০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

স্বাস্থ্যসেবা কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালী করা বড় চ্যালেঞ্জ

একান্ত সাক্ষাৎকারে অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান
-

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা হবে ভিন্নতর। ভিন্নতর মানে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই অবস্থান কত দিন থাকবে তা অনিশ্চিত। তবে যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে আছে, যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করছে, যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের ওপর এটার একটা নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়বে। এখন স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালী করাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিডিপি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
নিচে তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলোÑ
নয়া দিগন্ত : কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় ঢেউয়ে গোটা বিশ্বে অচল অবস্থা চলছে। অর্থনীতিতে এর অভিঘাত কতটা গুরুতর হবে বলে মনে করেন?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান : করোনার প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় এই ধাক্কা ভিন্নতর হবে। ভিন্নতর মানে, দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই অবস্থান কত দিন থাকবে তা অনিশ্চিত। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় আমাদের কল-কারখানাগুলো কিছু দিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এখন তো সেসব খোলা আছে। আবার সেই সময় আমরা দেখেছি অনেক উন্নত দেশে সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটেছে। উন্নতদেশগুলো এখন আবার একটু করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দিকে ফিরে যাচ্ছে। ফলে এটা একটু ভিন্নতর এবং মাত্রাও প্রথমটার তুলনায় সীমিত হবে।
যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে আছে, যারা দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করছে, যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তাদের উপর এটার একটা নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়বে। এই রোজার সময় দোকানপাট অনেকটাই বন্ধ আছে। সেখানে যারা কাজ করেন, সারা বছর যারা বৈশাখী পার্বণ, রোজা ও ঈদের জন্য অপেক্ষা করেন, তাদের ওপর একটা বড় ধরনের প্রভাব তো পড়বেই। ফলে আয়-রোজগার, উৎপাদন, কর্মসংস্থান এসবের ওপর তো প্রভাব প্রড়বেই। তবে এসব নির্ভর করবে এই ঢেউয়ের স্থায়িত্বের মেয়াদ কতটুকু হয় তার ওপর।
নয়া দিগন্ত : করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কী কী?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান : সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্বাস্থ্য খাত। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সীমিত এবং অনেকে কর্মহীন আছে। অনেকের আয় কমে গেছে। সামাজিক সুরক্ষা শক্তিশালী করা। আমাদের কূটনীতিও আরো শক্তিশালী করা দরকার। যারা এখানে আটকা পড়ে আছে তাদেরকে কূটনৈতিক তৎপরতায় কর্মস্থলে ফেরত পাঠাতে হবে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দ্বিতীয় বছরে এসে দেখা যাচ্ছে আমরা পিছিয়ে গেছি। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সাত লাখের বেশি প্রতি বছর বিদেশে গেছে। আমরা যদি ২০২০ সালের মার্চ থেকে দেখি তাহলে আড়াই লাখের মতো বিদেশে গেছে। সব মিলিয়ে শ্রমবাজারের ওপরও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে।
নয়া দিগন্ত : রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি, আসছে নতুন অর্থবছরের বাজেট। এ ক্ষেত্রে বাজেট তৈরিতে সরকারকে কী কী পদক্ষেপ এবং কোন দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান : আমাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে স্বাস্থ্য খাতকে। আর সেখানে প্রস্তুতি ও কর্মকাণ্ড যেসব করা দরকার আমাদেরকে সেগুলো অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। সামনে যে বাজেট আসছে তাতেও এসবের ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিতে হবে আমাদেরকে। গতবারের বাজেটে দেখেছি ১০ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থার জন্য সেটাও যে ভালোভাবে ব্যবহার করা হয়েছে সেটা আমরা দেখি নাই। সেটা ঠিকমতো করা হলে করোনার দ্বিতীয় এই ঢেউয়ের ধাক্কাটা সামাল দেয়া আমাদের জন্য সহজ হতো। তাই সেটা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাজেটে আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া। বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া। ভ্যাকসিনেশনকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেয়া।
সীমিত সময়ের জন্য যদি আমাদের লগডাউনটা মেনে নিতে হয়, তা হলেও সেটাতে যাওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়। সরকার প্রথমে যে সাতদিন করেছিল, পরে আবার বাড়াল, এটা ঠিকই সিদ্ধান্ত। অর্থনীতির ওপর বৃহত্তর স্বার্থে নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সরকারের এই পদক্ষেপ আমার মনে হয় সঠিক। এটার অভিঘাত হবে। সেটার জন্য আমাদের সামাজিক সুরক্ষা যেটা আছে, বিশেষত আমরা সিপিডি থেকে বলেছি নগদ সহায়তা বা ক্যাশ ট্রান্সফার প্রকৃষ্ট উপায়। কারণ এটা হলে তা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এর ফলে চাহিদার সৃষ্টি হয়। চাহিদার ফলে সরবরাহ বাড়ে। তাতে করে উৎপাদনের চাহিদার সৃষ্টি হয়। উৎপাদন হলে কর্মসংস্থান হয়। আর কর্মসংস্থানের কারণে আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটা হলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক চক্র হয়।
সামাজিক সুরক্ষা ও ক্যাশ ট্রান্সফারকে অগ্রাধিকার দেয়া। উদ্দীপনামূলক সহায়তা প্যাকেজগুলো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে করা হয়েছিল। তবে এগুলোর বাস্তবায়ন এখনো পুরোটা হয়নি। ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্য আরেকটির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিগুলো দ্রুত বাস্তবায়ন করার ব্যাপারে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে যারা অনানুষ্ঠানিক খাতে আছে, এখানে উদ্যোক্তা বলি বা সেবা খাত বলি তাদের বিষয়গুলোকে ভাবতে হবে। শ্রমবাজারের ওপরও বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। তাই আমাদের প্রস্তাব, শ্রমঘন নিয়োজন সরকার করতে পারে। যেমন রাস্তাঘাটের মেরামত থেকে শুরু করে খাল বিল পরিষ্কার করা ইত্যাদি। যেখানে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া; যাতে মানুষ একটা কিছু করে খেতে পারে। জীবন চালাতে পারে।
পাশাপাশি আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের ছেলেমেয়েদের একটা বড় ধরনের বিপর্যয় হয়েছে শিক্ষা জীবনে। দীর্ঘমেয়াদে এটা যেন আমাদের নেতিবাচক ফল না হয়। ইন্টারনেটের সহজপ্রাপ্তিতা অনেকের নাই। কিন্তু যেটা আছে সেটার মূল্য কমানো। ডিজিটালভিত্তিক নতুন যেসব সুযোগ হচ্ছে বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড আছে সেগুলোতেও ইনসেন্টিভ দেয়া। সেদিকেও নজর দিতে হবে। চ্যালেঞ্জিং বেশি প্রবৃদ্ধির দিকে না, শ্রমনিয়োজন কিভাবে হয়, মানুষের তাৎক্ষণিক চাহিদা বা প্রয়োজন কিভাবে আমরা পূরণ করতে পারি এবং স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া। এগুলোর দিকে আমাদের নজর দেয়া। স্বাস্থ্য খাত, সামাজিক নিরাপত্তা, যেসব জায়গায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ বেশি, কৃষিতে বরাদ্দে নজর দিতে হবে। তবে স্বাস্থ্য খাতে শুধু বরাদ্দ নয়, বাস্তবায়নেও নজর দিতে হবে। কৃষি খাত ও গ্রামীণ কৃষিবহির্ভূত অর্থনীতি, যেখানে অনেক শ্রমনিয়োজন, সে জায়গাতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত।
এডিপিতে যেসব প্রকল্প শেষ করার সেগুলোকে শেষ করার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া। কারণ যত বিলম্ব হবে ততই বাস্তবায়ন খরচ বাড়বে। এই সময়ে বাড়তি মেগা প্রকল্প না নিয়ে যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি খুব বেশি একটা হয় না সেগুলোতে গ্যাপ দিয়ে, যেখানে সরকারি বিনিয়োগ করলে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগে সুবিধা হবে এবং ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ টানবে সে ধরনের প্রকল্পগুলোকে এখন এডিপিতে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।
নয়া দিগন্ত : সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা কতটা বাস্তবে কার্যকর হয়েছে বলেনি মনে করেন? ধাক্কা মোকাবেলায় বা সামাল দিতে কি করণীয়?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান : সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে সেটা খুবই প্রয়োজন ছিল। খুব দ্রুততার সাথেই সরকার সেটা দিয়েছে। অবশ্যই আমরা দেখেছি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চেষ্টা ছিল কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য যেটা ২০ হাজার কোটি টাকা , কৃষির জন্য যেটা দিয়েছে, সেখানে নিয়মনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতেছে। এনজিওদের মাধ্যমে দেয়ার কথা হচ্ছে। এতে হয়তো কার্যকরভাবে দেয়া যাবে। বড়রা যে নিয়েছে, সেটার ফলে তো কারখানাগুলো চালু ছিল। শ্রমিকদের বেতন দিতে পেরেছে। শ্রমিকদেরও কাজে লেগেছে। এসএমইদের জন্য এনজিওদের কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেটা চিন্তা করা। পাশাপাশি চলমান করোনার পরিপ্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফায় প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়ার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। যেসব কর্মসূচি আমরা দিয়েছি বাজেটে সেগুলোকে আরো সম্প্রসারণ করা সম্ভব আমার মনে হয়। সাবসিডাইজ লোন সেটা সরকার দিয়েছে।
নয়া দিগন্ত : ঘাটতি মোকাবেলায় বা সামাল দিতে কি করণীয় মনে করেন?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান : আমরা বলেছি ঘাটতি যদি বাড়েও তাতে নজর না দিতে। কিন্তু সমস্যা তো সেটা নয়। সমস্যা হলো আমরা টাকাও খরচ করতে পারছি না। আমাদের বাজেট ঘাটতি যে ৫ শতাংশ অতিক্রম করে ৭ শতাংশে চলে যাচ্ছে, সেটাও না। গত আট মাসে আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন যা হয়েছে, সেটা খুবই হতাশাজনক। এডিপি বাস্তবায়ন না হলে তো বাজেট উদ্বৃত্ত নিয়ে বের হওয়ার অবস্থা। পাশাপাশি রাজস্ব আয় বাড়ানোর পদক্ষেপও নিতে হবে। যেসব জায়গায় ফাঁকফোকর আছে তা দেখতে হবে। দেশ থেকে যাতে টাকা চলে না যায়। তবে উদ্যোক্তাদের হয়রানি করা নয়। যেসব জায়গাতে কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে সেগুলোকে চিহ্নিহ্নত করে আদায়ের ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ ছাড়া আমাদের বাস্তবায়নের দিকেও নজর দিতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে যা দেয়া হয়েছিল তা তো খরচই হয়নি। এসব তো কোনো কাজের কথা নয়। এসব খাতে আমাদের সুশাসন, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও ব্যয় সক্ষমতার দিকে নজর দিতে হবে।
সঙ্কটে সংস্কার করার একটা সুযোগ আসে। আমাদের অনেক সংস্কার তো দীর্ঘ দিন ধরে পড়ে আছে। ডাইরেক্ট ট্যাক্স অ্যাক্ট থেকে শুরু করে ভ্যাটের বাস্তবায়ন, রাজস্বের ক্ষেত্রে, সংস্কারে নজর দেয়া দরকার এখনই। আহরণ, বিতরণ ও বাস্তবায়ন-তিনটি দিকে নজর দিতে হবে।
নয়া দিগন্ত : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, ভালো থাকবেন।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান : তোমাকেও ধন্যবাদ। তুমিও ভালো এবং নিরাপদে থাকবে।


আরো সংবাদ



premium cement