২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০ ফাল্গুন ১৪৩১, ২৩ শাবান ১৪৪৬
`
ডিপ্লোম্যাটের প্রতিবেদন

জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন হাসিনার আন্তর্জাতিক বৈধতাকে দুর্বল করবে

-


জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধে শেখ হাসিনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা উন্মোচিত হয়েছে। যা সম্ভবত আওয়ামী লীগের সাথে ভারতের সম্পর্ককে জটিল করে তুলবে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির বিশ্লেষক মুবাশ্বার হাসান দ্য ডিপ্লোম্যাটে এক প্রতিবেদনে বলেছেন জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনের ফলাফল আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনার ভাবমূর্তি এবং বৈধতাকে আরো কলঙ্কিত করবে, যার ফলে তার এবং তার নেতৃত্বাধীন দল আওয়ামী লীগের বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন আরো কঠিন হয়ে উঠবে।
প্রতিবেদনে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে প্রাক্তন নেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি এবং কমান্ডিং ভূমিকা উন্মোচিত হয়েছে। স্পষ্টভাবে বিক্ষোভের সময় গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য হাসিনার শাসনকে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, হাসিনা এবং তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ব্যক্তিগতভাবে নৃশংস নিরাপত্তা অভিযানের সমন্বয় করেছিলেন। অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সতর্কীকরণ সত্ত্বেও, হাসিনা পথ পরিবর্তন করতে অস্বীকৃতি জানান এবং সহিংস দমন-পীড়নের জন্য সরাসরি আদেশ জারি করেন।
জাতিসঙ্ঘের এই প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, কারণ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের সদস্যদের আশ্রয় দেয়ার ন্যায্যতা প্রমাণ করা ভারতের পক্ষে ক্রমান্বয়ে কঠিন হয়ে উঠতে পারে, যাদের অনেকেই বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত।
এই গতিশীলতার সাথে, আওয়ামী লীগ এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্ক দুর্বল হতে শুরু করার সম্ভাবনাও রয়েছে। ভারতের জন্য, আওয়ামী লীগ এবং হাসিনাকে সমর্থন করে খুব বেশি লাভ নেই যখন তারা বাংলাদেশে আর ব্যাপক জনসমর্থন উপভোগ করছে না। বরং বর্তমান সরকার এবং অন্যান্য দলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে ভারতের আরো অনেক কিছু লাভ করার আছে।

এই প্রতিবেদনটি বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যপূর্ণ এবং ভারতের জন্য এর প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, প্রতিবেদনটি হাসিনার প্রশাসন কর্তৃক সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের জন্য ইউনূস সরকারের একটি সুপরিকল্পিত কৌশল তুলে ধরে। ইউনূস সম্ভবত স্বীকার করেছিলেন যে হাসিনার নেতৃত্বে জুলাই-আগস্ট বিদ্রোহের প্রতি বাংলাদেশী রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়ার ওপর অভ্যন্তরীণ তদন্ত বিদেশে উল্লেখযোগ্য মনোযোগ আকর্ষণ করবে না। অতএব জাতিসঙ্ঘকে তদন্তের জন্য আমন্ত্রণ জানানো ছিল হাসিনার ভূমিকা সম্পর্কে বৃহত্তর তদন্ত এবং আন্তর্জাতিক সচেতনতা নিশ্চিত করার জন্য একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।
দ্বিতীয়ত, জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনটি এখন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) ব্যবহার করবে, যা হাসিনা এবং ১১ জন প্রাক্তন মন্ত্রীসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দু’টি মামলা প্রস্তুত করছে। প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ‘জাতিসঙ্ঘের অনুসন্ধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টের নৃশংসতা পূর্বপরিকল্পিত অপরাধের অংশ ছিল এবং শেখ হাসিনার নির্দেশে এগুলো সংঘটিত হয়েছিল।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) যেকোনো সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক সমালোচনার বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই প্রতিবেদন ব্যবহার করবে বলেও আশা করা হচ্ছে।

তৃতীয়ত, এই প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিকভাবে হাসিনার বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরো ক্ষুণœ করবে। যদিও তিনি তার নির্দেশে সংঘটিত অপরাধের জন্য অনুতপ্ত নন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে শিগগিরই তা ঘটবে না। লাখ লাখ বাংলাদেশী তরুণ হাসিনাকে ভয় পায় কারণ তারা তার কঠোর হাতে পরিচালিত শাসনামলে বেড়ে ওঠে, যা জোরপূর্বক নিখোঁজ, বিচারবহির্ভূত হত্যা অথবা সমালোচনা করার জন্য হাজার হাজার মানুষকে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিল। তারা তার প্রত্যাবর্তনকে প্রতিরোধ করবে। জুলাই-আগস্টের বিদ্রোহে আওয়ামী লীগ তার ভূমিকা নিয়ে বিভক্ত। আওয়ামী লীগের এই কঠোর পদক্ষেপের সমালোচকরা তার প্রত্যাবর্তনের বিরোধিতা করবেন।
প্রতিবেদন অনুসারে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট, ২০২৪ সালের মধ্যে, বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে ‘বিতর্কিত কোটাব্যবস্থা’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে ছাত্রদের নেতৃত্বে বিক্ষোভের ফলে ভিন্নমতের ওপর এক অভূতপূর্ব দমন-পীড়ন দেখা গেছে। প্রতিবেদনে বিশদভাবে বলা হয়েছে হাসিনার সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী এবং সরকারপন্থী নজরদারি গোষ্ঠীগুলোর সাথে সমন্বয় করে, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের ওপর সহিংস দমনের আশ্রয় নিয়েছিল। তাতে ১,৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যককে হত্যায় নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু। এ ছাড়াও ১১,৭০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেফতার এবং আটক করা হয়েছে। স্বীকারোক্তি আদায় বা ভিন্নমত পোষণকারীদের ভয় দেখানোর জন্য নির্যাতন, যার মধ্যে রয়েছে মারধর, বৈদ্যুতিক শক এবং মৃত্যুদণ্ডের হুমকি।
বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ এবং সেনাবাহিনী এই হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সশস্ত্রবাহিনী গোয়েন্দা অধিদফতর এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা বিভাগের মতো গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ছাত্রনেতাদের জোরপূর্বক গুম করার ক্ষেত্রে পুলিশের সাথে সহযোগিতা করেছিল।

প্রতিবেদনে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য গোপন করার জন্য হাসিনা সরকারের চরম প্রচেষ্টার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। বিক্ষোভ কভার করা সাংবাদিকদের হত্যা করা হয়েছে, আহত করা হয়েছে এবং নির্বিচারে গ্রেফতার করা হয়েছে, যার ফলে সহিংস দমন-পীড়নের বিষয়ে স্বাধীনভাবে রিপোর্ট করা সম্ভব হয়নি।
এ ছাড়াও ইন্টারনেট এবং সোসাল মিডিয়া কৌশলগতভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, বিক্ষোভকারীদের সংগঠিত হওয়ার ক্ষমতা বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল এবং জনসাধারণকে উদ্ভূত সঙ্কট সম্পর্কে রিয়েল-টাইম তথ্য অ্যাক্সেস করতে বাধা দেয়া হয়েছিল। নিরাপত্তা বাহিনী হাসপাতালগুলোতেও অভিযান চালিয়েছিল, আহত বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করেছিল এবং চিকিৎসাকর্মীদের ভয় দেখিয়েছিল, জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসাসেবা কার্যকরভাবে বাধাগ্রস্ত করেছিল এবং নৃশংসতার প্রমাণ মুছে ফেলা নিশ্চিত করেছিল।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারীদের ওপর হাসিনা সরকারের দমন-পীড়ন মানবতাবিরোধী অপরাধের সমতুল্য হতে পারে। মানবাধিকার সংস্থার ভাষায়, এই গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইনের দৃষ্টিকোণ থেকেও উদ্বেগের সৃষ্টি করে, যাতে আরো ফৌজদারি তদন্তের প্রয়োজন হয়, যাতে নির্ধারণ করা যায় যে এগুলো কতটা মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিপন্থী।

 


আরো সংবাদ



premium cement