২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৫ শাবান ১৪৪৬
`

কক্সবাজারে বিমানবাহিনীর সদস্যদের সাথে সংঘর্ষে নিহত ১ আহত ১৫

-


কক্সবাজার শহরে বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় বিমানবাহিনীর সদস্যদের সাথে এলাকাবাসীর সংঘর্ষে এক যুবক নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন আরো ১৫ জন। গতকাল সোমবার দুপুর ১২ টার দিকে বিমানবন্দরের পাশের সমিতি পাড়ায় এ ঘটনা ঘটেছে। বিমানবন্দর সম্প্রসারণে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য স্থানীয়দের উচ্ছেদ করা নিয়ে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত বলে স্থানীয়দের দাবি।
অপর দিকে কক্সবাজারে বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে স্থানীয় দুর্বৃত্তদের হামলার কথা জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)। গতকাল দুপুরে আইএসপিআর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বিমানঘাঁটির পাশের সমিতি পাড়ার কিছু দুর্বৃত্ত অতর্কিত হামলা চালায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে।
কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, এ ঘটনায় শহরের বাহারছড়ার পিটিআই স্কুলের সাবেক সুপার নাসির উদ্দিনের ছেলে শিহাব কবির নাহিদ নিহত হন। তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। তবে আহতদের নাম ও পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের পুলিশ বক্সের কর্তব্যরত ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম ঘটনায় একজন নিহত এবং পাঁচজন চিকিৎসাধীন থাকার তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন জানান, এ ঘটনায় একজন নিহত ও আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত কীভাবে তা উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সমিতি পাড়ার বাসিন্দা মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, গতকাল দুপুরে বিমানবন্দর সম্প্রসারণে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য এলাকাবাসীকে অন্যত্রে সরিয়ে নিতে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে বিমানবাহিনীর কর্মকর্তারা এবং এলাকাবাসীর প্রতিনিধিদের সাথে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠকের সময় নির্ধারণ ছিল। এ লক্ষ্যে দুপুর ১২টার দিকে সমিতি পাড়ার বাসিন্দা মো: জাহেদুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন ইজিবাইকে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে যাচ্ছিলেন। তাদের বহনকারী গাড়িটি ডায়াবেটিক পয়েন্ট এলাকায় বিমানবাহিনীর চেকপোস্টে পৌঁছলে থামানো হয়। এ সময় বিমানবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে জাহেদের তর্কবিতর্ক হয়। পরে বিমানবাহিনীর সদস্যরা তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে খবর পেয়ে এলাকাবাসী ঘটনাস্থলে জড়ো হয়। এ সময় এলাকাবাসী জাহেদকে নিয়ে যেতে বাধা দিলে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
কক্সবাজারে ঘটনা প্রসঙ্গে আইএসপিআরের ব্যাখ্যা : কক্সবাজারে বিমানবাহিনীর নির্মাণাধীন ঘাঁটিতে সংঘর্ষের ঘটনার বিবরণ দিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর)। গতকাল বিকেলে আইএসপিআরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিবরণের পাশাপাশি এ ঘটনায় এক যুবকের মৃত্যু নিয়েও নিজেদের ব্যাখ্যা তুলে ধরা হয়েছে।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘কক্সবাজারের সমিতি পাড়ার কিছু স্থানীয় দুর্বৃত্ত সোমবার বিমানবাহিনী ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। উল্লেখ্য যে বিয়াম স্কুলের পাশে বিমানবাহিনীর চেকপোস্ট থেকে স্থানীয় এক ব্যক্তির মোটরসাইকেলের কাগজপত্র না থাকায় বিমানবাহিনীর প্রভোস্ট কর্তৃক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে ঘাঁটির ভেতরে নেয়া হয়। এ সময় সমিতি পাড়ার আনুমানিক দুই শতাধিকেরও বেশি স্থানীয় লোকজন বিমানবাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হলে বিমানবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাধা দেন। পরবর্তীতে স্থানীয় লোকজনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে বিমানবাহিনীর চেকপোস্ট এলাকায় বিমানবাহিনীর সদস্য ও সমিতি পাড়ার কিছু দুষ্কৃতকারী লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলে কিছু কুচক্রী মহলের ইন্ধনে দুর্বৃত্তরা বিমানবাহিনীর সদস্যদের ওপর ইটপাটকেল ছোড়ে। এ সময় দুর্বৃত্তদের ছোড়া ইটপাটকেলের আঘাতে কয়েকজন আহত হন, যার মধ্যে বিমানবাহিনীর ৪ জন সদস্য (১ জন অফিসার ও ৩ জন বিমানসেনা) আঘাতপ্রাপ্ত হন এবং শিহাব কবির নাহিদ নামের এক যুবককে গুরুতর আহত অবস্থায় বিমানবাহিনীর গাড়িতে করে স্থানীয় হাসপাতালে নেয়ার পর মারা যান।

আইএসপিআর বলেছে, ‘রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রক্ষার্থে বিমানবাহিনীর সদস্য কর্তৃক বিমানবাহিনীর ‘রুলস অব এনগেজমেন্ট’ অনুয়ায়ী ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। তবে স্থানীয় জনসাধারণের ওপর কোনো প্রকার তাজা গুলি ছোড়া হয়নি। বিমানবাহিনীর সদস্যরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।’
স্থানীয় জনগণের ইটপাটকেলের আঘাতে বিমানবাহিনীর গাড়ির কাচ ভেঙে যায় জানিয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘এ ছাড়া স্থানীয় জনগণ ঝোপঝাড়ে আগুন দেয়ার চেষ্টা করেছিল, যা পরবর্তীতে বেশি সম্প্রসারিত হয়নি। এমতাবস্থায়, একটি কুচক্রী মহল বিমানবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করার লক্ষ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিমানবাহিনীর গুলিতে ওই যুবক নিহত হয়েছে বলে বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, যা সত্যি নয়। এ ক্ষেত্রে প্রচারিত গুলির খোসার ছবিটি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে ওই খোসাটি ফাঁকা গুলির (ব্ল্যাঙ্ক কার্টিজ), যা প্রাণঘাতী নয় এবং শুধু শব্দ তৈরি করে। যুবক নিহতের ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গভীর শোক ও পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছে।’

আইএসপিআরের বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ‘এ ছাড়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে উক্ত ঘটনা প্রকাশে কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসৎ উদ্দেশ্যে বিমানবাহিনী ঘাঁটি কক্সবাজারের নাম বিমানবাহিনী ঘাঁটি শেখ হাসিনা হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, যা সত্য নয়। ওই ঘাঁটির নাম ২০২১ সালের ২ ডিসেম্বর সরকারি প্রজ্ঞাপনে পরিবর্তন করে বিমানবাহিনী ঘাঁটি কক্সবাজার রাখা হয়, যা বর্তমানেও বহাল রয়েছে।’
আইএসপিআর বলেছে, ‘বাংলাদেশ বিমানবাহিনী দেশের আকাশসীমা রক্ষার পাশাপাশি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের আপামর জনসাধারণের সাথে কাজ করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও বিমানবাহিনী দেশের মানুষের কল্যাণে সর্বদা সচেষ্ট থাকবে। দেশের জনগণের জানমাল ও নিরাপত্তা রক্ষার্থে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী সর্বদা অঙ্গীকারবদ্ধ।’

জায়গা নিয়ে বিরোধ অনেক দিনের : জানা যায়, কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির জন্য পৌরসভার ১ নং ওয়ার্ডের সরকারি খাস জমি অধিগ্রহণ করে বিমানবাহিনী। সেই লক্ষ্যে ১৫ বছর আগে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার পরিবারের পুনর্বাসনের তালিকা তৈরি করা হয়। এরই মধ্যে প্রায় দেড় হাজার পরিবারকে সদর উপজেলার খুরুশকুলের আশ্রয়ণ প্রকল্পে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেছে বিমানবাহিনী। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্টের পর ১ নং ওয়ার্ডে বসবাসকারী প্রায় ৩০ হাজার লোক বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে না যাওয়ার ঘোষণা দেন। তারা ১ নং ওয়ার্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসের দাবিতে মানববন্ধন করে প্রধান উপদেষ্টার বরাবরে স্মারকলিপিও দেন।

উচ্ছেদ রোধে কুতুবদিপাড়ার সাবের হোসেনের ছেলে জাহেদুল ইসলাম, দিদারুল ইসলাম রুবেল, সমিতি পাড়ার সাইফুল ইসলাম, মোস্তফাসহ আরো কয়েকজন নেতৃত্ব দেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত শনিবার বিমানবাহিনী একটি ঘর উচ্ছেদ করতে গেলে জাহেদুল ইসলামের নেতৃত্বে এলাকার লোকজন বাধা দেন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এরই জের ধরে গতকাল বেলা ১১টায় জাহেদ শহরে আসার পথে তাকে চেকপোস্টে আটক করে বিমানবাহিনী। খবর পেয়ে এলাকাবাসী এগিয়ে আসার চেষ্টা করলে বিমানবাহিনীর সাথে সমিতি পাড়া ও কুতুবদিয়া পাড়ার লোকজনের কথা কাটাকাটি হয়।
একপর্যায়ে উত্তেজিত জনতা ইটপাটকেল ছোড়া শুরু করলে সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষের সময় বিমানবাহিনীর সদস্যরা স্থানীয় লোকজনকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে বলে অভিযোগ করেন এলাকাবাসী।
এদিকে সংঘর্ষের ঘটনায় বিমানবাহিনীকে দোষারোপ করে এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন কক্সবাজার শহরের সমিতি পাড়ার বাসিন্দারা। গতকাল সন্ধ্যায় কক্সবাজার প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা দাবি করেন, দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি পক্ষ পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে বিমানবাহিনী ঘাঁটির নামে অপ্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, যেখানে যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে জলবায়ু উদ্বাস্তু প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। এই জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ও জমি বন্দোবস্তের দাবিতে আন্দোলনরতদের একজন জাহেদকে বিমানবাহিনীর চেকপোস্ট থেকে আটক করা হয়। দীর্ঘসময় পর তাকে ছেড়ে না দেয়ায় স্থানীয় লোকজন সেখানে যান। এ সময় তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি করা হয়।
সংবাদ সম্মেলন বক্তব্য রাখেন স্থানীয় সমাজ নেতা ফুরকানুর রশিদ, এম এজাবত উল্লাহ কুতুবি ছাবের আহাম্মদ, সৈয়দ আলম ও ছাত্র প্রতিনিধি সাগর।
সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয়রা আইএসপিআরের বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করার পাশাপাশি গণমাধ্যমগুলোতে স্থানীয় লোকজনকে ‘দুর্বৃত্ত’ অভিহিত করার জন্য ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানানো হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement