২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮ ফাল্গুন ১৪৩১, ২১ শাবান ১৪৪৬
`

ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে উত্তাল তিস্তা অববাহিকা

পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে হেঁটে তিস্তা পারাপার হাজারো মানুষের
-


মঙ্গলবার বেলা সাড়ে বারোটা। তিস্তার হাঁটুপানিতে দাঁড়িয়ে জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের শিয়াল খোয়া এলাকার বাসিন্দা আতিয়ার রহমান। কাছে গিয়ে জানতে চাইলেই চোখগুলো বড় বড় হয়ে উঠল তার। জানালেন, ‘আগে হামার বাড়ি আছিল কালীগঞ্জের ভোটমারি ইউনিয়নোত। বাপের কাছ থাকি ২০ বিঘা জমি ভাগোত পাচনু বাহে। এলা মুই বউ ছাওয়া ধরি থাকুম চলবালা ইউনিয়নের শিয়াল খোয়াত। হামার অন্য শরিকরা অন্য জায়গা গেইচে। আগোত প্রত্যেক দিন হামরা কামলা নিচনো। এলা মুই মাইনষের বাড়িত কাম করি বেরাম। তিস্তা মোড় সবকিছু কারি নিচে বাহে। ইন্ডিয়া হামার তিস্তার উজানত ও বান্দ বান্ধিয়া ওমার ওতি পানি নিয়া গেইচে। আর হামরা গুলা শুকানোত মইরতেছি। তোমরা যদি তিস্তাত পানি আনি দিবার পান আর খুড়ি দিয়া দুই পাড় বান্ধি দেন। তাহইলে মোর জমিগুলা উদ্ধার হইবে, আবাদ করি খাবার পাইনো হয় বাহে। হামার হয়া ইউনুসেক এই কথাটা এক না কন।’

তার মত তিস্তার শীর্ণজীর্ণ শরীরে পারাপার হচ্ছিলেন হাজারো মানুষ। নদীতে যে সামান্য পানি আছে তাতে কোথাও হাঁটু কোথাও হাঁটুর নিচে। পারাপারকারীদের হাতে হাতে প্ল্যাকার্ড। তাতে লেখা, জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই। তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা চাই। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন চাই। ভারতীয় পানি আগ্রাসন বন্ধ করো করতে হবে। লাখো মানুষের মুখে মুখে একই স্লোগান। জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই স্লোগানে গগনবিদারী আওয়াজ যেন উজানে যাচ্ছিল তীব্র গতিতে। এমন দৃশ্য গতকাল দিনভর ছিল রংপুরের গঙ্গাচড়ার মহিপুর তিস্তা সড়ক সেতু এলাকার। পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করা এবং বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই স্লোগানে ৪৮ ঘণ্টার লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির এই আয়োজন করে তিস্তা নদীর রক্ষা আন্দোলন। সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল থেকে শুরু হওয়া এই অবস্থান কর্মসূচি শেষ হবে আজ। একই সাথে এই জনতার সমাবেশ ও জমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। তিস্তা অববাহিকার নীলফামারীর ডালিয়া ব্যারাজের পশ্চিমে, ডালিয়াবেড়িতের পূর্ব পাশে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধায়, রংপুরের মহিপুর তিস্তা সড়ক সেতুর দুই পাশে, লালপরীর হাটের মহিষ খোচায়, সদরের তিস্তার রেলওয়ে সেতু পয়েন্টে, কুড়িগ্রামের রাজারহাটের সরিষাবাড়ি ঘড়িয়াল ডাঙ্গা, উলিপুর পাকারমাথা থেতরাই এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুর তিস্তা সড়কসেতু পয়েন্ট।

তিস্তার হাঁটুপানিতে আরো কথা হয় রংপুরের গঙ্গাচড়ার শঙ্করদহ গ্রামের বয়োবৃদ্ধা আকলিমা খাতুনের সাথে। তিনিও এসেছিলেন এই অবস্থান কর্মসূচিতে। জানালেন, ‘ইন্ডিয়ার রাজারা ভালো নোয়ায় বাবা। ওমরা নদীর উজানত বান্দ বান্ধিছে। হামার দিকি তিস্তা শুকি মরি গেছে। নল্যিকোনাতোএখন আর পানি নাই। বাবা হামরা যেদিন শ্বশুরবাড়িতে আসি। দেখি বড় বড় কুকুর আঁচিল। গইল ভর্তি গরু আঁচিল বাবা। বাড়িত ধানের গোলা ভরি গেছিল। খুলিত বড় বড় ফলের ফুল আঁচিল। মেলা জমি জমা আঁচিল। ভাঙি দিয়ে গেছে বাহে এই তিস্তা। এলা হামরা ভিক্ষা করি খাই। একদিন মুই এমন বাড়িত গেছনু, যাইয়া দেখোম মুই যাক ভিক্ষা দিচনু। কী হতভাগা কপাল হামার। তোমরা গুলা না ব্যবস্থা করি দাও। আমার খুঁড়ি দাও। পানি আনি দেও বাহে।’

আতিয়ার এবং আকলিমার মতো লাখো মানুষ জড়ো হয়েছিল অববাহিকার ২৪২ কিলোমিটার দীর্ঘ দুই পাড়ের এগারোটি পয়েন্টে। রাত দিন ২৪ ঘণ্টা এখানে অবস্থান করেন তারা। প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে শুধু শামিয়ানা দিয়ে টাঙানো তাঁবুর ভিতরেই রাত কাটে তাদের। অংশ নেন সমাবেশ, সেমিনার মানববন্ধন, পদযাত্রা, গণযাত্রা, গান, কবিতা, অভিনয় এবং স্মৃতিচারণে। মগ্ন হয়ে উঠেছিলেন হাডুডু দাঁড়িয়াবান্ধা ফুটবলসহ হারিয়ে যাওয়া নানা খেলাধুলায়।
তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন।
আয়োজক সংগঠন তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক আসাদুল হাবিব দুলু জানিয়েছেন, নীলফামারীর ডিমলার ছাতনাই থেকে শুরু করে রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম হয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ পর্যন্ত তিস্তা অববাহিকার দুই পাড়ের ৩৬০ কিলোমিটার অববাহিকা জুড়ে এই কর্মসূচিতে লাখ লাখ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তারা রাতদিন সেখানে অবস্থান করছেন।

দুলু বলেন, প্রতিটি পয়েন্টে আন্দোলনের অংশ হিসেবে গণ পদযাত্রা, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন, ঘুড়ি উড়ানো, ভাওয়াইয়া, পালা, জারি, সারি গান পরিবেশন ও নাটক মঞ্চায়ন হয়। এ ছাড়া তিস্তা পাড়ের মানুষদের অংশগ্রহণে হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধাসহ ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে তুলে ধরা হয় ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে মরা খালে পরিণত হওয়া তিস্তা অববাহিকার লাখ লাখ মানুষের জীবন এবং জীবিকা নিয়ে দুর্দশার চিত্র।
দুলু বলেন, এই কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিস্তার পানির ন্যায্য হিসাব এবং মহা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের বিশ্বমত তৈরি করতে পেরেছি। আমরা আশা করছি এই সরকারের আমলেই মহা পরিকল্পনার কাজ শুরু হবে। বাঁধ নির্মাণের নামে বিচ্ছিন্নভাবে আর কোনো স্থায়ী প্রকল্প করা যাবে না। পাশাপাশি সরকার জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তিস্তার ন্যায্য হিস্যা আদায়ে কাজ শুরু করবেন।

প্রথম দিন সোমবার কর্মসূচিতে বিভিন্ন পয়েন্টে অতিথি হিসেবে যোগ দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু, নির্বাহী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, গয়েস্বর চন্দ্র রায়, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি জেপির সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দারসহ বিএনপির জাতীয় নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন, তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের নেতাকর্মী, নদী বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। অন্যদিকে গতকাল সব কয়টি পয়েন্টে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ ছাড়াও নীলফামারীর ডালিয়া ব্যারাজের পশ্চিম পাশে এবং লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা পয়েন্টে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য বাবু গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, রংপুর ও লালমনিরহাটের মহিপুর সড়ক সেতুর দুই পয়েন্টে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব:) হাফিজ উদ্দিন বীর বিক্রম উপস্থিত থাকবেন।

পরিসংখ্যান বলছে, তিস্তার দুই তীরে ২৪২ কিলোমিটার এবং ৩৬০ কিলোমিটার অববাহিকায় এখন হাহাকার অবস্থা। বর্ষা মৌসুমে দু’কূল ছাপিয়ে তিস্তা হয়ে ওঠে রুদ্রমূর্তি। বন্যায় ক্ষতবিক্ষত হয় জমিজমা ও মানুষ। শুকনো মৌসুমে দেখা যায় মরুর উত্তাপ। বালুকাময় হয়ে ওঠে অববাহিকার প্রান্ত। প্রতি বছর তিস্তা অববাহিকার দুই পাড়ে ২০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়। প্রতি বছর ক্ষতি হয় এক লাখ কোটি টাকারও বেশি। এ কারণে উত্তরের অর্থনীতি পঙ্গু। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের পাশাপাশি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তিস্তা নদী ঘিরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ফিরে আসবে এই অঞ্চলে। পাশাপাশি এই অঞ্চলের দুই কোটি মানুষের জীবনজীবিকা জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশ রক্ষা হবে হলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।


আরো সংবাদ



premium cement