৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ উদ্ধারে নামছে বেসিক ব্যাংক
- আশরাফুল ইসলাম
- ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০০:০০
- ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৩০টি স্বাধীন কমিটি গঠন
- ক্রোক হচ্ছে চট্টগ্রামের এক শিল্পপতির বাড়ি
রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির নায়কদের আইনের আওতায় আনতে প্রক্রিয়া শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে আব্দুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাশাপাশি বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ খেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম জোরদার করেছে। নিজস্ব ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৩০টি স্বাধীন কমিটি গঠন করা হয়েছে। যারা ঋণ নিয়ে পালিয়ে গেছেন তাদের স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ নিলামে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পাশাপাশি যারা জামিনদার ছিলেন তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জানা গেছে, দাতা সংস্থার কাছে ভালো ব্যাংক হিসেবে উদাহরণ দেয়া হতো রাষ্ট্র খাতের বেসিক ব্যাংক দিয়ে। কিন্তু পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে দায়িত্ব নিয়েই এ ব্যাংকে বসানো হয় শেখ হাসিনার আত্মীয় আব্দুল হাই বাচ্চুকে। তার ভূমিকায় তিন বছরের মাথায় ব্যাংকটি রুগ্ণ ব্যাংকে পরিণত হয়। হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে বের করে বিদেশে পাচার করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আব্দুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকেই বিপুল অঙ্কের অর্থ বের হতে থাকে। এক পর্যায়ে ব্যাংকটি দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হলে তদন্তে নামে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের অনুসন্ধানে বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির চিত্র বের হয়ে আসে। কিন্তু ওই সময় সরকারের নির্দেশে অধিকতর তদন্ত করতে দেয়া হয়নি। বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তকারী দলকে অনেকটা কর্মহীন করে অন্য বিভাগে বদলি করা হয়। বেসিক ব্যাংকের টাকা শেষ পর্যন্ত কাদের পকেটে গেছে তা বের করতে দেয়া হয়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বাচ্চুকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি। বরং ঘটনা জানাজানির পর বাচ্চুকে নির্বিঘে্ণ কানাডায় পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করা হয়।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের দুই হাজার ২৬৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ৫৯টি মামলা করে দুদক। কিন্তু সেসব মামলার কোনোটিতেই আবদুল হাই বাচ্চুকে আসামি না করায় সমালোচনা শুরু হয়। এরপর ২০২৩ সালের জুনে ৫৯ মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয় দুদক। এর মধ্যে ৫৮টিতে বাচ্চুর নাম আসে। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামির তালিকায় আছেন ৪৬ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ১০১ জন গ্রাহক। তবে এসব মামলার কোনোটিতে পরিচালনা পর্ষদের কাউকে আসামি করেনি দুদক।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবার আলোচনায় আসে বেসিক ব্যাংক। ব্যাংক থেকে অর্থ বের করে নেয়ার নায়কদের আইনের আওতায় আনতে প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। ৫৯ মামলার মধ্যে ১৪টিতে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত। একই সাথে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে অনুমোদন পাওয়া দুদকের নতুন মামলায় ৬৮ কোটি ৭৬ লাখ ৪৬ হাজার টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ অর্জন এবং ৫৬ কোটি ৫৭ লাখ ১০ হাজার ২০৬ টাকা কানাডায় পাচারসহ মোট ১২৪ কোটি ৯৩ লাখ ৬ হাজার ২৭৫ টাকার ‘জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগ আনা হচ্ছে।
এ দিকে, সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ না হওয়ায় ওই সব ঋণ এখন সুদে-আসলে ৮ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এসব ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে বেসিক ব্যাংক। ৫ আগস্টের পর বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যারা অর্থ নিয়ে পালিয়ে গেছে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া শুরু করে। একের পর এক মামলা দায়ের শুরু হয়েছে। ৮ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ উদ্ধারে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ৩০টি স্বাধীন কমিটি গঠন করা হয়েছে, যারা সরাসরি কেন্দ্রীয় অফিসের সাথে যুক্ত রয়েছেন। তারা বিভিন্ন শাখায় সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছেন। ইতোমধ্যে এর সুফলও আসছে। বড় বড় ঋণখেলাপির বিরুদ্ধে স্থাবর অস্থাবর সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের এক মামলায় ঋণের জামিনদার চট্টগ্রামের ক্লিফটন গ্রুপের মালিক মো: এম কামাল উদ্দিন চৌধুরীর বাড়ি ‘নীলাঙ্গন’ ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। তিনি সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির নেতা মুরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম এবং তার ভাই রাশেদ মুরাদ ইব্রাহিমের ৬৯ কোটি টাকা ঋণের জামিনদার ছিলেন। ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের বিচারক মুজাহিদুর রহমান এ আদেশ দেন। কামাল উদ্দিনের সার্সন রোডের ওই বাড়ি ও সম্পদের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৫০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয় আদালতের রায়ে।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী রেজাউল করিম জানান, বেসিক ব্যাংক তাদের খেলাপি ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য ক্লিফটন গ্রুপের মালিকের সম্পদ ক্রোকের আবেদন করেছিল। শুনানি শেষে আদালত আবেদন মঞ্জুর করেন, ফলে বিধি অনুযায়ী এখন এটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে বেসিক ব্যাংক থেকে নেয়া ৬৯ কোটি ৫৫ লাখ ৬৭ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধ না করায় এম আর এফ এসেনশিয়াল ট্রেড লিমিটেডের মালিকসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অর্থঋণ মামলা হয়। নগরীর জুবিলী রোড শাখা থেকে নেয়া এই ঋণের প্রধান গ্রহীতা ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির নেতা মুরশেদ মুরাদ ইব্রাহিম এবং তার ভাই রাশেদ মুরাদ ইব্রাহিম। তাদের পক্ষে জামিনদার ছিলেন ক্লিফটন গ্রুপের মালিক মো: এম কামাল উদ্দিন চৌধুরী।
বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করতে এ ঋণ নেয়া হয় এবং ধাপে ধাপে ৪০ কোটি টাকার এলসি সুবিধাও দেয়া হয়। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ঋণ পরিশোধ না করায় ব্যাংক আদালতে জামিনদারের সম্পদ ক্রোকের আবেদন করে। শুনানি শেষে আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা