগ অভিযান চালিয়ে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত সর্বাত্মক লকডাউনের তৃতীয় দিন ছিল গতকাল শনিবার। এ দিনও পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর তৎপরতায় রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে যানবাহন ও মানুষের উপস্থিতি তুলনামূলক কম দেখা যায়। তবে গত শুক্রবারের চেয়ে শনিবার যানবাহন ও মানুষের উপস্থিতি ছিল কিছুটা বেশি। সরেজমিন রাজধানীর কাওরান বাজার, মিরপুর, খিলগাঁও এলাকা ঘুরে দেখে গেছে, গত দুই দিনের তুলনায় মানুষের আনাগোনা কিছুটা বেড়েছে। সেই সাথে প্রাইভেট যানবাহন, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ছাড়া অন্য যানবাহন চলতে দেখে যায়নি। কিছু কিছু অফিস খোলা থাকায় সেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা অফিসের গাড়ি অথবা রিকশায় চলাচল করছেন।
খিলগাঁও রেলগেট এলাকার অলিগলিতে দোকানপাট গত দুই দিনের তুলনায় একটু বেশি খোলা দেখা গেছে। সেখানে মানুষের উপস্থিতিও ছিল বেশি। অনেকের মুখে কোনো মাস্ক দেখা যায়নি। চিনি কিনতে দোকানে এসেছেন জাহিদুল ইসলাম। বিস্কুট, চানাচুরসহ অন্যান্য জিনিস কিনতে দোকানে এসেছেন জুনায়েদ আহমেদ। আর দুধ কেনার জন্য এসেছেন আসাদুল। এরা সবাই পূর্বপরিচিত হওয়ায় দোকানে কেনাকাটা করতে এসে মেতে উঠেছেন আড্ডায়। দোকানে মাস্ক পরে এলেও আড্ডায় গল্প করার সময় কারো মুখে ছিল না মাস্ক। একটু পর পাশের চায়ের দোকানে গিয়ে চলে তাদের আড্ডা।
মিরপুরের শেওড়াপাড়া শামীম সরণিতে দেখা যায় চায়ের দোকানের আড্ডা। এলাকার ১০-১২ জন কিশোর যুবক নানা ব্র্যান্ডের বাইক নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছেন। সেখানে সিগারেট আর চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন তারা। কারো মুখে মাস্ক দেখা যায়নি।
তবে তাদের দু-একজনকে বাহারি ডিজাইনের মাস্ক হাতে ধরে নাড়াচাড়া করতে দেখা গেছে। স্থানীয় এক ফার্মেসি মালিক বলেন, পত্রিকা পড়ে জানতে পারছি প্রধান সড়কগুলো ফাঁকা; কিন্তু মহল্লার অবস্থা দেখে কোনোভাবেই বোঝা যাচ্ছে না দেশে কঠোর লকডাউন চলছে। বরং স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে মানুষের আনাগোনা আরো বেড়েছে। তিনি বলেন, অন্য সময় দিনের বেলা যারা অফিসে থাকতেন লকডাউনে এখন তারাও বাসায়। কিন্তু আসলে কেউ বাসায় থাকছেন না। কোনো-না-কোনো অজুহাতে বাইরে এসে আড্ডা জমাচ্ছেন। এ দিকে মালিবাগ এলাকার কয়েকজন মুদি ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, লকডাউনে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মুদি দোকান খোলা রাখার অনুমতি থাকলেও মাঝে মধ্যেই পুলিশ অকারণে ঝামেলা করছে। তাদের অভিযোগ, পুলিশ এসে দোকান বন্ধ করে দিয়ে নানা হুমকি দিচ্ছে। এ ছাড়া কোনো কোনো দোকানে অহেতুক জরিমানার অভিযোগও করেন তারা।
গতকালও পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় টহল দিয়েছেন। বিভিন্ন পয়েন্টে প্রাইভেট কার থামিয়ে পরিচয়পত্র যাচাই করছিলেন তারা। সত্যতা না মিললেই জরিমানা করা হচ্ছিল। তবে সত্যিকারের প্রয়োজনে বের হওয়াদের সম্মানের সাথে ছেড়ে দেয়া হয়। দুপুরে শাহবাগে সেনাবাহিনী ও ট্রাফিক পুলিশের সহযোগিতায় চলা ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মারুফা সুলতানা খান হীরামনি সাংবাদিকদের বলেন, করোনার এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে মানুষ তার আত্মীয়ের বাড়িতে গাছের পাকা কাঁঠাল নিয়ে বের হচ্ছে। আবার কেউ কেউ উৎসুক হয়ে লকডাউন দেখতে বের হচ্ছেন। কেউ আবার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দফতরের ভুয়া স্টিকার গাড়িতে লাগিয়ে যাত্রী পরিবহন করছেন। এসব ব্যক্তিদের জরিমানা করা হয়েছে। যারা সত্যিকারে প্রয়োজনে বের হয়েছেন তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এ দিকে গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ার মোড়ে এক সংবাদ সম্মেলনে র?্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, সাত দিনের কঠোর লকডাউনে বিধিনিষেধ মেনে চলা নিশ্চিত করতে সারা দেশে পাড়া-মহল্লায় বিশেষ অভিযান চালাবে র্যাব। তিনি বলেন, কঠোর লকডাউনে মূল সড়কগুলোতে মানুষের অযথা চলাচল কম থাকলেও পাড়া-মহল্লায় দিনভর জটলা লেগে থাকে। এমন বাস্তবতায় দেশজুড়ে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে র্যাব।
রাজশাহীতে বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ি
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, রাজশাহীতে লকডাউন বাস্তবায়নে গতকালও কঠোর অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সকাল থেকে মোড়ে মোড়ে ব্যারিকেড এবং অস্থায়ী চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রধান প্রধান সড়কে চলছে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর টহল। নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর অবস্থান সত্ত্বেও সড়কে বেড়েছে ব্যক্তিগত যানবাহনের সংখ্যা। এর মধ্যে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল চলাচল বেশি লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন স্টিকার লাগিয়ে বের হওয়া এসব যানবাহন তল্লাশি ও বাধার মুখেও পড়ছে। যথাযথ প্রমাণ ও সঠিক জবাব দিতে না পারলে মামলা ও জরিমানার মুখে পড়তে হচ্ছে।
জানা গেছে, লকডাউনে নির্দেশনা অমান্য করায় গত শুক্রবার মহানগরীসহ রাজশাহী জেলায় ৬৭ হাজার ৭৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। মামলা হয়েছে ৬৬ জনের বিরুদ্ধে। আগের দিন বৃহস্পতিবার ভ্রাম্যমাণ আদালত ৫০ জনের কাছ থেকে ৬৬ হাজার ৭৫০ টাকা জরিমানা আদায় করে। এ দিকে গতকাল তৃতীয় দিনেও কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নে কঠোর অবস্থানে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সকাল থেকে রাজশাহী নগরীর প্রধান সড়ক ও পাড়া-মহল্লার গলিপথেও টহল দেন তারা। কাঁচাবাজার ছাড়া শনিবার দুপুর পর্যন্ত কোথাও মানুষের ভিড় লক্ষ করা যায়নি। বিকেল ৫টা পর্যন্ত নগরী প্রায় ফাঁকাই দেখা গেছে। তবে মহানগরী ও প্রতিটি উপজেলায় জরুরি সেবাগুলো চালু রয়েছে আগের মতোই। পুলিশ, র্যাব ও আনসার ব্যাটালিয়নের সদস্যদের পাশাপাশি রাজশাহী নগরী এবং প্রতিটি উপজেলায় সেনাবাহিনীর দু’টি করে টিম টহল দিচ্ছে। পাশাপাশি তিন প্লাটুন বিজিবি ‘লকডাউন’ কার্যকরে মাঠে রয়েছে।
যাত্রীশূন্য শিমুলিয়া ঘাট
মুন্সীগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাট এখন যাত্রীশূন্য। নেই তেমন গাড়ির চাপ। গতকাল সকাল থেকেই অল্প অল্প করে পণ্যবাহী যান, অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের গাড়ি পারাপার করা হয়। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে অংশে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা টহল দিচ্ছে। তারা পণ্যবাহী যান ও অ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোনো যান শিমুলিয়া ঘাটে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশের ২০টি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। তবে পণ্যবাহী গাড়ি পারাপারে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌরুটে ১৫টি ফেরি সচল রয়েছে বলে জানিয়েছে বিআইডাব্লিউটিসি ঘাট কর্তৃপক্ষ।
কক্সবাজারে কঠোর অবস্থান
কক্সবাজার অফিস জানায়, গতকালও শহরের প্রতিটি মোড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান ছিল। সকালে দেখা যায়, শহরের পানবাজার এলাকায় গেছেন জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে পুলিশ সুপার মো: হাসানুজ্জামানসহ সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, নৌবাহিনী ও আনসার সদস্যরা। তারা অপ্রয়োজনীয় যানবাহন আটক ও ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন। পাশাপাশি নানা অজুহাতে বাইরে আসা মানুষকে সতর্ক করছেন। এ ছাড়া শহরের বিমানবন্দর সড়ক, হলিডের মোড়, জাম্বুর মোড়, কলাতলীর ডলফিন চত্বর, বাস টার্মিনাল ও লিংক রোডেও একই অবস্থা। জেলা প্রশাসক বলেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে বৃষ্টির মধ্যেও জেলা প্রশাসনের ৩০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে ছিলেন। এ দিকে কঠোর লকডাউনের দ্বিতীয় দিনে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে ৩০টি অভিযানে ২১৪টি মামলায় ২১৮ জনকে দণ্ডিত করা হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে এক লাখ ৮৬ হাজার ৩৫০ টাকা। তবে কাউকে কারাদণ্ড দেয়া হয়নি।
বগুড়ায় ঢিলেঢালা অবস্থা
বগুড়া অফিস জানায়, চলমান লকডাউনের তৃতীয় দিনে বগুড়ায় ঢিলেঢালা অবস্থা দেখা গেছে। শহরে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর টহল থাকলেও বহু লোকসমাগম দেখা গেছে। ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরবাইক, অটোরিকশা ও অটোভ্যানের আধিক্য দেখা গেছে শহরের মূল সড়কে। আগের দিনগুলোর মতো চালক ও যাত্রীদের খুব একটা জেরার মুখে পড়তে দেখা যায়নি। এ ছাড়া আগের চেয়ে সড়কে সাধারণ মানুষের চলাচল ছিল চোখে পড়ার মতো।
শহরে অলিতে-গলিতে লকডাউনের শুরুর দিন থেকে চলছে সাধারণ মানুষের অবাধ আড্ডা ও উপস্থিতি। সবগুলো মার্কেট, বিপণিবিতান বন্ধ থাকলেও বড়গোলা মোড়ে টিনপট্টি এলাকায় প্রায় দোকান খোলা ছিল। এ দিকে জেলা প্রশাসনের এনডিসি জি এম রাশেদুল ইসলাম জানান, গতকাল সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলা অভিযানে বিধিনিষেধ অমান্যকারীদের ১১৯টি মামলায় ১২৩ জনকে ৯০ হাজার ৯৫০ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement