শহীদ সেনা দিবসে সমাধিস্থলে স্বজনদের অশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধা
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
সত্তরোর্ধ্ব বয়সী রাজিয়া জামান। বয়সের ভারে হাঁটাচলা সেভাবে করতে পারেন না। কিন্তু মনের জোরে বড় ছেলে আব্দুল্লাহ আল মোর্শেদের সহায়তায় ছোট ছেলে শহীদ মেজর মো: মোস্তফা আসাদুজ্জামানের সমাধিস্থলে এসেছেন। কবরের পাশে বসে ছেলের জন্য ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন। বলেন, ‘ও তো সবই শুনতেছে। কিন্তু বলতে তো পারতেছে না। ছেলের জন্য দোয়া চাই।’ ওই মুহূর্তে এর বেশি এই শোকার্ত মা আর কোনো কথা বলতে পারলেন না।
শহীদ কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহম্মেদ। র্যাবের সাবেক গোয়েন্দা শাখার প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিচালক। একজন চৌকস অফিসার হিসেবে সারা দেশে তার সুনাম রয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের ঠিক এক সপ্তাহ আগে তিনি বিডিআর সিলেট সেক্টর প্রধান হিসেবে যোগ দেন। এরপরই ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় দরবার হলে তিনি নিহত হন। গতকাল তার সমাধিস্থলের সামনে দোয়া শেষে অশ্রুসিক্ত নয়নে স্ত্রী ফাতেমা সুলতানা বলেন, ‘আমার শহীদ স্বামী এবং আমাদের জন্য দোয়া রাখবেন, এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার নাই।’
৭৫ বছর বয়সী কোহিনূর বেগম মেয়ে মুন্নির সহায়তায় হুইল চেয়ারে করে এসেছেন ছেলে শহীদ মেজর মো: মিজানুর রহমানের সমাধিস্থলে। কবরের দেয়াল ধরে কাঁদতে থাকেন। দুঃখিনী এই মায়ের কান্না থামাতে তার মেয়ে বারবার চোখের পানি মুছে দিচ্ছিলেন। এমনই শোকাবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় গতকাল বনানীর সামরিক কবরস্থানে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে নিহত ৫৭ সেনা কর্মকর্তার কবর ঘিরে। অনেক শহীদের বৃদ্ধ মা-বাবা বলছেন এটাই হয়তো কারো কারো শেষবারের মতো দেখা হবে ছেলের সমাধিস্থল। তাই অনেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সমাধিস্থলে নিয়ে এসেছেন।
শহীদ মেজর মোহাম্মদ মমিনুল ইসলাম সরকারের সমাধিতে এসেছেন বাবা মফিজুল ইসলাম সরকার, মা মমিনুন্নেসা, দুইবোন ও তাদের সন্তানরা। তারা সকলে অশ্রুসিক্ত ছিলেন স্বজন হারানোর বেদনা ও স্মৃতি নিয়ে।
কবরস্থানে ৭ নাম্বার ব্লকের ৬৪২ নাম্বার কবরটি শহীদ মেজর মিজানুর রহমানের। এরপাশেই বসে আছেন তার মা কোহিনূরসহ অন্য স্বজনরা। এ সময় তার বোন মুন্নি বলেন, ‘এই বয়সে মাকে আনতে চাইনি, তারপরও মা বায়না ধরেছে তাকে যেন নিয়ে আসি। সামনের বছর বাঁচেন কিনা জানেন না, হয়তো এটাই শেষ দেখা হতে পারে ছেলের কবর। এরপর কী আর রেখে আসা যায়। মাকে নিয়া আমরা আসলাম...। তিনিও কথা বলতে বলতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন শহীদ ভাইয়ের কথা স্মরণ করে। শহীদ মমিনুলের বাবা মফিজুল ইসলাম বলেন, এমন কোনো দিন নাই যে ছেলের কথা মনে না হয়, কত বড় বর্বরতা চালিয়ে যারা এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছেন। বেঁচে থাকতে এর বিচার দেখে যেতে চাই এই দোয়া করি।
অন্য দিকে কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদ মেজর মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী রিতা রহমান জুলি বলেন, আমরা খুব বেশি কিছু চাইনি। দীর্ঘদিন ধরে চেয়েছি শহিদী মর্যাদা এবং বিচারটা সুষ্ঠুভাবে হোক। যারা দোষী তারা যেন সামনে আসে, যেন সুষ্ঠু বিচারটা হয়।
শহীদ কর্নেল কুদরত এলাহীর ছেলে অ্যাডভোকেট সাকিব রহমান বলেন, এতদিন ধরে আমাদের বাবারা আর্মির লিস্টে শহীদ ছিলেন। এই প্রথম বাংলাদেশের লিস্টে শহীদ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ জন্য এই সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। তিনি বলেন, আমাদের (শহীদ পরিবার) প্রধানত দু’টি দাবি ছিল, একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন, অন্যটি শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা। এখন পর্যন্ত আমাদের যে আসল দাবি স্বাধীন তদন্ত সেটি কিন্তু শেষ হয়নি। একটি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই তদন্ত যেন চলমান থাকে, আমরা যেন তার (হাসিনা) বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে পারি। আমি আশা করব যে, প্রকৃত অর্থে যারা দোষী আমরা তাদেরকে যেন এখানে আনতে পারি।
শহীদ পরিবারের আরেক নারী সদস্য বলেন, আমি বিগত সরকারের আমলে এখানে কখনো আসিনি। এবারই প্রথম কবরস্থানে এসেছি। এত দিন ক্ষোভ ছিল মনে, কেন আসব! এখন সবকিছু পরিবর্তন হয়েছে এজন্য এসেছি। আমরা সবাই চাই পিলখানা হত্যাকাণ্ড যারা করেছে, বিচারটা হোক, দেশবাসী দেখুক।
পিলখানায় হত্যাযজ্ঞে বাধাদানকারী শহীদ বিডিআরের কেন্দ্রীয় সুবেদার মেজর নূরুল ইসলামের ছেলে আশরাফুল আলম হান্নান বলেন, শহীদ সেনা দিবস ঘোষণার মাধ্যমে পিলখানায় শহীদ আমাদের বাবাদের আত্মত্যাগের প্রতি জাতীয়ভাবে সম্মান দেয়া হয়েছে বলে মনে করি। এই দিবস ঘোষণার মাধ্যমে আমরা যে শহীদের সন্তান, আমাদের হুদয়ের যে ক্ষত সেটি একটু হলেও কমেছে।
শহীদ কর্নেল এমদাদুল ইসলামের বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউসুফ বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের অধিকাংশকে আমি চিনতাম, অনেকে আমার সরাসরি বন্ধু। আজকে আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আলহামদুল্লিাহ যে আমাদের প্রথম চাওয়া পূরণ হয়েছে। আমরা আজকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে পালন করছি। শহীদ কর্নেল মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলামের ছেলে আফিফ আল ইসলাম বলেন, প্রতি বছর এই ফেব্রুয়ারি মাস আসলে চলতে, ফিরতে, খাইতে ও ঘুমাতে গেলে বাবার কথা অনেক মনে হয়। কিন্তু বাবা তো আর আসবেন না। তিনি অনন্ত যাত্রায় পাড়ি দিয়েছেন। যারা এই হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত আমরা এর সুষ্ঠু বিচার চাই। জনগণ যেন জানতে পারে ওই দিন আসলে কী হয়েছিল। আমরা এখন আশা করতে পারি, এই বিচার এই দেশের মাটিতেই হবে। অনেক শুকরিয়া যে, শহীদের মর্যাদা দিয়ে আজকের দিনটি (২৫ ফেব্রুয়ারি) শহীদ সেনা দিবস ঘোষণা ও পালিত হচ্ছে। এই শহীদের স্ত্রী শামীমা আক্তার লুনাও প্রায়ই একই কথা ব্যক্ত করেন। এর আগে সকাল ৯টায় রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে প্রতিনিধি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান নিজ নিজ বাহিনীর পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপি ও শহীদ পরিবারের সদস্যরা একে একে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পিলখানায় সেনা সদস্যদের হত্যার ঘটনা ঘটে। সেখানে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ নিহত হন ৭৪ জন। হত্যার এই ঘটনাকে ‘জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি’ ও ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে পালনের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল শহীদ সেনা পরিবারের। সেটি বিগত সরকার করেনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা