১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬ ফাল্গুন ১৪৩১, ১৯ শাবান ১৪৪৬
`

সরকারের দ্বিতীয় পর্ব শুরু

প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সাথে বৈঠকে রাজনৈতিক দলের নেতারা : নয়া দিগন্ত -

- ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা
- ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কৃতজ্ঞ থাকে এমন সংস্কার চাই

অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার প্রস্তাব চাপিয়ে দেবে না উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কারটা যেন এমনভাবে হয় যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। রাজনৈতিক দলের নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সংস্কার যদি আমরা সঠিকভাবে করতে পারি, তা হলে বাংলাদেশ জাতি হিসেবে যত দিন টিকে থাকবে তত দিন আপনাদের অবদান থেকে যাবে।’ দীর্ঘমেয়াদে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের আইনি কাঠামো তৈরির জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কার প্রক্রিয়া সঠিকভাবে এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা।
গতকাল শনিবার বিকেলে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের শুরুতে অধ্যাপক ইউনূস এসব কথা বলেন। গতকাল প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান ড. ইউনূসের সভাপতিত্বে কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় নাগরিক কমিটি, এলডিপি, এবি পার্টি, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফতে মজলিস, লেবার পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ, গণঅধিকার পরিষদ, জাতীয় গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ১২দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, গণফোরাম, আমজনতার দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ ২৬টি দল ও জোট অংশ নেয়।

প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যের শুরুতে জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহত যোদ্ধাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘আজকে আমাদের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে। আপনারা দ্বিতীয় পর্বের স্রষ্টা। আপনারা সংস্কার সুপারিশগুলো জাতির সামনে নিয়ে আসবেন। আপনাদের সহযোগিতা করার জন্য কমিশনের সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন। আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করুন, যেন আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজে নেমে পড়তে পারি। নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠিত হবে কেউ যেন তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে না পারে।’
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশগুলো সুবিবেচনাপ্রসূত ইঙ্গিত করে ড. ইউনূস আরো বলেন, ‘দেশের ঐক্য ও বিদেশের সমর্থন বিবেচনা করে সংস্কার কমিশন সুপারিশ নিয়ে এসেছে। (এটা) মূল্যবান সম্পদ। এই সম্পদ বাংলাদেশের ইতিহাসে রক্ষিত হবে। সবাই মিলে পরামর্শ দেন কোনগুলো বাস্তবায়ন করবো। নীতিমালা বানিয়ে দিলে স্বচ্ছভাবে দেশ চলতে থাকবে। কলকাঠি নাড়ানো ছাড়া যে একটা দেশ নিয়মের মধ্যে চলতে পারে, সেটাই আমাদের করতে হবে’।

সরকার সংস্কার প্রস্তাব চাপিয়ে দেবে না উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংস্কারটা যেন এমনভাবে হয় যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তাদের জায়গা থেকে ভালো কিছু দেয়ার চেষ্টা করেছেন। এখান থেকে কতটুকু গ্রহণ করবো, কীভাবে অগ্রসর হবো এর জন্য আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করা। কোনটা কাজে লাগাতে পারব, কোনটা গ্রহণ করব। আপনারা জনগণের প্রতিনিধি, তাই আপনাদের সঙ্গে এ নিয়ে একটা বাস্তবভিত্তিক আলোচনা হতে হবে। এমন মজবুতভাবে আইনকানুন করব, যাতে সবাই মেনে চলে এবং মেনে চলার মাধ্যমে একটা সুন্দর সমাজ তৈরি করা যায়। তিনি বলেন,‘আমাদের পক্ষ থেকে সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি। চাপানোর ক্ষমতা আমাদের নেই। আমরা কেবল বোঝাবো কেন প্রয়োজন এবং কীভাবে করা যায়। বাকিটা আপনাদের কাজ। একটু রদবদল করলে দেখবেন সুন্দর হয়ে যাবে। আমরা কেবল সাচিবিক কাজ করে দিবো।’
সরকারের প্রথম পর্বে (৬ মাস) দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমর্থনের কথা উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, ‘প্রথম পর্বের একটা অভিজ্ঞতা হলোÑ সরকার দেশের জনগণের ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের সমর্থন দুটোই পেয়েছে। সারা পৃথিবীজুড়ে আমাদের প্রতি বড় রকমের সমর্থন গড়ে উঠেছে। যে কারণে অপর পক্ষ (ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী সরকার) সুবিধা করতে পারছে না, বহু গল্প বানানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো গল্প টিকাতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে গিয়েও গল্প চালাতে পারল না। ছোট রাষ্ট্র, বড়, মাঝারি এবং ধনী সকল রাষ্ট্র আমাদেরকে সমর্থন করছে। কারোর কোনোরকম দ্বিধা নেই।’

তিনি বলেন, কোনো রাষ্ট্রের প্রধানের সঙ্গে যখন আমরা কথা বলি, তখন তারা বলে আপনাদের কী লাগবে। আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। একটি দেশের সরকার প্রধানের সঙ্গে এর চেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলা আর কী হতে পারে। তারা এ পর্যন্ত আমাদেরকে মেনে নিয়েছে এবং ক্রমাগতভাবে তাদের সমর্থন বেড়ে চলেছে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিকÑ এই দুই সমর্থন পাওয়ার পরও যদি আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে না পারি, সেটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের হবে। আমরা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না।
সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিক মহল আমাদেরকে বলে যে তোমাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করতে পারি কিন্তু সংস্কারটা তোমাদের করতে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সমর্থন, সহযোগিতা এবং তাদের শুভেচ্ছা আমাদের জন্য মস্ত বড় সম্পদ। আমরা তাদেরকে বহু রকমের স্বপ্নের কথা বলেছি, তারা বলেছে তোমরা করতে পারলে আমাদের সমস্যা নেই। কোনো কোনো শক্তিশালী দেশ আমাদেরকে বিশেষভাবে সহায়তা করতে চায়। তাই বলছি, সংস্কার সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যর্থ হতে চাই না।
প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ করে আরো বলেন, যে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার সুযোগ পেয়েছিল সেই কাঠামো থেকে যেন আমরা অন্যরূপে বেরিয়ে আসতে পারি। হা-ডু-ডু খেলার ক্ষেত্রে আইন মেনে চললেও দেশটাকে একটা তামাশায় পরিণত করা হয়েছিল। আইন বলে কিছু নেই, নিয়ম বলে কিছু ছিল না। জুলাই বিপ্লবে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তারা নির্দেশ দিয়ে গেছেন আমরা যেন সেই আইনকানুন বাদ দিয়ে নতুন বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হই। কী আইন প্রয়োজন হবে সেগুলো মাথায় রেখে সংস্কার কমিশন করা হয় এবং কমিশনে যারা ছিলেন তারা তাদের কাজটি করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে আমরা যদি আমাদের ঐক্যের সুযোগ কাজে লাগাতে পারি, তাহলে সেটি বংশপরম্পরায় চলতে থাকবে। মসৃণভাবে সংলাপ চালিয়ে নেয়ার জন্য তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা এক লণ্ডভণ্ড অবস্থার মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এই ৬ মাসের অভিজ্ঞতা হলো, দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক ব্যক্তি সবাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তা দিয়েছে। আমাদের মধ্যে অনেক তর্কবিতর্ক আছেÑ তবে আমাদের মধ্যে ঐক্য আছে এবং এটি বজায় থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
আগামীতে আইন-কানুন এবং সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনে শতভাগ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, নির্বাচনে কেউ জিতলে পরাজিত বা অন্যরা আর সন্দেহ করবে না। ভাববে না যে কলকাঠি নেড়ে কাউকে জিতিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশ মানে নতুন নির্বাচন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার গঠন হবে তার ব্যাপারে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। সেটার ব্যাপারে আইনকানুন সবার জানা থাকবে, এটা নড়চড় করার উপায় কারো থাকবে না। আইনকানুন বানানোর পরে সেটা নড়চড় করার সুযোগ থাকবে নাÑ সেজন্যই এত বড় কমিশন করতে হয়েছে। তিনি বলেন, এই যে আইন-কানুন, নীতিমালা বানিয়ে দেবো, একবার বানিয়ে দিলে তারপর থেকে চলতে থাকবেÑ একটা ট্র্যান্সপারেন্ট খেলা হবে।

জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সরকারের দেশের মানুষের ওপর চালানো নির্মম নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘের এই প্রতিবেদন হলো আমাদের প্রতি বিদেশীদের আর একটা সমর্থন। এখন কারোর বানানো বয়ান আর কেউ শুনবে না, ওইটা চূড়ান্ত। আর কত সমর্থন চাই আমরা, একেবারে অক্ষরে অক্ষরে তারা বলে দিয়েছে কাকে কোথায় মারা হয়েছে। এর থেকে বের হওয়ার তো কারোর উপায় নেই। বাংলাদেশকে ঘিরে যে অপপ্রচার চলছিলÑ এই প্রতিবেদন তা বন্ধ করে দিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সরকারের প্রথম ৬ মাসের কথা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যারা আমাদেরকে ব্যাহত করার চেষ্টা করেছে, তাদেরকে ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পেরেছি। দ্বিতীয় পর্বেও এই হাঙ্গামা হবে। যাদেরকে বাংলাদেশের মানুষ তাড়িয়ে দিয়েছে, অস্বীকার করেছে ও ত্যাগ করেছে, তারা ফিরে আসার জন্য অত্যন্ত ব্যাকুল। সে জন্য আমাদের শক্ত থাকতে হবে, মজবুত থাকতে হবে। একত্রে থাকতে হবে।

স্বৈরাচারী সরকারের গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, মানুষ কতটা নির্মম হতে পারে, নৃশংস হতে পারেÑ এর চেয়ে বড় নমুনা মনে হয় আর পাওয়া যাবে না। আমাদের দেখতে কষ্ট লেগেছে, কিন্তু যারা এখানে বছরের পর বছর কাটিয়েছে তাদের প্রতিটি বণর্না ও অভিজ্ঞতা গুম কমিশনের রিপোর্টে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিজ্ঞা করি আমরা যেন গণ-অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের প্রতি অসম্মান না জানাই। যে কারণে তারা আত্মত্যাগ করেছিল সেটা যেন পরবর্তী সব প্রজন্ম মনে রাখে, তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে, তাদের আত্মত্যাগকে সার্থক করার জন্য আমরা সবাই মিলে সবরকম চেষ্টা করবো তাদের স্বপ্ন যেন বাস্তবায়ন করতে পারি।


আরো সংবাদ



premium cement
তামাক চাষের নীতিমালা প্রণয়নে কাজ করছে সরকার: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা রমজানে মুসলিম কর্মীদের এক ঘণ্টা আগে ছুটি তেলঙ্গানায়, আপত্তি বিজেপির খালেদা জিয়াকে প্রতীকী ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত : ব্যারিস্টার সালাউদ্দিন আইন করে আ’লীগকে নিষিদ্ধ করা হোক : আবু হানিফ রাজনৈতিক হয়রানির লক্ষ্যে খালেদা জিয়াকে আসামি করা হয়েছে শাহপরী দ্বীপে ২ লাখ পিস ইয়াবাসহ আটক ৭ পাকুন্দিয়ায় যুবকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার চকরিয়ায় মাতামুহুরী নদী থেকে ভাসমান যুবকের লাশ উদ্ধার উদ্বোধনী ম্যাচে আগে ব্যাট করবে নিউজিল্যান্ড আত্মহত্যার চেষ্টা করা জবি শিক্ষার্থীর মৃত্যু হাটহাজারীতে বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে ব্যাংক কর্মকর্তা নিহত

সকল