৩৬৯ ফিলিস্তিনির বিনিময়ে ৩ ইসরাইলির মুক্তি
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫৬
- গাজায় ‘রেডিমেড’ বাড়ি প্রবেশে ইসরাইলের বাধা
- ফিলিস্তিনি বন্দীদের শার্টে বর্ণবাদী চিহ্ন
যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে গতকাল শনিবার আরো ৩৬৯ জন কারাবন্দীকে মুক্তি দিচ্ছে দখলদার ইসরাইল। বিনিময়ে তিন ইসরাইলি বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে গাজা উপত্যকা নিয়ন্ত্রণকারী স্বাধীনতাকামী রাজনৈতিক সংগঠন হামাস। যুদ্ধবিরতি চুক্তির আওতায় বন্দিবিনিময়ের ষষ্ঠ ধাপে দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসের একটি জায়গা থেকে তাদের মুক্তি দেয়া হয় বলে জানিয়েছে আলজাজিরা। ইসরাইলি কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত ৩৩৩ জন ফিলিস্তিনি বন্দীকে বহনকারী বাসের একটি বহর দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসে পৌঁছেছে।
অন্য দিকে ইসরাইলি মুক্তিপ্রাপ্তরা হলেন- আয়ার হর্ন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের দ্বৈত নাগরিক সাগুই ডেকেল-চেন এবং রাশিয়া ও ইসরাইলের দ্বৈত নাগরিক আলেকসান্দ্রে সাশা ত্রোফানভ। হামাসের সামরিক বিভাগ আল কাসসাম ব্রিগেড এবং ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের সহায়তা প্রদানকারী সংস্থা প্যালেস্টাইনিয়ান প্রিজনার্স মিডিয়া অফিসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শনিবার মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের মধ্যে ৩৩৩ জনই গাজার বাসিন্দা। বাকি ৩৬ জন যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত।
যেভাবে বন্দীদের মুক্তি : শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টার দিকে গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনুসে সাশা ত্রোফানভ, সাগুই ডেকেল-চেন এবং আয়ার হর্নকে সাদা রঙের গাড়িতে নিয়ে আসে হামাসের সামরিক বিভাগ আল কাসসাম ব্রিগেডের একটি দল। সেখানে একটি অস্থায়ী মঞ্চ আগে থেকেই প্রস্তুত করা ছিল, আর সেই মঞ্চকে ঘিরে ছিল শতাধিক ফিলিস্তিনি জনতা।
মঞ্চে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা সংস্থা রেডক্রসের প্রতিনিধিদের কাছে বন্দীদের হস্তান্তর সম্পর্কিত নথিতে স্বাক্ষর করেন হামাসের এক জ্যেষ্ঠ সদস্য। তারপর বন্দীদের সেই মঞ্চে তোলা হয় এবং উপস্থিত ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশে কিছু বলার অনুরোধ জানানো হয়। বন্দীদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষ হওয়ার পর রেডক্রসের গাড়িতে তাদেরকে রাফা ক্রসিং এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলেন আইডিএফ এবং ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা শিন বেটের কর্মকর্তারা। রেডক্রসের প্রতিনিধিরা কর্মকর্তাদের হাতে বন্দীদের সোপর্দ করেন। তারপর আইডিএফের গাড়িতে চেপে ইসরাইলে প্রবেশ করেন তিন বন্দী।
এর আগে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দিবিনিময় স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিল হামাস। এরপর গাজায় আবারো যুদ্ধ শুরুর হুমকি দেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। সীমান্তে সেনা ও সামরিক সরঞ্জামও বাড়াতে থাকে ইসরাইল। এ অবস্থায় মধ্যস্থতাকারী দেশ মিসর ও কাতারের হস্তক্ষেপে চুক্তি মেনে বন্দিমুক্তি দিতে রাজি হয় হামাস। এরপরই তিন ইসরাইলি বন্দীকে মুক্তি দেয় সংগঠনটি।
বন্দীদের শার্টে বর্ণবাদী চিহ্ন : এ দিকে ইসরাইলি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ফিলিস্তিনি বন্দীদের ‘স্টার অব ডেভিড’ লোগোযুক্ত পোশাক পরতে বাধ্য করার অভিযোগ এনেছে হামাস, যাতে আরবি ভাষায় লেখা ছিল ‘আমরা ভুলব না বা ক্ষমা করব না’। হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘আমরা আমাদের বীর বন্দীদের পিঠে বর্ণবাদী স্লোগান লাগানো এবং তাদের সাথে নিষ্ঠুরতা ও সহিংসতার সাথে আচরণ করার দখলদার বাহিনীর অপরাধের নিন্দা জানাই, যা মানবিক আইন ও নিয়মের স্পষ্ট লঙ্ঘন।’
মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি : গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ইসরাইলের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে নিহত ও আহতের সংখ্যা সম্পর্কে তাদের সর্বশেষ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, শেষ ৪৮ ঘণ্টায় গাজার হাসপাতালে মোট ২৫ জন নিহত এবং নয়জন আহত হয়েছেন। এর ফলে ৭ অক্টোবর ২০২৩ সাল থেকে ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা কমপক্ষে ৪৮ হাজার ২৬৪ জনে দাঁড়িয়েছে, আহতের সংখ্যা আরো এক লাখ ১১ হাজার ৬৮৮ জন বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো বিপুলসংখ্যক মানুষ চাপা পড়ে আছে এবং গাজার সরকারি গণমাধ্যম অফিস মৃতের সংখ্যা ৬১ হাজারের বেশি বলে জানিয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ হাজার হাজার মানুষকে এখন মৃত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাড়ি প্রবেশে বাধা : ১৫ মাস ধরে চলা ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা দৃশ্যত বিরান ভূমিতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ সময় পর যুদ্ধবিরতি চললেও এখনো মানবেতর দিন কাটছে গাজাবাসীর। ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ির ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই তাঁবু বানিয়ে বাস করছেন তারা। যুদ্ধবিরতির শর্তাবলি অনুযায়ী অস্থায়ীভাবে বাস করা অনেক ঘরবাড়ি মিসরের সীমান্তে আনা হলেও ইসরাইলের বাধায় এখনো গাজায় ঢুকতে পারেনি। গাজায় প্রবেশের জন্য এসব ঘরবাড়ি ইসরাইলের অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার দুই সপ্তাহ পার হলেও ইসরাইল মাত্র ৪ শতাংশ প্রয়োজনীয় তাঁবু প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে এবং কোনো ক্যারাভানই প্রবেশ করতে দেয়নি। একই সাথে তারা এখনো ধ্বংসস্তূপ অপসারণে প্রয়োজনীয় ভারী যন্ত্রপাতির প্রবেশ নিষিদ্ধ করে রেখেছে। গাজায় আনুমানিক ১৪ হাজার নিখোঁজ ব্যক্তি রয়েছে, যাদের অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চুক্তি অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রবেশের অনুমতি পাওয়া তেলবাহী ট্রাকের মাত্র ৫ শতাংশ গাজায় ঢুকতে পেরেছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া ৩০টিরও বেশি হাসপাতাল পুনর্গঠনের কোনো অনুমতি এখনো মেলেনি। এ ছাড়া আটটি তুর্কিয়ে ফিল্ড হাসপাতালসহ বেশ কিছু চিকিৎসাসুবিধা মিসরীয় শহর আরিশে সংরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, কারণ ইসরাইল সেগুলোর প্রবেশে অনুমোদন দেয়নি। যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে প্রতিদিন ১৫০ জন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য বের হতে দেয়ার কথা থাকলেও ইসরাইল প্রতিদিন মাত্র ৪৪ জনকে অনুমতি দিয়েছে। এমনকি কিছু আহত ব্যক্তি রাফাহ সীমান্তে অপেক্ষারত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে।
এটা স্পষ্ট যে, ইসরাইল ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে এবং দুর্দশাপূর্ণ পরিস্থিতি অব্যাহত রাখতে চায়, যাতে তারা মানবিক সঙ্কটকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে যুদ্ধাপরাধের শামিল। দুই মিলিয়ন গাজাবাসী এখনো গণহত্যা ও ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া ভোগ করছে। তাদের জন্য আশ্রয় নিশ্চিত করাটা অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আঞ্চলিক দেশগুলোর উচিত ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে তারা মানবিক সহায়তার প্রবেশে বাধা না দেয় এবং এই ইস্যুকে ইসরাইলি সরকারের বর্ণবাদী লক্ষ্য থেকে দূরে রাখা যায়।
আঞ্চলিক শক্তিগুলোরÑ বিশেষ করে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর এখানে বড় ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। যদিও তারা অনেক সহায়তা পাঠিয়েছে, তার কিছু অংশ গাজায় প্রবেশ করলেও বেশির ভাগই আটকে রয়েছে। এ জন্য এসব দেশের উচিত ইসরাইলের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি করা, যাতে সহায়তা প্রবেশের অনুমতি পাওয়া যায় এবং পরবর্তী আলোচনার পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
ফিলিস্তিনিদের মানবিক অধিকার হরণ এবং যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সম্মত আশ্রয়সামগ্রী প্রবেশে বাধা দেয়া গাজার পরিস্থিতিকে আরো ভয়াবহ করে তুলবে। এটি মূলত চরমপন্থী ইসরাইলি ডানপন্থীদের পরিকল্পনার অংশ, যা গাজার জনগণকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করার পথ প্রশস্ত করতে পারে। জাতিসঙ্ঘের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গাজা উপত্যকার ধ্বংসযজ্ঞকে ‘একটি বিশাল ভূমিকম্পের’ সাথে তুলনা করে বলেছেন, একটি অব্যাহত ‘মানবিক বিপর্যয়’ এড়াতে প্রচেষ্টা চালানো উচিত।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা