বিচারের মুখোমুখি করতে হাসিনাকে ফেরত চায় বিএনপি
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০৫

জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনের পর শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট প্রমাণিত হওয়ায় বিচারের মুখোমুখি করতে ভারত সরকার অবিলম্বে তাকে বাংলাদেশের কাছে ফেরত দেবে এমন আশা করছে বিএনপি।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এমন প্রত্যাশার কথা জানান। তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘের যে পর্যবেক্ষণ কমিটি এসেছিলেন, তাদের যে রিপোর্ট, সেই রিপোর্টকে আমরা ধন্যবাদ জানাতে চাই। তারা সঠিকভাবে বলেছেন যে, একজন ব্যক্তি, বিশেষ করে ফ্যাসিস্ট হাসিনার নির্দেশেই সব হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে। যে গণহত্যা হয়েছে, তার নির্দেশে হয়েছে এবং যত মানবাধিকার লঙ্ঘন যা কিছু হয়েছে, সব তার নির্দেশে এখানে হয়েছে। গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দেয়া, ইনস্টিটিউশনগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া- এগুলো যে তার নির্দেশেই হয়েছে- সেটাই রিপোর্টে ফুটে উঠেছে।
মির্জা ফখরুল বলেন, এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, হাসিনা একজন ফ্যাসিস্ট এবং তিনি এ দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার করেছেন, নির্যাতন করেছেন, হত্যা করেছেন। আমরা আজকে এখান থেকে তাই বলছি, অবিলম্বে ভারত সরকার তাকে ফেরত দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের হাতে দেবে এবং তাকে ও তার সহযোগী যারা ছিল তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এটাই হচ্ছে আমাদের প্রত্যাশা।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ায় আমরা স্বস্তি প্রকাশ করছি যে, সত্য যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলো আজকে উদঘাটন হয়েছে। সমস্যাটা হচ্ছে যে, জাতিসঙ্ঘ যখন বলে, তখন আমরা সেগুলো সবাই বিশ্বাস করি। যখন আমরা রাজনৈতিক দলগুলো বলি, তখন অনেকেই বিশ্বাস করতে চায় না।
এর আগে সেখানে বিএনপি মহাসচিবের সাথে বৈঠক করেন ঢাকাস্থ যুক্তরাজ্যের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার জেমস গোল্ডম্যান। বেলা ১১টার দিকে তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে পৌঁছান। প্রায় এক ঘণ্টা বৈঠক শেষে গোল্ডম্যান চলে যান। মির্জা ফখরুলের সাথে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, এটা পূর্বনির্ধারিত বৈঠক। আজকে আবার কাকতালীয়ভাবে ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক আমাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে লন্ডনে দেখা করবেন। কিছুক্ষণ পরই মিটিং হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, ব্রিটিশ হাইকমিশনার নেই, সেজন্য ডেপুটি এসেছেন। আমাদের মধ্যে রুটিন আলোচনা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অবস্থা, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন সেগুলোর সম্পর্কে এবং কবে নির্বাচন হচ্ছে প্রভৃতি বিষয়গুলো সম্পর্কে তারা জানতে চেয়েছেন। বৈঠকের পর জেমস গোল্ডম্যান সাংবাদিকদের সাথে কোনো কথা বলেননি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, গুম হওয়া, হত্যা করা- এটা শুধু পার্টিকুলার কোনো দল নয়, এখানে (আয়নাঘরে) বাংলাদেশের মানুষকে গুম করা হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে নির্মমভাবে। এই কথাগুলো আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি। যখন আয়নাঘরের রিপোর্টটা বের হয় আল-জাজিরাতে, আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, তখন কিন্তু এটা সরকার পুরোপুরি ডিনাই করেছিল। তারা বলেছিল যে, এই ধরনের কিছু নেই। কিন্তু প্রথম থেকেই এই কাজগুলো হচ্ছিল।
মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ওই সময় অত্যন্ত সচেতনভাবে বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য তারা বিরোধী দলকে ধ্বংস করেছে।
জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচার চেয়ে ট্রাইব্যুনালে বিএনপি : জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংস করার জন্য গণহত্যা চালানো হয়েছিল উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সারা দেশে ৮৪৮ বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকেরা মৃত্যুবরণ করেছে। এতে জেলা ও মহানগরভিত্তিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের তালিকাসহ মোট ৮৪ মামলার এজাহারের কপি দাখিল করা হয়।
গতকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবরে সকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের স্বাক্ষর করা এই অভিযোগ জমা দেয়া হয়। বিএনপির মামলা, গুম, খুন ও তথ্য সংরক্ষণবিষয়ক সমন্বয়ক মো: সালাহউদ্দিন খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ন্যায়বিচার চেয়ে এই অভিযোগ জমা দেয়।
অভিযোগে গণ-অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ ৫৩৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বিএনপির অভিযোগে দেখা যায়, জেলাভিত্তিক সবচেয়ে বেশি শহীদের সংখ্যা ঢাকায় ১০২ জন। এ ছাড়া ময়মনসিংহে ৪১ জন, কুমিল্লায় ৩৮ জন এবং ভোলায় ৪৩ জনের নামের তালিকা জমা দেয়া হয়েছে।
অভিযোগে বলা হয়, গত বছরের ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা দেশে প্রতিবাদ গড়ে তোলে। বিএনপির সব জেলা, মহানগর, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রামপর্যায়ে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের প্রতিবাদে ও অবৈধ দুর্নীতিবাজ সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করার জন্য শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ, সমাবেশ ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে। বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দলকে চিরজীবনের জন্য নিশ্চিহ্ন করার জন্য স্বৈরাচার সরকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ১৪ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের রাজাকারের নাতি বলে সম্বোধন করেন। গত ২৯ জুলাই তারিখে শেখ হাসিনার নির্দেশে ১৪ দলের মিটিংয়ে গণহত্যার পরিকল্পনা করে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন যে, বৈষ্যম্যবিরোধী আন্দোলনকে দমন করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ঠ। এর ধারাবাহিকতায় গত জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ সমাবেশ ও কর্মসূচির ওপর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তার মন্ত্রী পরিষদ, কিছু আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ক্যাডাররা, কিছু আমলা, কিছু গোয়েন্দা সংস্থা, কিছু পুলিশ বাহিনীর সদস্য, কিছু বিজিবি ও আনসার বাহিনীর সদস্যসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা মিলে বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ, ধারালো অস্ত্র দ্বারা আঘাত, টিআর শেল, হ্যান্ড গ্র্যানেড, বোমা, ককটেলসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা আঘাত করে দুই হাজারের বেশি লোকজনদের হত্যা করে।
মো: সালাহ উদ্দিন খান বলেন, ৮৪৮ শহীদের মধ্যে ৫২৪ জন সরাসরি বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা ও কর্মী। অপর ৩২৪ জন শহীদ বিএনপি সমর্থক। আমরা ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই অভিযোগ দায়ের করেছি।
এর আগে গত ৯ জানুয়ারি ২০০৮ সাল থেকে গত বছরের ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে দুই হাজার ২৭৬ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যা এবং ১৫৩ জনকে গুমের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে দাখিল করে বিএনপি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা