২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ২১ শাবান ১৪৪৬
`
হত্যা করে প্রতিবাদীদের নির্মূল করার নির্দেশনা

হাসিনার কলরেকর্ড ট্রাইব্যুনালে

গণহত্যা-মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় শেখ হাসিনা, কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত ২ মাসে শেষ করার নির্দেশ
-


জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের সময় পরিচালিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে আরো দুই মাস সময় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আগামী ২০ এপ্রিলের মধ্যে তার বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। অন্য দিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৫ জনের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলারও ২০ এপ্রিলের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।

গতকাল চেয়ারম্যান বিচারপতি মো: গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো: শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো: মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
সব ছাত্র-জনতাকে নির্মূল করার নির্দেশনা : শুনানির একপর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, কে কী করেছে সেটি আমাদের কাছে আছে। কেরামুন কাতেবিন যেভাবে সব কিছুর রেকর্ড করেন; সেভাবে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট আমাদের হাতে রয়েছে। শুনানি শেষে ব্রিফিংয়ে এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ মামলাতে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হবে ডিজিটাল তথ্যপ্রমাণ। ডিজিটাল তথ্যপ্রমাণ, অপনারা জানেন যে ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বলে একটি জিনিস আছে। আমরা এসব ডিজিটাল এভিডেন্স পেয়েছি এমন, তারা বিভিন্ন জায়গায় যেসব কথা বলেছেন। গণহত্যার জন্য যেসব নির্দেশাদি দিয়েছেন। সেসব নির্দেশাবলি যে তাদের টেলিফোনিক অর্ডারের মাধ্যমে গিয়েছে। তাতে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে সব ছাত্র-জনতাকে নির্মূল করার কথা বলা হয়েছে। সব টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের কথোপকথন যে তারা করেছেন। তাদের অজ্ঞাতেই সেটি রেকর্ডেড হয়েছে। সেগুলো আমাদের হাতে আসছে। আমরা যেটা বুঝি, যেটা আপনাদের বলতে পারি মানুষকে মারার জন্য যে ফাঁদ তারা পেতে ছিলেন। সেই ফাঁদে হয়তো তারাই পড়তে যাবেন।

এ সময় শেখ হাসিনার সরকারের সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, ড. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, শাজাহান খান, উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, কামাল আহমেদ মজুমদার, সাবেক সচিব মো: জাহাঙ্গীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন।
অন্য দিকে এ মামলায় গ্রেফতার থাকা সাবেক সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ঢাকা-৭ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সোলায়মান সেলিমকে গণহত্যার মামলায় ২০ এপ্রিল ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। অন্য দিকে আদালতে সব আসামির পক্ষে ওকালতনামা জমা দেন সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না।

মার্চেই শেখ হাসিনার মামলার তদন্ত প্রতিবেদন, এপ্রিলে বিচার প্রক্রিয়া : দু’টি মামলার শুনানিতে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, রিপোর্টের বর্তমান স্ট্যাটাসে কোন পর্যায়ে তদন্তটা আছে, সেটি আদালতে বলেছি। আমরা আশা করি আগামী মাসের মধ্যে বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেটা, সেটার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা সম্ভব হতে পারে বলে আশা করছি। এটা কোনো ফাইনাল টাইমলাইন নয়।
তদন্ত রিপোর্টে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন অন্তর্ভুক্ত হবে : চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আমাদের তদন্ত রিপোর্টের মধ্যে জাতিসঙ্ঘের রিপোর্ট ন্যাচারালি অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আশা করছি। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনের উপাদানগুলো চেয়েছি, অনুরোধ করেছি। সেগুলো সংগ্রহের একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। যতটুকু পাওয়া যাবে, সেটিকে তদন্ত প্রতিবেদনে সংযুক্ত করব। এটি মামলা প্রমাণের জন্য বড় এভিডেন্স (প্রমাণ) হিসেবে কাজ করবে। এ জন্য দুই মাসের সময় চেয়েছিলাম। আদালত ২০ এপ্রিল পরবর্তী তারিখ রেখেছেন। এ সময়ের মধ্যে যাতে তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যায়। আমরা আশা করছি এর আগে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে পারব। আমরা তদন্তের একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। আশা করছি খুব শিগগিরই এসব রিপোর্ট আমাদের হাতে চলে আসবে।

তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে তাজুল ইসলাম বলেন, আমরা তদন্তের একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছি। আশা করছি খুব শিগগির এসব রিপোর্ট আমাদের হাতে চলে আসবে। তিনি বলেন, এটি অসম্ভব জটিল ও কঠিন কাজ। এ জন্য আমরা দিনরাত কাজ করছি। আশ করছি দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করতে সক্ষম হব। তিনি আরো বলেন, তদন্তের জন্য যত টাইম লাগবে আমরা তা গ্রহণ করব। আমরা যদি তাড়াহুড়া করি তাহলে তদন্তে যাদি কোনো ত্রুটি থাকে এবং সে ত্রুটির ফাঁক দিয়ে আসামিরা বেরিয়ে যায় তাহলে জাতির কাছে আমরা দায়বদ্ধ থাকব।
ত্রুটিহীনভাবে তদন্ত রিপোর্ট তৈরি করতে সময়টা নিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, মার্চ মাসের মধ্যে যদি তদন্ত রিপোর্ট পেয়ে যাই, সে ক্ষেত্রে এপ্রিলের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক পর্বটা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাজুল ইসলাম বলেন, জাসিংঘের কাছ থেকে তাদের রিপোর্টটি চাওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় নিহত বা আহতদের শরীর থেকে যেসব বুলেট অপসারণ করা হয়েছে সেগুলো বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে জব্দ করা হয়েছে এবং ফরেনসিক করার কাজ চলমান আছে। আন্দোলনের সময় কোন ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সে ব্যাপারে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তথ্য ও জাতিসঙ্ঘের তদন্তের তথ্যে মিল আছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা গণশুনানি করছেন, সেখানে শত শত ভিকটিম আসছেন এবং তাদের মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ফার্স্ট হ্যান্ড রিপোর্টগুলো তদন্তকারীদের দিয়েছেন।
জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনটি আমাদের তদন্ত রিপোর্টের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে বলে আমরা মনে করেছি। আমরা জাতিসঙ্ঘের কাছে চেয়েছি তারা যেসব ম্যাটেরিয়ালের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেগুলো পাওয়ার ব্যাপারে আমরা তাদের কাছে অনুরোধ জানিয়েছি। সেগুলো আমরা সংগ্রহের একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। যতটুকু পাওয়া যাবে তা আমরা তদন্ত রিপোর্টের সাথে সংযুক্ত করব। জাতিসঙ্ঘ বিশ্বের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক সংগঠন। যাদের বাংলাদেশের কারো পক্ষে পলিটিক্যাল পক্ষপাতিত্বের কোনো কারণ নেই। তারা যেহেতু গণহত্যার ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট রিপোর্ট দিয়েছে। এটি আমাদের মামলা প্রমাণে একটি বড় এভিডেন্স হিসেবে কাজ করবে।

এ কারণে আমরা দুই মাস সময় চেয়ে ছিলাম। আদালত ২০ এপ্রিল পরবর্তী তারিখ নির্ধারণ করেছেন। এ সময়ে তদন্ত রিপোর্ট যাতে পাওয়া যায় সেটি বলেছেন। আমরা বলেছি এ সময়ের আগেই আমরা তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করতে পারব। আদালত তাড়াহুড়া করতে গিয়ে তদন্ত রিপোর্ট যাতে ক্রটিপূর্ণ না হয়, সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে বলেছেন।
এর আগে মঙ্গলবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে প্রিজনভ্যানে করে তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
গত ১৭ ডিসেম্বর জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত দুই মাসের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

 


আরো সংবাদ



premium cement