তরুণদের নেতৃত্বে ঠেলে দিয়ে বয়স্কদের গাইড করা দরকার
- ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৩
শিক্ষাবিদ-নিরাপত্তা বিশ্লেষক মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে শিক্ষকতা পেশায় দুই দশকের বেশি সময় পার করেছেন কর্নেল (অব:) জেড আর এম আশরাফ উদ্দিন, পিএসসি বলেছেন আপনি প্রজন্মকে ভালো শিক্ষা দেবেন, ভালো জিনিস বের হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা অসাধারণ, ভালো কোচিং দেবেন, বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা যে কী ম্যাজিক দেখাতে পারে তা অকল্পনীয়, কিন্তু সুযোগ দিতে হবে।
তিনি রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, আমরা যে বিশ্বের মধ্যে আছি, যেসব দেশের সাথে ডিল করতে যাচ্ছি তাদের সবাই কিন্তু চিন্তাভাবনা করে কাজ করছে। সবার থিংট্যাংক আছে, চিন্তাভাবনা করার মানুষ আছে, সবার মেধাবী লোক আছে। আমরা যদি স্লোগান নিয়ে চলি, জোশের মধ্যে চলি, একধরনের প্রোটোটাইপ চিন্তা নিয়ে চলি তো আমরা ধরা খেয়ে যাবো, আমরা শত্রুর কাছে মার খেয়ে যাবো।
তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনার আহ্বান জানিয়ে কর্নেল আশরাফ বলেন, ইউরোপের চারটি দেশে ৩২ থেকে ৩৫ বয়সের চারজন প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চল্লিশ বছর বয়সে জিয়াউর রহমান বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলেন ভাবুন। নেতৃত্বকে ভাইব্র্যান্ট অবস্থায় থাকতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে আবদ্ধ জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তরুণ নেতৃত্বকে পথ চলার জন্যে পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে, পথ আগলে রাখলে চলবে না।
কর্নেল (অব:) জেড আর এম আশরাফ উদ্দিন বিএসআরএসএস-এর সাবেক গবেষণা পরিচালক ছিলেন। সেনাবাহিনীতে আর্টিলারি স্কুল থেকে শুরু করে ইনফ্রেন্টিসহ বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষকের বর্ণাঢ্য জীবন কেটেছে। পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ডিজিএফআইতে। জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি অঙ্গহানির শিকার হন। লেখক, কবি ও সাহিত্যিক হিসেবে তার রয়েছে ঈর্ষণীয় খ্যাতি। এখানে তিনি আশরাফ আল দীন হিসেবে পরিচিত। মানারত স্কুল এন্ড কলেজসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে তিনি অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। নয়া দিগন্তের সাথে তার এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন নির্বাহী সম্পাদক মাসুমুর রহমান খলিলী; সাথে ছিলেন মাল্টিমিডিয়া সম্পাদক যুবরাজ ফয়সল। নিচে তার সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত-
নয়া দিগন্ত : এখন রাষ্ট্রসংস্কারের কাজ চলছে। সেনাবাহিনী থেকে অবসরের পর প্রায় দুইদশক আপনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালন করেছেন। শিক্ষাখাতে গত ১৫ বছর যে বিশাল ক্ষতিসাধিত হয়েছে তা থেকে উত্তরণে কিভাবে আমরা অগ্রসর হতে পারি?
কর্নেল আশরাফ : গত দুইদশক শিক্ষাখাতে কাজ করার আগে প্রায় ৩০ বছর সেনাবাহিনীতে কাজ করার উল্লেখযোগ্য সময় আমার কেটেছে প্রশিক্ষক হিসেবে। কাউকে যদি কোনো কিছু ট্রান্সফার করতে হয় তাহলে শিক্ষকের ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়েই তা সবচেয়ে ভালোভাবে করা যায়। নবীদের কথা যদি বলেন আমি শিক্ষকদের বলতাম তোমরা যেভাবেই এ পেশায় আসো না কেন, তোমরা কিন্তু একটা পবিত্র পেশায় আসছ, যে পেশার সামনে আছেন নবীরা, তোমরা ওই লাইনের মধ্যে আছ। এটা যদি তোমার অনুভবে আসে তাহলে তোমার মানসিকতা হতে হবে ওরকম, এটি হবে দেয়ার জন্যে, মানুষের উপকারের জন্যে, শুধু প্রাপ্তির জন্যে নয়। আমাদের উন্নয়নের জন্য অনেক জায়গা রয়েছে, যেখানে বিশাল একটা ভ্যাকুয়ুম আছে, সেটা কোয়ালিটি সম্পন্ন শিক্ষকের জন্যে। আমরা যদি নিজেদের মুসলমান হিসেবে দাবি করি তাহলে বলতে হয় ‘নলেজ ইজ দ্য লস্ট প্রপার্টি অব দি মুসলিমস।’
আমার একটা কলম হারালে সেটা যেখানে হোক খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি। নলেজ তেমন। এটি যদি আমাদের জেনারেশনকে বুঝানো যায়, তাদের অভিভাবকদের বুঝানো যায়, তাহলে সবাই পড়াশুনার জন্যে, জ্ঞান অর্জনের জন্যে এগিয়ে যাবে। সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক সরকার যখন আসে তখন তারা নানারকম মত তৈরি করে। যেখানে যেটা তাদের পলিটিক্যাল এজেন্ডার সাথে যায় সেরকম পদক্ষেপ নেয়। যেমন আমরা গত ১৫ বছর দেখেছি জিপিএ ফাইভ আতঙ্ক। লালমনিরহাটের একজন সিনিয়র শিক্ষিকা একদিন আমাকে জানালেন, তাদের বেশ কয়েকজন শিক্ষককে ডাকা হয়। শিক্ষা অফিসার এসে তাদের প্রত্যেককে একটি লাল ও আরেকটি কালো কলম দিলেন। তারপর বললেন কোনো ছাত্রছাত্রী ফেল করবে না। প্রত্যেককে জিপিএ ফাইভ দিতে হবে। সিনিয়র টিচাররা অঁাঁচ করতে পেরে কিছু না বললেও একজন কমবয়সী টিচার হাত তুললেন কিছু বলার জন্যে। অনুমতি পেয়ে তিনি বললেন, স্যার এটা কেমন কথা। ছাত্রছাত্রী যদি না লেখে তাহলে নম্বর দেবো কিভাবে? ধমক দিয়ে শিক্ষা অফিসার বললেন, তোমার মাথায় কথা ঢুকে না। লাল কলম ও কালো কলম দিলাম কেন? যদি কেউ খাতায় কিছু না লিখে তুমি কালো কলম দিয়ে লিখে দেবে এবং লাল কলম দিয়ে মার্ক দেবে। কারণ ওই এলাকার আওয়ামী লীগ এমপি বলেছেন আমি যতদিন এমপি আছি ততদিন কোনো ছাত্রছাত্রী ফেল করতে পারবে না এবং সবাইকে জিপিএ ফাইভ দিতে হবে। এ জিপিএ ফাইভ কথিত সরকারের আমলেই বাদ দেয়া হয়েছে। পিএসসি, জেএসসি ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা যখন বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা হয় তার আগেই ভারতে তা বাতিল করা হয়েছিল।
ভারতে এ ব্যবস্থা চালুর পর দেখা গেল মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত হচ্ছে না, তখন তা বাদ দেয়া হয়। বাদ দেয়া জিনিস আমাদের এখানে কেন চালু করতে হলো, এটার কে জবাব দেবে? আমরা একটা বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে উঠে এসেছি। রাজনীতির কথা না বললেও আমাদের সিংহভাগ মানুষের বিশ্বাসের মর্ম হচ্ছে ইসলাম। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রে ও রাজনীতিতে এমন অনেক লোক আছে যাদের পেটে আবার ইসলাম হজম হবে না। এরা প্রচণ্ডরকম ভীতির মধ্যে থাকে ইসলাম নিয়ে কথা বলার ব্যাপারে। ছোটকাল থেকে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে ইসলামকে পছন্দ করে। দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে ইসলামকে বাস্তবায়ন করে। কিন্তু ওরা কেন জানি ভয় পায়। প্রাইমারি থেকে ওপর পর্যন্ত শিক্ষার মধ্যে কোনো ইসলাম থাকবে না। আগের দিনে পাঠ্যবইতে থাকতো নুহ নবীর কথা, হযরত আবুবকর অথবা হযরত উমরের একটা কাহিনী, এসব জিনিস সিলেবাস থেকে আউট হয়ে গেলো। আউট করে কী সব জিনিস আনা হলো, অত্যন্ত বীভৎস সব জিনিস। যেগুলো পড়ানোর সময় শিক্ষক শিক্ষিকারা পর্যন্ত লজ্জায় মরে যান। এ যে মেয়েবেলার কথা, ছেলেবেলার কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর ট্রান্সজেন্ডার- এসব হচ্ছে বিভ্রান্তিকর। মূলত শিক্ষাকে সামনে নিয়ে যেতে হলে আসলে আপনাকে ভালো শিক্ষক তৈরি করতে হবে। শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। আবার বেতন বাড়ালেই ভালো শিক্ষক হবে না। ভালো শিক্ষক যারা, তাদের ভালো বেতন দিতে হবে যাতে তারা এটাকে গুরুত্বপূর্ণ পেশা হিসেবে তারা তাদের জীবনে নিতে পারেন। যাতে ভালোরা এ পেশায় আসেন। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয়নি। তার জন্যে এদেরকে বেতন না দিলেও চলে, বেতন বাকি রাখা যায়। শিক্ষকদের কিছু করার নেই। ভালো শিক্ষক ও পরিবেশ দেন তাহলে তারা ছাত্রছাত্রীদের উন্নত করে গড়ে দেবে।
নয়া দিগন্ত : কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থিক সক্ষমতার একটা বাস্তবতাতো আছে।
কর্নেল আশরাফ : আমি দক্ষিণ কোরিয়া সম্পর্কে একটা কথা শুনেছিলাম। আমার কাছে খুব অসাধারণ লেগেছিল। যখন দেশটি নতুন স্বাধীন হলো তখন দেশটির শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষা বাজেট দিলে তা নিয়ে হাসাহাসি করল সবাই। কারণ পুরো বাজেটের চেয়ে ওনার শিক্ষা বাজেট ছিল বড়। এরপর উনি এক ঘণ্টার একটি বক্তব্য রাখলেন। এরপর সবাই ওনার বাজেট বরাদ্দ মেনে নিলেন এবং তা দিয়েই দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হলো। কী ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে? ওনার কথা ছিল আমাদের কোনো সম্পদ নেই, উর্বর মাটি নেই। দ্বীপ হিসেবে আমাদের মাটি আগ্নেয়গিরির লাভা থেকে গঠিত; তো আমাদের জনগণকেই মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে। এদেরকে ছড়িয়ে দিতে হবে সারা বিশ্বে। সারা বিশ্বে কোয়ালিটি লোকের চাহিদা বেশি, আমরা কোয়ালিটি লোকই দেবো। এটাই হবে আমাদের প্রডাক্ট। আর তা-ই হলো। কোরিয়ান প্রকৌশলী এসে আমাদের এখানে সুপারভাইস করছে। আমরা ভাষাও বুঝি না।
ট্রান্সলেটর দিয়ে কাজ চলছে। জাপানের কথাও তাই। মূলত রাষ্ট্রযন্ত্র যদি চায়, দলীয় রাজনীতি যারা করেন, যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা যদি চায় তাহলে সম্ভব, এটা কোনো রকেট সাইন্স নয়। আপনি প্রজন্মকে ভালো শিক্ষা দেবেন, ভালো জিনিস বের হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা অসাধারণ, ভালো কোচিং দেবেন বাংলাদেশী ছেলেমেয়েরা যে কী ম্যাজিক দেখাতে পারে তা অকল্পনীয়, কিন্তু সুযোগ দিতে হবে। গত ১৫ বছর কেন, দুর্ভাগ্য যে আমিতো বলবো পাকিস্তান রাষ্ট্র হওয়ার পরও শাসকরা এগুলো করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ বা আরবি বিভাগ বলেন কোনো কিছুই তারা ঠিকমতো করতে পারেনি। আমাদের সবার জন্যে যে উপকার হবে সে ধরনের করে সমন্বয় করে একটা সিলেবাস করতে হবে। যাতে এরা ভালো মুসলমান হয়, দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, বিশ্বের যেকোনো দেশে নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতে পারে। আর এটা সম্ভব। এখনো সম্ভব। মুশকিল হলো যখন কোনো রাজনৈতিক দল এসে যায় তখন আবার রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আসল বাস্তবতার মধ্যে তফাত হয়ে যায়। বর্তমানে যে সরকার আছে সেই তুলনায় আমি বলবো এটা অরাজনৈতিক ও অনির্বাচিত সরকার। এদের দায়বদ্ধতা পুরো জাতির কাছে, কোনো নির্বাচনী এলাকা বা কোনো মার্কার কাছে না। ওনাদের পক্ষে সম্ভব একটা গ্রহণযোগ্য জিনিসকে সবার জন্যে এগিয়ে নেয়া। কারণ রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আসল বাস্তবতার পার্থক্য ওনাদের ধর্তব্য নয়। এর মধ্যে কোনো রাজনীতির কোনো বাধা নেই। আমার কাছে মনে হয় এখনকার যুবকরা যেভাবে সমস্যাকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছে, তাদেরকে যদি আমরা সুযোগ দেই, সময় দেই, তারা তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে পারবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
নয়া দিগন্ত : এ ক্ষেত্রে আপনি মানসম্পন্ন শিক্ষক, সময়পোযোগী কারিকুলাম ও ইনস্টিটিউশন গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছেন, কিন্তু ইনস্টিটিউশনের দিকে তাকালে যা দেখি আমাদের এখানে ইংরেজি শিক্ষামাধ্যম, মাদরাসা আছে, জেনারেল প্রাইমারি আছে, অনেক রকম শিক্ষার মিলিত প্রডাক্টে-তো গ্রহণযোগ্য গুণগত মান দেখতে পাই না। সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থায় এ মান কিভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব?
কর্নেল আশরাফ : আমাদের এখানে ছয় প্রকারের শিক্ষাব্যবস্থা আছে। মাদরাসার মধ্যে আলিয়া ও কওমি, রয়েছে ইংরেজি ভার্সন ও বাংলা মিডিয়াম, আবার ইংলিশ মিডিয়ামে কেমব্রিজ বা অক্সফোর্ড। শিক্ষা হবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্যে, একটা জাতি তৈরি করার জন্যে মূল প্রেরণা বা উপাদান। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে মারাত্মক রকমের ডিভাইসিভ। শিক্ষাব্যবস্থার সাথে পোশাকের পরিবর্তন লক্ষণীয়। মাদরদাসায় পড়ে দেখে আপনার ছোট ভাইয়ের পরনে পায়জামা, পাঞ্জাবি, টুপি, পায়ে স্যান্ডেল। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েন বলে আপনি প্যান্ট-শার্ট পরেন। ভাইয়ে ভাইয়ে, বন্ধুদের মধ্যে পাড়া বা সমাজের মধ্যে এমন বিভেদ স্পষ্ট। আবার কওমি মাদরাসায় প্রচুর বই পড়ানো হয়। ন্যাশনাল কারিকুলামে অত বই পড়ানো হয় না। মাদরাসায় কলেজের কিছু কারিকুলাম দেয়া যায়। আবার স্কুল-কলেজে মাদরাসার কিছু শিক্ষা উপকরণ দেয়া যেতে পারে। একজন মুসলমান, নাগরিক ও মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে ক্লাস টেন পর্যন্ত পাঠ্যবইতে যা যা শেখা দরকার সে শিখবে। এভাবে শিক্ষাকে সমন্বিত করা যায়। মানে জিরো প্লাস থেকে প্রাইমারি বলেন বা প্রি-প্রাইমারি বলেন বা ক্লাস টেন পর্যন্ত ওইসব জিনিস শিক্ষা দেবো, যা একজন নাগরিককে জানতে হয়। নীতিনৈতিকতা, ধর্ম, সংস্কৃতি, পৌরনীতি, ভূগোল সবকিছুর যতটুকু দেয়া যায়। এটা আমাদের সব পক্ষের শিক্ষবিদরা বসে বের করতে পারেন। কেমব্রিজেও বাংলাদেশ স্টাডিজ রয়েছে। এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা করা যায় কি না ভাবা যেতে পারে যে, প্রত্যেকেই সিঙ্গেল শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যাবে। এসেনসালি তিনটি জিনিস শিখতে হয়- একটা ভাষা, হিসাব করা বা অঙ্ক এবং বিজ্ঞান বা লজিক। ভাষা হিসেবে তিনটি ভাষা শিখতে হবে। বাংলা, ইংরেজি ও আরবি। ভারতে যেকোনো রাজ্যে জন্মগ্রহণ করলে আপনাকে কমপক্ষে চারটি ভাষা শিখতে হয়, কিন্তু আমাদের দেশে-তো অতগুলো ভাষা নেই। তিনটি ভাষার মধ্যে আরবি শিখলে ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কে তার জ্ঞান মজবুত হবে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন এলাকায় চাকরিতে তার সুবিধা হবে। আর ইংরেজি শেখার মধ্য দিয়ে সে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠতে পারবে। বাংলা-তো মাতৃভাষা হিসেবে শিখতেই হবে। এসব ভাষা কতদূর পর্যন্ত শেখাবো তা বিশেষজ্ঞরা বের করবেন।
দশম শ্রেণীর পর দুই বছরের ডিপ্লোমা কোর্স প্রয়োজন। যারা যে বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষায় যাবে, তার সেই বিষয়ে এ ডিপ্লোমা কোর্সে প্রিলিমিনারি কোর্স করবে। যারা উচ্চতর শিক্ষায় যাবে না, তাদের ডিপ্লোমা কোর্সে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে ওয়ার্কিং হ্যান্ড বানানো হবে। তার মানে আপনি নাগরিক পাচ্ছেন, আদর্শবান মানুষ পাচ্ছেন, টেকনেশিয়ান পাচ্ছেন। যারা উচ্চশিক্ষায় যাবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কেউ রসায়ন, কেউ ফিকাহ, কেউ অর্থনীতি; যে যার সাবজেক্টে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত পড়তে পারবে। সবাইকে তো উচ্চশিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন নেই। টাইম ও এনার্জি পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে লাগাতে হবে। এজন্যে সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থায় আমাদের একমত হতে হবে। ইগোস্টিক হলে চলবে না। বিদেশে গিয়ে নৌকাডুবিতে মারা যাবে না অন্তত কেউ। রাষ্ট্রীয়ভাবে সে প্রশিক্ষণ পেয়ে দক্ষ জনবল হিসেবে সম্মানের সাথে কাজ করতে পারবে। রাজনৈতিক দলের জন্যে এটা করা খুবই কঠিন। কারণ ক্ষমতায় গেলে রাজনৈতিক দল বলতে পারে হুজুররা তো এটা মানছে না। অভিভাবকরা বলবে আমার ছেলেমেয়ে অক্সফোর্ডে পড়বে। রাজনৈতিক দল তখন বলবে ঠিক আছে আস্তে আস্তে যাও, নেক্সট ইলেকশন পর্যন্ত দেখা যাক কী হয়, অপেক্ষা করো। শেষ পর্যন্ত সংস্কার হবে না। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত সন্তানরা যাতে সম্পদ হয়ে গড়ে উঠতে পারে। আর যোগ্য নাগরিক হিসেবে সে এ দেশের ও বিশ্বের জন্যে এসেনসিয়াল হয়ে গড়ে উঠতে পারে, কিন্তু লেখাপড়ায় ছেলেমেয়েরা আগাতে পারছে না আমাদের একমত না হওয়ার জন্যে। দেখেন বুয়েটের ছেলেরা বিদেশে গিয়ে রোবটিক্সে আন্তর্জাতিক মানের কাজ করছে। আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারপর মডেল স্কুল করে পাঠদান করতে হবে। ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ওয়ার্কশপ করে প্রডাক্ট চালু করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : তার মানে শিক্ষাব্যবস্থায় গাইডেন্সটা অন্তত এ সরকার দিয়ে যাতে পারে?
কর্নেল আশরাফ : হ্যাঁ, সেটা দিলে অন্তত রাজনৈতিক বাধাগুলো থাকবে না। কারণ এ সরকার অরাজনৈতিক সরকার।
নয়া দিগন্ত : বাংলাদেশ এখন একটা ক্রান্তিকালে আটকে গেছে। দীর্ঘদিন আপনি বিস-এ কাজ করেছেন। গবেষণা পরিচালক ছিলেন। কোনো একটা দেশের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। কৌশলগত দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশের কি প্যারাডাইম শিফটের প্রয়োজন? অনেকে বলছেন তা না হলে দেশ নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে, আপনি কি মনে করেন?
কর্নেল আশরাফ : জ্ঞানটা হচ্ছে চর্চার জিনিস। চর্চা করলেই এটা বাড়তে থাকবে। আর এর অসাধারণ প্লাটফরম বলতে পারেন থিংকট্যাংক, কিন্তু বিনয়ের সাথে বলবো এ দেশে অনেকে থিংকট্যাংকের কনসেপ্ট সম্পর্কে বুঝে না। এমনকি অনেক রাজনৈতিক দলও বুঝে না। ওরা মনে করে আচ্ছা ঠিক আছে অমুককে বলে দেবে, তিনি একটা আর্টিকেল লেখে দেবেন ইত্যাদি। আসলে বিষয়টা তা নয়। এটা অনেকটা জ্ঞান উৎপাদনের একটা জায়গা। চাপিয়ে দেয়ার কোনো বিষয় না। এটা গবেষণার বিষয়। গবেষণা যে যতটুকুই করুক না কেন, কিছু ঘাটতি থেকে যায়, গবেষণায় সেই ঘাটতি খুঁজে বের করে তা পূরণ করতে নতুন কিছুর সন্ধানে এ গবেষণা অব্যাহত রাখতে হয়। আপনি যদি ইনোভেটিভ কিছু দেন সেটাও যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হবে। আপনি যদি বলেন পলিসি ম্যাটারস বা সিকিউরিটি ম্যাটারস- এগুলোতো সাঙ্ঘাতিক জরুরি। থিংকট্যাংক ইকোনোমি, থিংকট্যাংক ল’য়ের, স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ বা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ওপর হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর থিংকট্যাংক আছে বলে আমার মনে হয় না। পতিত সরকার যেমন থিংকট্যাংকের নামে পয়সার জোরে প্রপাগান্ডা করেছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মানুষ তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। আবার বড় বা ছোট দলগুলো যে আছে তাদের গবেষণার একটা জায়গা আছে বলে আমার মনে হয় না। রাষ্ট্র যখন একটা দিকে অগ্রসর হবে, রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে প্রশাসন, প্রতিরক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ে দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে কিছু লোকের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। আপনাকে তাদের সাহায্য নিতে হবে। ইভেন ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের ওপর গবেষণা জরুরি; কারণ একটা ফ্লাইওভার করে ফেললাম, পরে দেখা গেলো এক স্থানের জ্যামকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া হলো শুধু লাভ কিছুই হলো না। সলিউশনটা পেতে হবে। দুঃখের বিষয় এ ধরনের কিছু এর আগের সরকার চায়নি। গবেষণার নামে হাবিজাবি কাজ করা হয়েছে। এখন উদ্যোগটা সরকারকেই নিতে হবে। এটা নিতে হবে নাগরিকদের মধ্যে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক পক্ষ থেকে। থিংকট্যাংক ইজ নট পলিটিক্যাল ম্যাটার। থিংকট্যাংক হবে স্টাডি। যেমন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান একবার বিদেশ থেকে এসে বললেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে আমরা কী করতে পারি।
বিস-এ এসব নিয়ে ধারাবাহিক সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও ওয়ার্কশপ হলো। আর সার্কের একটা প্রপোজাল তৈরি করে প্রেসিডেন্টকে দেয়া হলো। ভারত ও পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের জন্যে সার্ক কার্যকর হচ্ছে না, কিন্তু তারপরও কাজ-তো হয়েছে। অনেক কাজ হয়েছে। তো থিংকট্যাংক হওয়া দরকার পলিটিক্যাল পার্টি, ননপলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন; যারা দেশের জন্যে ভালো কাজ করতে চায়; উপকার করতে চায় তাদের নিয়ে। যদি ভালো লোকেরা ভালো কাজে এগিয়ে না আসে তখন ওই জায়গাটা ধান্ধাবাজরা দখল করে নেয়। তখন দেখা যাবে অন্য দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হচ্ছে। শত্রু রিলিজিয়াসলি সিরিয়াস। এখন আমি যদি আমার দেশের নিরাপত্তা কিভাবে নিশ্চিত হবে, আমার শিক্ষা কিভাবে সমৃদ্ধ হবে, এগুলো নিয়ে গবেষণা না করি, থিংকট্যাংক তৈরি না করে জায়গা খালি রেখে দিলাম, ওই জায়গা দখল করে নিবে শত্রুরা। তাই আমাদের একটা না; একাধিক থিংকট্যাংক থাকবে, গবেষণা করবে, গবেষকদের সহায়তা দিলে গবেষক তৈরি হবে। ইরাক যুদ্ধের সময় শতাধিক থিংকট্যাংকের দিকনির্দেশনা নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আমাদের-তো এতগুলো থিংকট্যাংক নেই। আমাদের প্রচুর থিংকট্যাংক দরকার। প্রচুর মানুষ চিন্তা করবে গবেষণা করবে এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল কাজে লাগাবে এক্সিকিউটিভ বডি। এখন সরকার যদি মনে করে সবই সে বুঝে তাহলে অনেক সময় কাজ করা কঠিন হয়ে যায়। যে বিশ্বের মধ্যে আপনি আছেন যেসব দেশের সাথে আপনি ডিল করতে যাচ্ছেন; সবাই কিন্তু চিন্তাভাবনা করে কাজ করছে। সবার থিংট্যাংক আছে, চিন্তাভাবনা করার মানুষ আছে, সবার মেধাবী লোক আছে। আপনি যদি স্লেøাগান নিয়ে চলেন, জোশের মধ্যে চলেন, একধরনের প্রোটোটাইপ চিন্তা নিয়ে চলেন-তো আপনি ধরা খেয়ে যাবেন, আপনি মার খেয়ে যাবেন।
নয়া দিগন্ত ডেস্ক : অন্তর্বর্তী সরকার অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করেছে, যেগুলো সংস্কারের জন্য সুপারিশও দিয়েছে। কিন্তু এ সরকার-তো ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে চলে যাবে। ভবিষ্যতে এসব সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো গ্যাপ দেখতে পান কি অথবা পরবর্তীতে সংস্কার বাস্তবায়ন না হলে কী ধরনের পরিণতি হতে পারে? আসলে জাতি হিসেবে আমাদের কোন দিকে যাওয়া উচিত, কী করা উচিত?
কর্নেল আশরাফ : বর্তমান পরিস্থিতি একটা ইউনিক পরিস্থিতি। একটা অসাধারণ পরিস্থিতি। পতিত সরকার লুটপাট করে সব ইনস্টিটিউশনকে করাপ্ট করে বরবাদ করে চলে গেছে। একটা নির্বাচিত সরকারের পক্ষে এ পরিস্থিতিতে দেশ চালানো কঠিন; কিন্তু অনির্বাচিত সরকার এসেছে, তার আসার কথা নয়; কিন্তু আমরা বলবো এটা একটা ব্লেসিং। ছাত্র-জনতার স্মার্ট অ্যাকশনের জন্যে এটা হয়েছে; কিন্তু বয়স্করা পদ ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন না। সব রাজনৈতিক দল যদি ভাঙা নৌকা দিয়ে ঘাট দখল করে রাখতে চায়, তাহলে তো চলবে না। আব্রাহাম লিংকনের দাড়ি যখন কালো ছিল তখন তিনি দেশ শাসন করেন। মুরব্বিদের উচিত অভিভাবক পরিষদ গঠন করে পরামর্শ দিয়ে তরুণদের নেতৃত্বে ঠেলে দেয়া। এ ছাড় দিতে বয়স্করা রাজি না। এটা কিন্তু ইউরোপের অনেক দেশে ঘটছে। ইউরোপের চারটি দেশে ৩২ থেকে ৩৫ বয়সের চারজন প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চল্লিশ বছর বয়সে জিয়াউর রহমান বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলেন ভাবুন। এখন-তো তারেক রহমানের বয়স তার চেয়েও বেশি। নেতৃত্বকে ভাইব্র্যান্ট অবস্থায় থাকতে হয়। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তরুণ নেতৃত্বকে পথ চলার জন্যে পরামর্শ দিয়ে ছেড়ে দিতে হবে, পথ আগলে রাখলে চলবে না। হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলবেন, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের রসায়ন ভিন্ন। সেখানকার ইনস্টিটিউশনগুলো ভেঙে পড়েনি; পেন্টাগন রয়েছে। অজস্র থিংকট্যাংকের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করছেন বয়স্ক নেতারা। আমাদের দেশে অনেক বয়স্ক রাজনীতিবিদ তরুণদের নিয়ে ঠাট্টা করেন, এ বাচ্চারা তোমরা কী বুঝ? বাচ্চারা কিছু বুঝেন না, কিন্তু আমরা বয়স্করা-তো কিছু করতে পারিনি। আমরা শুধু কর্মসূচি দেবো, কর্মসূচি দেবো করেছি। তারপর ২৪-এর নির্বাচন হয়ে গেলে ফের পাঁচ বছরের অপেক্ষার শুরুর মধ্যে তরুণরা যা ঘটানোর ঘটিয়ে ফেলল। তাই বয়স্কদের কৌটিল্যের ভূমিকায় থাকতে হবে। তাদের চেয়ারে বসতে হবে, চিন্তা করতে হবে এবং তরুণ নেতৃত্বকে দিকনির্দেশনা দিতে হবে; তাহলে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হবে। দেশটার অবস্থা-তো ভালো না। কোনো সেক্টরের অবস্থা ভালো না। দেশের মানুষ সহনশীল এবং আবেগপ্রবণ। তাদের ভুল পথে নেয়ার জন্যে স্লেøাগান দেয়া হলে-তো হবে না। দেশে কোনো পাহারাদার নেই।
আমরা সবাই মিলে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মতো এ সরকারকে সহায়তা করতে পারলে কাজ হতো। দেশটার নেতৃত্ব তরুণদের হাতে ছেড়ে দিলে সমস্যা কোথায়? অন্য দেশ যদি পারে তাহলে আমরা কেন পারবো না। আমাদের দেশেও অতীতে তরুণ নেতৃত্ব দেখিয়ে দিয়েছে। যাদের বয়স ৫৫ বছর হয়ে গেছে; তাদের বরং পিছিয়ে আসা উচিত। তাদের স্টেজ থেকে নিচে নেমে আসা উচিত। তারা অভিভাবক হিসেবে থাকবেন। তরুণদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি তাদের অসাধারণ সম্ভাবনা। আমরা আসলে তাদের সম্ভাবনাকে ্অ্যাসেস করতে পারছি না। তরুণদের সাথে দ্বন্দ্বে না গিয়ে কেন আমরা অবসর নিচ্ছি না। সরকারি চাকরি থেকে বা অন্য কোনো জব থেকে অবসর নেয়া গেলে রাজনীতি থেকে অবসর নেয়া যাবে না এটা কেমন কথা! এটা করা উচিত। আমি সারা জীবন একটা পদ আঁকড়ে রাখলাম, এটা গুরুত্বপূর্ণ না, জরুরি হচ্ছে- দেশের মানুষের সুখ-সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা। আমার শত্রুরা-তো দাঁড়িয়ে আছে। শত্রুরা-তো বয়স্কদের ডিফিট করার জন্যে তৈরি। শুধু তরুণরা বুদ্ধির জোরে দেশটাকে একটু তুলে ধরেছে। আর শত্রুরা একটু ব্যাকফুটে চলে গেছে। তরুণদের সহযোগিতা না করে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করলে-তো সর্বনাশ হবে। এ মাইন্ডসেট তৈরি করাও সহজ নয়। নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে, দলীয়ভাবেও সংস্কার প্রয়োজন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে আসছেন পলিটিক্সে, এটা হলো? আপনার সব সম্ভাবনা শেষ করে রাজনীতিতে আসছেন কেন? জনগণ যদি কোথাও বিপদে পড়ে আর আমি যদি নেতা হই- আমাকে সবার আগে দৌড়ে যেতে হবে। সবাই কি আমার জন্যে রাস্তা ছেড়ে দেবে না কি আমি দৌড়ে ওদের আগে যাবো। আপনি তরুণদের পথ ছেড়ে দেন।
নয়া দিগন্ত : জাতীয় নিরাপত্তার জন্যে সরকারের কোন কোন বিষয়ের ওপর জোর দেয়া দরকার। বিশেষ করে মিয়ানমারে যে অস্থিরতা, আমাদের পাহাড়ে যে অনিশ্চয়তার কথা বলা হচ্ছে, ফেনী থেকে সাগর পর্যন্ত একটা নেক রয়েছে, উত্তরবঙ্গে কিছু সংবেদনশীল এলাকা রয়েছে, সামগ্রিকভাবে নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশের কী ধরনের লক্ষ্য নিয়ে আগানো উচিত?
কর্নেল আশরাফ : বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌ ও বিমানবাহিনী, কোস্টগার্ড বা প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলো হচ্ছে নিরাপত্তার মেরুদণ্ড। এ মেরুদণ্ডের ওপর আমরা নিজেরা আঘাত করবো না, অন্য কাউকে আঘাত হানতে সুযোগ দেবো না। সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য হিসেবে বলি আমাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, মোটিভেটেড করা হয়েছে, প্রয়োজনে দেশের তরে জীবন দেয়ার জন্যে। আমাদের ধর্মগ্রন্থ কুরআন মজীদ নিয়ে শপথ দেয়া হয়েছে এ দেশকে ভালোবাসার জন্যে। এখনো এতকিছু ঘটে যাওয়ার পর এ দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনী ওই ধরনের মোটিভেশনের মধ্যেই আছে; কিন্তু দুষ্ট রাজনীতিবিদ বা একনায়ক অথবা স্বৈরশাসক তারা চায় সবকিছু দখল করে নিতে। পনেরো বছর দীর্ঘ সময়। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পিতা- আরেক স্বৈরাচার শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যে দেশটাকে যুদ্ধ করে স্বাধীন করেছে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন রক্ষীবাহিনী; ভারতীয় জেনারেল উবানের সহযোগিতায়। আমাদের যারা সম্ভাব্য শত্রু হতে পারে তারা আমাকে পরামর্শ দিচ্ছে, আমার আত্মরক্ষার জন্যে, তো ডাল মে কুচ কালা হ্যায়। এবার যা হয়েছে শুরুতেই পার্টি ক্যাডারকে ইউনিফর্ম পরিয়ে দেয়া হয়েছে। ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। পনেরো বছর দীর্ঘ সময়। সেতো পনেরো বছরে মোটামুটি ভালো সিনিয়রিটিতে চলে গেছে। তারপরও আমি বলবো এ দেশের সবাইকে তারা কিনতে পারেনি। সবাইকে নষ্ট করতে পারেনি। উপরের দিকে হয়তো আপনি কাউকে সন্দেহ করতে পারেন, কিছু জিনিস প্রমাণ করতে পারেন; কিন্তু নিচের দিকে বা যারা সৈনিক আছে তারা কিন্তু ভূমিপুত্র। এরা এ মাটির সন্তান। এবারো শতরকমের আদেশের পরেও তারা মানুষের বুকে গুলি চালায়নি। আমরা শুনেছি পুলিশের পোশাক পরে, এবং বিজিবির পোশাক পরে ভারতীয়রা গুলি করেছে। বুলেট থেকে প্রমাণ পাওয়া গেছে; কিন্তু এ জিনিসটা আর্মির ইউনিফর্ম পরে কেউ করেনি। তাই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মর্যাদাকে রক্ষা করতে হবে। অনেকে সেনাবাহিনীকে নিয়ে ট্রল করেন। এদেরকে আন্ডারমাইন্ড করেন। ডিফারেন্টস অব ওপিনিয়ন করেন। মানুষের ভালোবাসা যেন তাদের প্রতি না থাকে, এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়। সেনাবাহিনীর প্রতি সহানুভূতি নষ্ট হোক এটাই আমাদের শত্রুরা চায়। আমাদের শত্রুরা চায় আমাদের নির্ভরতা যেন সেনাবাহিনীর ওপর না থাকে। সেনাবাহিনীকে নিয়ে সন্দেহপ্রবণতা তৈরি করতে চায়। ইয়েস যদি কেউ করাপ্ট হয় তার পানিশমেন্ট হচ্ছে। কেউ সেনাবাহিনীতে চিরদিন থাকবে না। আজকে যিনি সেনাপ্রধান বা বিমানপ্রধান আছেন কাল-তো তিনি থাকবেন না। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এতটাই সচেতন যে কেউ এসে উল্টোপাল্টা কিছু কমান্ড দেবে এ সাহস কারো নেই। তাই সেনাবাহিনীকে নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকা উচিত নয়। গত পনেরো বছরে অনেক কিছু করার চেষ্টা করা হয়েছে। একটা উদাহরণ দেই- স্যালুট দেয়ার সময় আমরা মুখে উচ্চারণ করি আসসালামু আলাইকুম স্যার। এটা প্রশিক্ষণের অংশ ছিল; কিন্তু পতিত স্বৈরাচারের সময় এ অংশটুকু বাদ দেয়া হয়। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে-তো একটা পাখি থেকে রূহটা নিয়ে নেয়ার মতো হবে। সালাম হচ্ছে আমার আত্মপরিচয়। এভাবে সেনাবাহিনীকে করাপ্ট করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু সেনা অফিসাররা ও সেনা সদস্যরা এ দেশেরই মাটির সন্তান। আমরা অনেক ভাই। তাদের কাউকে হয়তো কেউ করাপ্ট করতেই পারে; সে জেলখানায় চলে যেতে পারে; তাকে কেউ মেরে ফেলতে পারে। আপনি জানেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশ্বজুড়ে একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে আমরা সেটি ইনহেরিট করেছি, আবার স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের পরাজিত করেছি। সুতরাং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যে স্ট্যান্ডার্ড যে, মোটিভেশন ইট ইজ অ্যাবসুলিউট। আমরা-তো বলি আমাদের মরাল স্কাই হাই। আকাশের সমান উচ্চতা আমাদের নৈতিকতার। আমরা কাউকে ভয় পেয়ে কাজ করি না।
এটা কি ভারত, না অন্য, যে পরিচয় হোক না কেন, সমীকরণটা হচ্ছে ভারত আমার প্রতিবেশী। শত্রুও না; বন্ধুও না। প্রতিবেশী প্রতিবেশীই। প্রতিবেশীর সামনে আমার পলিসি ফরমুলেট করতে হবে এমনভাবে যাতে সম্মান নিয়ে তার সাথে টিকে থাকতে পারি। ইয়েস কিছু কিছু ক্ষেত্রে বড় ভাই হিসেবে তাকে সম্মান দেখাতে হবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাকেও তিনি সম্মান দেখাবেন; কিন্তু সবকিছুই তার, আর আমি সব সময় নতজানু হয়ে থাকব এটা হলো না। আর দুনিয়াও আগের মতো নেই। সেনাবাহিনী নিয়েও সমস্যা নেই। আমাদের সাথে ভারতের চার হাজার কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত আছে। ভারতের সীমান্তে-তো আরো দেশ আছে, চীন আছে, মিয়ানমার আছে, পাকিস্তান আছে, আফগানিস্তান আছে, ভারতের ওদের সাথেও-তো সম্পর্ক রাখার ব্যাপার আছে। আমি যদি সব দেশের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখি, তা-হলে থ্রেটটা ডিস্ট্রিবিউশন হয়ে যায়। ভারতের বিশাল সেনাবাহিনী। আমি ভারতে আর্টিলারিতে প্রশিক্ষণের জন্যে গিয়েছিলাম। দীর্ঘ সময় প্রায় ১৪ মাস ছিলাম। আমাদের আর্মির চেয়ে তাদের আর্টিলারি সাইজ বড়; হতেই পারে; কিন্তু ওদের সব আর্টিলারি কি আমাদের বর্ডারে এসে থাকবে। ওদেরকে-তো আর্টিলারি বিভিন্ন বর্ডারে ডেসিমিনেট করতে হবে। তো আমার বর্ডারে ওদের আর্টিলারির যেটুকু দেবে তা মোকাবেলা করার জন্য বাংলাদেশের সেনাবাহিনী প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং জনগণ এনাফ, নট এনাফ মোর দেন এনাফ। আপনি মিয়ানমারের কথা বলছেন। ওদেরকে হয়তো চীন সমর্থন দেবে। তার মানে এই নয় যে, লেজ গুটিয়ে চলে আসতে হবে। টেরেইনের একটা ব্যাপার আছে, পাহাড়ি এলাকার যুদ্ধ, নদী ও খালের যুদ্ধ, সাগরের যুদ্ধ এ সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী একটা নিজস্ব অবস্থানে আছে, যেটা আমাদের ইকুয়েপমেন্ট দিয়ে, আমাদের অন্যদের সাথে সম্পর্ক দিয়ে ইটস কোয়াইট ওয়েল ব্যালান্সড। এটা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। চট করে কেউ এসে ঢুকে পড়ে কিছু করে ফেলবে ইটস নট ইজি। ভারতও এখন বুঝে গেছে বাংলাদেশের অবস্থা হয়ে গেছে দিয়াশলাইয়ের মতো, দিয়াশলাইয়ের একটা কাঠি ঘষা দিলেই ফস করে আগুন জ্বলে উঠবে। ভারত কোনো সীমান্ত দিয়ে যদি তার বিশাল একটি বাহিনী পাঠিয়ে দেয় হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব, ধ্বংসযজ্ঞ করা সম্ভব; কিন্তু এ দেশকে দখল করে স্থায়ী হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব না। ভারত এটা ভালো করেই বুঝে, তারা চীনের কাছে মার খেয়েছে, পাকিস্তানের কাছে ’৭১ ছাড়া সবখানেই মার খেয়েছে, সুতরাং ভারত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একেবার জিতে যাবে এবং দখল করে নেবে অবলীলায় এ ধরনের ভয়ভীতির মধ্যে থাকার কোনো কারণ-ই নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা